এ বারের বিধানসভা নির্বাচনে প্রেশার গ্রুপ সক্রিয়তার বেশ কিছু উদাহরণ সামনে আসছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্রেশার গ্রুপ শব্দটির উদ্ভব আমেরিকায়। সাধারণ ভাবে প্রেশার গ্রুপ এক ধরনের মানুষের সমষ্টি যারা নিজেদের স্বার্থের তাগিদে ঐক্যবদ্ধ হয় ও সেই স্বার্থ পূরণের জন্য সরকারের নীতিসমূহকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তাদের পার্থক্য স্পষ্ট। এরা নিজেরা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়াতে অংশগ্রহণ করে না কিন্তু নির্বাচনের সময় কারা নির্বাচিত হলে তাদের সুবিধা হয় বা কারা নির্বাচিত হলে তাদের স্বার্থ ক্ষুন্ন হবে সে ব্যাপারে তারা তাদের মতামত স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করতে পিছপা হয় না। এই প্রেশার গ্রুপ স্থানীয়,আঞ্চলিক, জাতীয় এমনকি, আন্তর্জাতিক স্তরেও ক্রিয়াশীল থাকে।
প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রের বিচারে উন্নত দেশগুলিতে প্রেশার গ্রুপ একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সদ্য সমাপ্ত আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অনাবাসী ভারতীয়দের (যারা এই মুহূর্তে সে দেশে মেক্সিকানদের পরেই দ্বিতীয় বৃহত্তম অনাবাসী জনগোষ্ঠী) বিভিন্ন সংগঠন ভিসা সংক্রান্ত বিতর্কের পর যে ভাবে ট্রাম্পের বিরোধিতায় ডেমোক্র্যাটদের পক্ষাবলম্বন করেছে তা সামান্য হলেও ভোটের ফলাফলকে প্রভাবিত করেছে। বাইডেন প্রশাসনে ভারতীয়দের উত্তরোত্তর ক্ষমতা বৃদ্ধি প্রেশার গ্রুপ রাজনীতিরই পরিণাম।
ভারতের ক্ষেত্রে বিভিন্ন গণসংগঠন ( ছাত্র /যুব/মহিলা), শ্রমিক সংগঠন, বিভিন্ন বণিক সভা, নানান ধরনের অধিকার সংগঠন, পরিবেশ সংগঠনকে প্রেশার গ্রুপ হিসাবে আখ্যা দেওয়া হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তকে ভারতে প্রেশার গ্রুপ সম্বন্ধে যতই নানা কথা বলা হোক না কেন, আদতে দু-একটা ব্যতিক্রম বাদ দিলে এ দেশে এই ধরনের গ্রুপের কার্যকারিতা সে রকম নয়। বণিক সভাগুলি (অ্যাসোচেম/ফিকি) তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থে সরকারের নীতির উপর প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করে বটে কিন্তু নির্বাচনী রাজনীতিকে প্রভাবিত করার কাজে প্রেশার গ্রুপের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। পশ্চিমবঙ্গও এর ব্যতিক্রম নয়।
এই রাজ্যে এই না থাকার সবচেয়ে বড় কারণ পাঠ্যপুস্তকে যাদের প্রেশার গ্রুপ হিসাবে চিহ্নিত করা হয় সেই গণসংগঠনগুলির উপর রাজনৈতিক দলগুলির দখলদারি ও কর্তৃত্ব। যেমন শ্রমিক সংগঠন সিটু বললেই সিপিএম, বিএমএস বললেই বিজেপি আর ছাত্র পরিষদ মানেই কংগ্রেস। তাই রাজ্যের প্রমুখ শিক্ষক সংগঠন শতাব্দী প্রাচীন এবিটিএ মানেই তা সিপিএমের শিক্ষক ফ্রন্ট। মুখে গণসংগঠনগুলি তাদের স্বাধীন সত্তার কথা বললেও তারা কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করে। ফলে নির্বাচনের সময় নিজ জোটকে সমর্থনের দাবি জানানো ছাড়া তাদের আর কিছুই করার থাকে না। এ রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের আবার স্বাধীন সত্তার নামাবলী চাপাবার দায় পর্যন্ত নেই। তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা সমস্ত গণসংগঠনের নামে তৃণমূল শব্দটির অনিবার্য উপস্থিতি।
অবশ্য এ বারের বিধানসভা নির্বাচনে প্রেশার গ্রুপ সক্রিয়তার বেশ কিছু উদাহরণ সামনে আসছে যা যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক। এ ক্ষেত্রে প্রথম নামটি হল ‘নো ভোট টু বিজেপি’ ক্যাম্পেন। এ বছর জানুয়ারি মাসে কলকাতার ভারতসভা হলে মানবাধিকার কর্মী, শ্রমিক আন্দোলন কর্মী, চিকিৎসক, ছাত্র, যুব, চলচ্চিত্র পরিচালক, লিটল ম্যাগাজিনের কর্মী, জমি ও পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী— এক সঙ্গে এই উদ্যোগের জন্ম দেয়। তাদের বক্তব্য, রাজ্য তথা দেশকে ফ্যাসিবাদের বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য তারা জোট বেঁধেছেন। কোনও রকম অস্পষ্টতা না রেখে তারা বলছেন যে হেতু রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ ও বিজেপি-কে তারা ফ্যাসিবাদের প্রতীক বলে মনে করেন, তাই তাদের নির্বাচন-সহ সব ক্ষেত্রে পরাজিত করাটাই লক্ষ্য। এই উদ্যোগ নিজে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না, কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল বা জোটকে ভোট দিতে আহ্বান জানাচ্ছে না, কিন্তু বিজেপি-কে ভোট দিতে না বলে তারা তাদের বিরোধিতা স্পষ্ট করেছেন।
পশ্চিমবঙ্গের মত রাজ্যে যেখানে রাজনীতির যাবতীয় ন্যারেটিভ পার্টি নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, সেখানে এই প্রচার এতটাই অভাবিত যে প্রথম যখন উদ্যোক্তারা নো ভোট টু বিজেপি সংক্রান্ত পোস্টার দেওয়ালে সাঁটেন তখন মূলধারার গণমাধ্যম পর্যন্ত খোঁজ খবর না করেই তাদের ‘বেনামি’ পোস্টার বলে দেগে দেয়। কিন্তু উদ্যোগটা শুরু হওয়ার দু’মাস পর যুযুধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়া, নেটমাধ্যমে পক্ষে বিপক্ষে মতামতের ঢেউ থেকে এটা স্পষ্ট যে, এই নাগরিক উদ্যোগ নিজেদের একটি প্রেশার গ্রুপ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। প্রচারটা আরও বড় মাত্রা পেয়ে গিয়েছে যখন দিল্লির কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় কিসান মহাপঞ্চায়েত করে একই দাবিতে প্রচার করেছে। এই উদ্যোগ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে যেমন বিজেপিকে ভোট না দেওয়ার কথা বলা হলেও, কোন দলকে ভোট দেওয়া উচিত সে ব্যাপারে উদ্যোক্তারা নীরব কেন?
অনেকে মনে করছেন যে শুধু নির্বাচকমণ্ডলীর উদ্দেশ্যে বার্তা কেন, যে রাজনৈতিক দলগুলো বিজেপি-র বিরুদ্ধে ভোটের ময়দানে লড়াই করছে ফ্যাসিবাদ বিরোধিতার স্বার্থে তাদের একসঙ্গে ভোটের লড়াইয়ে আহ্বান জানানো হবে না কেন? উচ্চারিত হয়েছে এ কথাও যে, ভোটের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদকে কি পরাজিত করা যায়! এই প্রত্যেকটি প্রশ্ন আলোচনাযোগ্য, একই সঙ্গে এটাও সত্য যে এই আলাপ-আলোচনা, সওয়াল-জবাব ‘নো ভোট টু বিজেপি’ উদ্যোগকে মান্যতা দিচ্ছে।
দ্বিতীয় উদাহরণটি আবার প্রেশার গ্রুপ ও রাজনৈতিক দলের মধ্যে যাতায়াতের গল্প যেখানে আখ্যানের নায়ক পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকি। বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে জনপ্রিয় ফুরফুরা শরিফের এক হুজুর এ বার সংখ্যালঘু ও নিপীড়িত সম্প্রদায়ের ‘হক’ আদায়ের জন্য সরাসরি ভোটের লড়াইয়ে। আব্বাসের সঙ্গে জোট করে সিপিএম তার জাত খুইয়েছে কি না বা আব্বাস মৌলবাদী কি না, তা নিয়ে বহু আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু ‘হক’ এর প্রশ্নটি নিয়ে বিদ্বজ্জনেরা নীরব।
এ রাজ্যে ৩০ শতাংশ মুসলমান। বাম জমানায় সাচার রিপোর্ট ও পরিবর্তনের জমানায় আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সংক্রান্ত প্রতিবেদনে এটা পরিষ্কার যে, মুসলমানদের অবস্থা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়েছে। সব জমানাতেই তারা নিরাপদ ভোটব্যাঙ্ক যাদের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটে ব্যবহার করে নির্বাচনী সাফল্য পাওয়া যায়। কিন্তু ক্ষমতার বৃত্তে তাদের প্রবেশ নৈব নৈব চ। এই অবস্থায় ক্ষমতার রাজনীতিতে তাদের অংশিদারী পাওয়ার লক্ষ্যে প্রেশার গ্রুপ হিসাবে পীরজাদা ভোটের রাজনীতিতে প্রবেশ করেছেন এবং বাম জোটে তার শরিক হওয়া একটা অস্থায়ী অবস্থান। হক পাওয়ার লড়াই আসলে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে নিরন্তর দরাদরি।
এই দরাদরির বিষয়টা কী ভাবে রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে তা বুঝতে হলে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে প্রেশার গ্রুপ হিসাবে মতুয়া সংগঠনগুলির কর্মকাণ্ডকে নজরে আনা দরকার। ২০১১ ও ২০১৬ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতি মতুয়াদের সমর্থন ও মতুয়াদের প্রতি তৃণমূল সরকারের প্যাকেজ আসলে এক সমানুপাতিক সম্পর্ক। কিন্তু কোনও সম্পর্কই চিরস্থায়ী নয়। যে হেতু মতুয়াদের কাছে নাগরিকত্বের প্রশ্নটি অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয় তাই বিগত লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি-র নাগরিকত্ব সম্পর্কে প্রতিশ্রুতির বন্যায় মতুয়াদের আনুগত্য বদলে যেতে বেশি সময় লাগে না। এখন আবার যখন এটা পরিষ্কার যে অসম ও পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি নাগরিকত্ব প্রশ্নে বিপরীত অবস্থান নিচ্ছে তখন এ রাজ্যের নির্বাচনে মতুয়াদের আনুগত্য কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের দিকেই থাকবে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। এ বারের নির্বাচনে পার্শ্বশিক্ষকদের বেশ কিছু সংগঠন তাদের পেশাগত দাবি পূরণের জন্য সরকার বদলের দাবি তুলেছেন। কিন্তু কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করার কথা বলছেন না। এটাও কিন্তু প্রেশার গ্রুপের প্রশ্নটিকেই সামনে আনছে।
যে কোনও সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একই স্বার্থের কারণে সম্পর্কিত মানুষজন ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজনৈতিক দলগুলির উপর চাপ সৃষ্টি করছেন বা দাবির পক্ষে জনমত তৈরি করছেন— এ ছবিকে স্বাগত না জানানোর কারণ নেই।
(লেখক স্কুল শিক্ষক এবং লিটল ম্যাগাজিন কর্মী, মতামত ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy