সোনার কেল্লা: সে ছিল একদিন আমাদের যৌবনে কলকাতা। তৃণমূলের অঘোষিত দু’নম্বর। বেঁচেছিলাম বলেই স’বার কিনেছিলাম মাথা। জয়শলমিরের সোনার কেল্লায় সেই মুকুল সতীর্থ রতনদের সঙ্গে হিরে-জহরত নিয়ে খেলতেন। আজ একে ফেলছেন তো কাল ওকে তুলছেন। কিন্তু সে সব পূর্বজন্মের মমতামাখা স্মৃতি। এখনকার মুকুল হয় হেস্টিংসে নতুন মুরলিধর সেন লেনের অফিসের ঘরে। গল্পের সোনার কেল্লার মুকুল যেমন কলেজ স্ট্রিটের বাসিন্দা ছাপাখানার কর্মীর আদরের সন্তান। মমতা বা বৈভব না থাকলেও মায়া আছে। স্নেহও।
কুড়ি কুড়ি বছরের পার: জীবন গিয়েছে চলে কুড়ি কুড়ি বছরের পার। তখন আবার যদি ভোট-পথে দেখা হয় তোমার-আমার। ২০ বছর আগে ২০০১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে লড়েছিলেন। উত্তর ২৪ পরগনার জগদ্দল কেন্দ্র থেকে। তৃণমূলের প্রাক্তন ‘ব্রহ্মা’ এ বার কৃষ্ণনগর উত্তরে। একদা মুকুল-সহ তৃণমূলের দুই মাথা সুব্রত বক্সি ও পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে দলের অন্দরে ‘ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর’ বলে ডাকা হত। সেই ব্রহ্মাআবার ভোটের ময়দানে। তবে কি না, জীবন গিয়াছে চলে কুড়ি কুড়ি বছরের পার। এখন প্রজাপিতার আশ্রয় জোড়াফুল থেকে পদ্মফুলে।
বং চাণক্য: তৃণমূলে থাকার সময় ‘চাণক্য’ বলা হত তাঁকে। একদা যে নামে ডাকা হত বাম রাজনীতির অনিল বিশ্বাসকে। বিজেপি-তে এসেও সেই ক্যারিশমা দেখিয়েছেন ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে। আসন অনুযায়ী জিততে হলে সকাল ক’টার মধ্যে কত শতাংশ ভোট পড়া দরকার, তারও নিজস্ব অঙ্ক আছে মুকুলের। মন দিয়ে নির্বাচন কমিশনটা করেন। অন্তত গত ২০ বছর তা-ই করে এসেছেন। মুকুল রায় মানেই নির্বাচন কমিশন। ঘনিষ্ঠেরা বলেন, এমন এমন সব নিয়মকানুন জানেন, যা শুনে অনেক কমিশন কর্তাও ম্যানুয়াল ঘাঁটতে শুরু করেন। ‘রিপ্রেজেন্টেশন অব পিপল অ্যাক্ট’-এর কোন ধারায় কবে কী বদল হল, সব সময়ে নখদর্পণে।
পাঁচিল: ব্রহ্মা আর চাণক্যতেই শেষ নয়। জোড়াফুল রাজনীতিতে আরও একটা নাম ছিল মুকুলের— পাঁচিল। নিন্দকেরা বলতেন, একদিকে দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর অন্যদিকে বাকি সকলে। মাঝে পাঁচিলের মতো ছিলেন মুকুল। যিনি একাধারে দু’পারেরই প্রিয় এবং আস্থার। দু’পারের মধ্যে দেওয়ালও বটে। তাঁকে পেরিয়ে গেলে তবেই সাক্ষাৎ মিলত মমতার।
ম্যাপ-মাটি-মানুষ: বাম আমলে তখন তৃণমূল একটু একটু করে শক্তি বাড়াচ্ছে। মুকুলের দফতরে একটা পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্র থাকত। আর থাকত লাল, সবুজ, নীল রঙের টিপ। মেয়েদের সাজার উপকরণ দিয়েই মানচিত্রে ‘ডট’ দিতেন মুকুল। নিয়মিত বদলে যেত মানচিত্রের টিপসজ্জা। তিন রঙের টিপ বলে দিত, কোথায় বাড়ল শক্তি। কোথায় আরও বাড়াতে হবে। মুকুলের আগে নিজের কেন্দ্রে একই কৌশল নিতেন অধুনাপ্রয়াত অজিত পাঁজা। তবে টিপের বদলে তিনি ব্যবহার করতেন বোর্ডপিন।
বজরঙ্গী: তখনও বিজেপি-তে যোগ দেননি। কিন্তু তখনই বুকপকেট থেকে উঁকি মারত ‘হনুমান চালিসা’। ঘনিষ্ঠদের অনেকে বলেন, রাজনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতির সময় থেকেই নাকি এক শুভাকাঙ্খীর পরামর্শে পবনপুত্রের শরণ নেওয়া শুরু করেন।
চুপ-চাপ: নীলবাড়ির লড়াইয়ে তিনি একেবারেই চুপ। বিশেষ কথাবার্তা বলছেন না। প্রতিপক্ষ তৃণমূলের কৌশানী মুখোপাধ্যায় তাঁকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করলেও মাপা গলায় বলেছেন, ‘‘ও আমার কন্যার বয়সী। ও কী বলেছে, তা নিয়ে আমি কোনও মন্তব্য করতে চাই না।’’ নিজের কেন্দ্রের বাইরে বিশেষ যাচ্ছেন না। সেই প্রচারেও শব্দদূষণের মাত্রা খুবই কম। মুকুলের প্রচার কৌশল ‘কথা কম, র্যালি বেশি’। বরাবরই চুপচাপ কাজ করতে ভালবাসেন। সেটা আরও জমে মধ্যরাতে। অনেকে বলেন ইদানীং তিনি নাকি খানিক ‘চাপ’-এ আছেন। তবে সে সবকে গুরুত্ব দেওয়ার লোক বহু সফল যুদ্ধের সৈনিক মুকুল নন।
সিঙ্গুর সৈনিক: অষ্টম শ্রেণির ইতিহাস বইয়ের ‘কৃষিজমির অধিকার: সিঙ্গুর গণ আন্দোলন’ শীর্ষক অধ্যায়ে সেই আন্দোলনের সৈনিক হিসেবে এখনও জ্বলজ্বল করছে তাঁর নাম। মুকুলের যদিও এখন সিঙ্গুরে গেলে পাপবোধ হয়। প্রকাশ্যেই বলেছন, ‘‘টাটাকে তাড়িয়ে ভুল করেছিলাম।’’
ভুলভুলাইয়া: রক্তে শর্করার পরিমাণ ভোগায়। নিজে ইনসুলিন নেওয়া অভ্যাস করে ফেলেছেন। গোটা দিন মুড়ি-মুড়কির মতো ওষুধ খেতে হয়। ইদানীং সেটাও মনে থাকে না। সর্বক্ষণের সঙ্গীরা অবশ্য সময় মেনে জল আর ট্যাবলেট এগিয়ে দেন। মুকুলের ভুলোমনের একটি কাহিনি প্রবাদপ্রতিম। স্ত্রী-কে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে যাওয়ার কথা। তপসিয়ার তৃণমূল ভবনে সহধর্মিনীকে একটি ঘরে বসিয়ে রেখে অন্য ঘরে এমন ব্যস্ত হয়ে যান, যে স্ত্রী-ডাক্তার ইত্যাদি মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। স্ত্রী-ও তাঁকে না ডেকে গাড়ি নিয়ে সটান বাড়ি। তার পরে কাঁচরাপাড়ায় কী হইল, জানে শ্যামলাল!
ছাড়ি ছাড়ি মনে করি: ধূমপানের নেশা আছে। প্রাচীন নেশা। অনেক বার ছেড়েছেন। যত বার ছেড়েছেন, তত বার ধরেছেন। নানা রাজনৈতিক অপারেশনের টেনশন তো আছে! একবার ছেড়েই দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। রাজ্যসভায় তৃণমূলের প্রতিনিধি সংখ্যা বাড়ানোর অঙ্ক কষতে কষতে ফের ঠোঁটে সিগারেট। তবে সম্প্রতি চোখের চিকিৎসা চালু হওয়ার পর সে টান অনেকটা কমেছে।
বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তু: জ্যোতিষচর্চা করেন না। কিন্তু বিশ্বাস ষোল আনা। দক্ষিণ হস্তের বাজুতে অনেক শিকড়-বাকড়। ফুলহাতা পাঞ্জাবি পরলেও চোখে পড়ে। কিছু কিছু নাকি শুভাকাঙ্খীদের আব্দারেও ধারণ করতে হয়। বীরভূমের পাথরচাপড়িতে দাতাবাবার মাজারে একটা সময়ে নিয়মিত যাতায়াত ছিল। দু’হাতের আঙুলে অনেক আংটি। জে পি নড্ডার কনভয়ে হামলার দিন ইট লেগেছিল হাতে। বিক্ষত হাতের আংটি কাটাতে সল্টলেকের বাড়িতে অসিলেটিং মেশিন আনাতে হয়েছিল।
দাদু-নাতি-পাখি: কৃষ্ণনগর থেকে কাঁচরাপাড়া আর কতই বা দূর! সদ্য জেড ক্যাটিগরির নিরাপত্তা পাওয়া মুকুল প্রচারের ফাঁকে মাঝে মাঝেই চলে আসছেন কাঁচরাপাড়ায়। স্ত্রী ছাড়াও পুত্র, পুত্রবধূ এবং আদরের দুই নাতি-নাতনিকে বড্ড মিস করেন। বাড়িতে ছেলে শুভ্রাংশুর শখের অনেক পাখিও আছে। কয়েকটি সারমেয়ও। সুযোগ পেলেই খেলতে চলে আসেন তাদের সঙ্গে।
মাছ-মিষ্টি-মোর: এমনিতে গিন্নি কৃষ্ণাদেবীর হাতের ডাল-আলুভাজা প্রিয় খাবার। তবে মাছ ছাড়া ঠিক জমে না। সেই সঙ্গে মিষ্টি। মধুমেহকে সঙ্গী করেও মিষ্টি খেতে ও খাওয়াতে ভালবাসেন। কৃষ্ণনগরে গিয়ে অবশ্য সরভাজা এবং সরপুরিয়া থেকে নিরাপদ দূরত্ব রাখছেন।
হাত-যশ: বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি-তে ‘যোগদান মেলা’ শুরু করেছিলেন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। বাকি নেতারাও করেছেন। কিন্তু ধারেভারে তাঁর কাছাকাছিও অন্যরা কেউ নেই। সেই লোকসভা নির্বাচনের আগে থেকে ‘খেলা’ শুরু করেছিলেন। আর বিধানসভা ভোটের মুখে মুখে অভিনেতা যশ দাশগুপ্তকে গেরুয়া শিবিরে নিয়ে আসা তো মাস্টারস্ট্রোক!
পুজো-পাঠ: প্রতিদিনের পুজো তো আছেই। সেই সঙ্গে বাড়িতে একেবারে নিয়মনিষ্ঠার সঙ্গে দুর্গাপুজো। একই ভাবে কালী, লক্ষ্মী, সরস্বতীও। শারদীয়ার চারদিন তো দেবী দুর্গার পাশাপাশি মুকুল-ভক্তদেরও ঢল নামে কাঁচরাপাড়ার বাড়িতে। তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি-তে যোগ দেওয়ার মুখে মুখে দিল্লি থেকে একদিনের জন্য বেলুড়ে এসেছিলেন মুকুল। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনে দীক্ষা নেন ২০১৭ সালের অক্টোবরে।
অনাথের নাথ: তৃণমূল জমানায় কত কঠিন সময়ে যে ত্রাতা হয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। বলা হত সব গোষ্ঠীর ‘সূত্রধর’ তিনি। সমাধান সূত্র আছে তাঁরই কাছে। আবার পদ্মবাহিনীতে এসেও সব্যসাচী দত্তর বাড়ি গিয়ে ‘লুচি-আলুরদম’ বৈঠক বা শান্তনু ঠাকুরকে ‘ম্যানেজ’। সবেতেই মোদী, শাহ, বিজয়বর্গীয়রা মুকুলেই ভরসা রেখেছেন। যাঁর কেউ নেই, তাঁর মুকুল আছেন। তৃণমূলের প্রার্থিতালিকা ঘোষণার পর বঞ্চিতদের ভিড় লেগেছিল মুকুল-নিবাসে। সোনালী গুহর কান্না, দীপেন্দু বিশ্বাসের হতাশায় রাজনৈতিক পুনর্বাসনের প্রলেপ তিনিই দিয়েছিলেন।
টাইম-আউট: অবসর পেলেই ক্রিকেটে ঢালিয়া দিনু মন। টেস্টম্যাচের আকণ্ঠ ভক্ত। ইডেনে ভাল ম্যাচ থাকলে হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও সময় বার করে চলে যান। ক্লাবহাউসের লোয়ার টায়ারের বাঁধা দর্শক তিনি। তবে টি-টোয়েন্টি, আন্তর্জাতিক ম্যাচ থেকে রঞ্জি ট্রফিতেও আগ্রহ কম নয়। সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়দের কেরিয়ারের খুঁটিনাটির খোঁজ রাখেন। এখন ভোট-ব্যস্ততার মধ্যেও নজরে রয়েছে আইপিএল। নতুন কোন ক্রিকেটার কেমন খেলছে, প্রশ্ন করলেই গড়গড়িয়ে বলে দেবেন!
তথ্য: পিনাকপাণি ঘোষ, রেখাচিত্র: সুমন চৌধুরী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy