ভোট দিতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন শীতলখুচিতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে নিহত হামিদুল মিয়াঁর পরিজন। শীতলখুচির জোরপাটকিতে। ছবি: উৎপল অধিকারী। (পাশে) মা গিয়েছেন ভোট দিতে। সন্তানকে আগলে রেখেছেন পুলিশকর্মী। রামপুরহাটে। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম
বড় কোনও হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেনি ঠিকই। তবে সেই অর্থে ভালও হল না শেষটা। অশান্তিমুক্ত থাকল না ভোট-অষ্টমী। বৃহস্পতিবার বঙ্গ বিধানসভার শেষ পর্বের নির্বাচনে চারটি জেলার ৩৫টি আসনে ভোট ছিল এবং খুচরো গোলমাল হয়েছে চারটি জেলাতেই।
যদিও ভোটের সময়সীমা শেষ হওয়ার পরে রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী অফিসার (সিইও) আরিজ আফতাব দাবি করেন, ‘‘এ দিনের ভোট শান্তিপূর্ণ ছিল।’’ এজিডি (আইনশৃঙ্খলা)
জগ মোহন জানান, এ দিন প্রতিরোধমূলক ধারায় ৮৩৫ জনকে আটক করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৩১৬ জনকে আটক করা হয় কলকাতা পুলিশের এলাকায়। ১৪৪ ধারায় চার জন এবং নির্দিষ্ট মামলায় ২০ জন গ্রেফতার হয়েছেন। উদ্ধার হয়েছে ৭৮টি বোমা, পাঁচটি অবৈধ অস্ত্র, ২১টি গুলি। ভোট-নজরদারিতে ছিলেন মোট ৪২ জন পর্যবেক্ষক। সারা দিনে নির্বাচন কমিশনের কাছে ১,১৭৯টি অভিযোগ জমা পড়েছে।
শেষ দফা ভোটের দিনেই আগামী রবিবার গণনাকালে কোভিড বিধি পালন নিয়ে জেলা প্রশাসনগুলির সঙ্গে বৈঠক করেন সিইও দফতরের কর্তারা। দফতর সূত্রের খবর, গণনা এজেন্টদের দুই ডোজ়ের প্রতিষেধক অথবা র্যাট বা আরটি-পিসিআর পরীক্ষা বাধ্যতামূলক। সংশ্লিষ্ট সকলকেই এ কথা জানানো হয়েছে।
এ দিন উত্তর কলকাতার কাশীপুর-বেলগাছিয়া, শ্যামপুকুর, জোড়াসাঁকো, মানিকতলা, বেলেঘাটা, এন্টালি ও চৌরঙ্গি কেন্দ্রে ভোট হয়। মহাজাতি সদনের সামনে বোমাবাজি হয় সাতসকালেই। পরে বোমাবাজির অভিযোগ ওঠে বিধান সরণি এলাকাতেও। পুলিশের দাবি, চকলেট বোমা ফাটানো হয়েছে। বেলেঘাটার মথুরবাবু লেন-সহ কিছু জায়গায় গোলমাল হয়। এক বিজেপি কর্মীর মুখ ফেটে রক্ত ঝরতে থাকে। পুলিশ জানায়, জোড়াসাঁকোর বিজেপি প্রার্থী মীনাদেবী পুরোহিতের গাড়ি লক্ষ্য করেও শব্দবাজি ছোড়া হয়েছে। সিইও বলেন, ‘‘কলকাতায় সকালে দু’টি বোমাবাজির ঘটনা ঘটে। ছ’জন গ্রেফতার হয়েছে। তদন্ত চলছে।’’
ভোটের আগে থেকেই বীরভূমের দিকে বিশেষ নজর ছিল কমিশনের। সেখানে পুলিশ সুপার বদলি ছাড়াও জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মোকাবিলায় অতিরিক্ত ছ’জন পুলিশকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। রাজ্য পুলিশের পাশাপাশি মোতায়েন করা হয় ২৩০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী। নজরবন্দি করা হয় জেলার তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলকে। কিন্তু বীরভূমে অশান্তি ঠেকানো যায়নি। তৃণমূল-বিজেপি সংঘর্ষে বার বার অশান্ত হয়ে ওঠে ইলামবাজার। বোলপুর বিধানসভা কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থীর গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে ডোমনপুর গ্রামে। পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর সামনেই সংঘর্ষে জড়িয়েছেন দু’দলের কর্মীরা। আড়পাড়া গ্রামের বিজেপির এক পোলিং এজেন্টকেও বেধড়ক মারধর করে মাথা
ফাটিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে রাজ্যের শাসক দলের বিরুদ্ধে। বস্তুত ওই জেলায় তৃণমূল ও বিজেপি পরস্পরের বিরুদ্ধে সমস্বরে সরব। তৃণমূল বোলপুর শহরের ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে বিজেপির ক্যাম্প অফিস ভেঙে দেয়
বলে অভিযোগ করেছে বিজেপি। একই ভাবে বিজেপি ইলামবাজারে জনুবাজার এলাকায় তৃণমূলের ক্যাম্প অফিস ভেঙেছে বলে তৃণমূলের অভিযোগ। ইট-লাঠি নিয়ে হামলা হয়, মাথা ফাটে অনেকের। বোমাবাজি হয়। নানুরের সাওতা গ্রামে এজেন্ট বসাতে গিয়ে আক্রান্ত হন বিজেপি প্রার্থী তারকেশ্বর সাহা। তাঁর গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে বলেও অভিযোগ। নানুরেরই দাসকলগ্রামে কানে বন্দুক ঠেকিয়ে তুলে নিয়ে গিয়ে বিজেপির দুই পোলিং এজেন্টকে বেধড়ক মারধর করে রাস্তার ধারে ফেলে দিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। দুই ক্ষেত্রেই তির তৃণমূলের দিকে। সিইও বলেন, ‘‘নানুরে সকালে এক প্রার্থীর উপরে হামলা হয়েছে। বোলপুরে এক জন প্রার্থী কিছু ভোটারের সঙ্গে যাচ্ছিলেন। দুই গোষ্ঠীর মধ্যে গোলমালে কয়েক জন আহত হয়েছেন।’’
মালদহের বৈষ্ণবনগর বিধানসভার ৮০ নম্বর বুথের এক বিজেপি কর্মীর উপরে ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলার অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। আবার মানিকচকে বিজেপি এক তৃণমূল যুব নেতার গাড়িতে হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ। ছাপ্পা ভোটের অভিযোগে মানিকচকের ন’টি বুথে পুনর্নির্বাচন দাবি করেছে তৃণমূল।
বিক্ষিপ্ত দু’-একটি ঘটনা ছাড়া মালদহের ছ’টি বিধানসভা কেন্দ্র এবং কোচবিহার জেলার শীতলখুচির সেই ১২৬ নম্বর বুথের ভোট ছিল শান্তিপূর্ণ। শীতলখুচির ১২৬ নম্বর বুথের উপনির্বাচনে চার দিক ঘিরে রাখেন কেন্দ্রীয় বাহিনী ও রাজ্য পুলিশের জওয়ানেরা। তার মধ্যেই সকাল ৯টা নাগাদ উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বুথের কাছে বিজেপির ফ্ল্যাগ লাগানো গাড়ি দেখতে পেয়ে তেড়ে যান তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী পার্থপ্রতিম রায়। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
আশঙ্কা উড়িয়ে শেষ পর্যন্ত বিনা রক্তপাতে শেষ দফার ভোট শেষ হয়েছে মুর্শিদাবাদে। প্রশাসনের বক্তব্য, দু’-একটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া ওই জেলায় শান্তিতে নির্বাচন হয়েছে। জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, বিকেল ৫টা পর্যন্ত জেলার ১১টি বিধানসভা কেন্দ্রে ৮০ শতাংশেরও বেশি ভোট পড়েছে। প্রশাসনের ধারণা, রাতের দিকের ভোট ধরলে শতাংশের হার বাড়বে। পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগে মুখর রাজনৈতিক দলগুলিও জানিয়েছে, এ বার মুর্শিদাবাদের নির্বাচন শান্তিতেই শেষ হয়েছে। জেলাশাসক শরদ কুমার দ্বিবেদী বলেন, ‘‘এ দিন অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে।’’
কোভিড বিধি পালন নিয়ে এ দিন কিছুটা হলেও কমিশনের বোধোদয় লক্ষ করা গিয়েছে। ভোটারদের বেশির ভাগের মাস্ক ছিল। তবে অনেক ক্ষেত্রে লাইনে দূরত্ব-বিধি মানা হয়নি। যদিও শীতলখুচির ১২৬ নম্বর বুথে সকলেরই মাস্ক ছিল। পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য চিহ্নিত বৃত্তের ভিতরেই দাঁড়িয়ে ছিলেন ভোটারেরা।
এ দিন কর্তব্যরত অবস্থায় সিআরপি-র আইজি তারাপীঠে পুজো দিয়েছেন। সেটা আদৌ করা যায় কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। যদিও সন্ধ্যায় এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) বলেন, ‘‘ওই ঘটনার কথা আমার জানা নেই।’’
২ মে গণনার দিনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হচ্ছে বলে সিইও দফতরের খবর। ঠিক হয়েছে, জেলা নির্বাচনী আধিকারিকেরা সব দলের সঙ্গে বৈঠক করবেন। রিটার্নিং অফিসারেরা জানাবেন, কোথায় পরীক্ষার ব্যবস্থা হচ্ছে। জেলা স্বাস্থ্য আধিকারিকেরা সেই সব পরীক্ষার তত্ত্বাবধান করবেন। যাঁরা গণনা কক্ষে ঢুকবেন, তাঁদের বিধি মানা বাধ্যতামূলক। নিরাপত্তাকর্মী ও বেশির ভাগ ভোটকর্মীকেই প্রতিষেধক দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় বাহিনীর কারও শারীরিক সমস্যা দেখা দিলে পরীক্ষা করানো হবে। সিইও দফতরের এক কর্তা জানান, দ্রুত পরীক্ষার রিপোর্ট পেতে সহযোগিতা করা হবে।
কমিশনের নির্দেশ, গণনা কেন্দ্রের বাইরে কোনও জমায়েত করা যাবে না। গণনা কক্ষে জীবাণুনাশ করতে হবে এবং দূরত্ব-বিধি মানতে হবে। এগজস্ট ফ্যান লাগাতে হবে ঘরে। ভোটযন্ত্র যে-বাক্সে ভরা থাকবে, জীবাণুনাশ করতে হবে তাতেও। করোনার উপসর্গযুক্ত ব্যক্তিদের গণনা কেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হবে না। গণনা এজেন্টের কোভিড পরীক্ষার ফল পজ়িটিভ এলে প্রার্থী এজেন্ট বদল করতে পারবেন। গণনাকর্মীদের মাস্ক, ফেসশিল্ড, হাতশুদ্ধি, গ্লাভস দেওয়া হবে। দরকারে রিটার্নিং অফিসারের তত্ত্বাবধানে আলাদা ঘরে পোস্টাল ব্যালট গোনা যেতে পারে। গণনা কেন্দ্রে করণীয় কী, তা স্পষ্ট করে দেওয়া হবে। আগেই কমিশন জানিয়েছিল, ২ মে গণনার পরে বিজয় মিছিল করা যাবে না। শংসাপত্র নেওয়ার সময় বিজয়ী প্রার্থীর সঙ্গে সর্বাধিক দু’জন থাকতে পারবেন। কমিশন জানিয়েছে বিধি ভাঙলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ২০০৫ সালের বিপর্যয় ব্যবস্থাপনা আইন এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির আওতায় যথোচিত আইনি পদক্ষেপ করা হবে।
বিক্ষিপ্ত কিছু অশান্তির ঘটনা নিয়ে অভিযোগ করেছে সব দলই। তবে বড় কোনও অভিযোগ বা পুনর্নির্বাচনের দাবি ওঠেনি। সব পক্ষই মানুষের উপরে ভরসা রাখার কথা বলেছে।
তৃণমূল সাংসদ ও মুখপাত্র সুখেন্দু শেখর রায় বলেন, ‘‘কিছু অশান্তি এই পর্বেও ঘটেছে। বীরভূমের মতো কিছু জায়গায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে অভিযোগ আছে। তবে মানুষ শান্তিপূর্ণ ভাবেই ভোট দিয়েছেন।’’ সুখেন্দুবাবুর মতে, করোনার কারণে কলকাতায় ভোটের হার কিছুটা কম হয়ে থাকতে পারে। মালদহ ও মুর্শিদাবাদে অন্যান্য বার যে-বিপুল হারে ভোট পড়ত, তার চেয়ে সম্ভবত একটু কম হয়েছে এ বার। তবে সার্বিক ভাবে ভোটদানের হারে তৃণমূল নেতৃত্ব খুশি। সুখেন্দুবাবু মনে করিয়ে দেন, ‘‘আবার আমরা বলছি, নির্বাচন কমিশনের আট দফায় ভোট করার কোনও প্রয়োজন ছিল না। যেটুকু অশান্তি হয়েছে, এক দফায় ভোট হলে আরও কম হত। করোনা সংক্রমণ মোকাবিলাতেও সুবিধা হত। প্রার্থী, রাজনৈতিক কর্মী, ভোটকর্মী বা পুলিশ ও বাহিনীর জওয়ান— সকলের পক্ষেই এই প্রবল গরমে আট দফার ভোট অমানুষিক হয়ে উঠেছিল!’’
বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ এবং দলের মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘সাত দফার ভোটে কোনও মানুষ সংবাদমাধ্যমের সামনে এসে বলেননি যে, তাঁরা ভোট দিতে পারেননি। অষ্টম দফায় কিন্তু সেই রকম কিছু ঘটনা ঘটেছে। খাস কলকাতায় তৃণমূলের বাহিনী যে-ভাবে দৌরাত্ম্যের চেষ্টা করেছে, তার পরে ওই দল কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, এটা কি বলা যায়?’’ তবে তাঁদের দাবি, মানুষ যেখানে ভোট দিয়েছেন, পরিবর্তনের লক্ষ্যেই দিয়েছেন। সংযুক্ত মোর্চার প্রতিনিধিদলও সিইও-র দফতরে গিয়ে বেলেঘাটা, জোড়াসাঁকোর মতো কিছু কেন্দ্রে তৃণমূলের দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে ভোটদানে বাধা এবং বুথ দখলের চেষ্টার অভিযোগ করেছে। ডোমকলে বুধবার রাতে তৃণমূল প্রার্থীর গাড়ির ধাক্কায় এক সিপিএম-কর্মীর মৃত্যু এবং তিন জনের আহত হওয়ার ঘটনায় দোষীদের গ্রেফতারি দাবি করেছে তারা। পরে সিপিএম নেতা শমীক লাহিড়ী জানান, ভোটের সরঞ্জাম বিলির কেন্দ্রগুলিতে কোভিড বিধি সে-ভাবে মানা হয়নি। তাঁদের দাবি, গণনা কেন্দ্রে যাতে ওই বিধি ঠিকমতো মানা হয়, তার ব্যবস্থা হোক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy