কাজী আবুল হাসান
জেলায় এমনটা হয়েই থাকে। কিন্তু কলকাতার বুকে দিনদুপুরে তাঁকে যে কেউ ‘ভোট দিতে বেরোবেন না’ বলে হুমকি দিয়ে যেতে পারে, কল্পনাও করতে পারেননি কাজী আবুল হাসান। বেপাড়া হলেও না-হয় কথা ছিল। কিন্তু তা বলে খাস পার্ক সার্কাসে? নিজের চৌহদ্দিতে? ভাবতে পারছেন না কাজী সাহেব।
শুক্রবার বেলা আড়াইটে নাগাদ বালু হাক্কাক লেনের বাড়ি থেকে বেরিয়ে কয়েক পা এগোতেই পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল একটি মোটরবাইক। চালক ছেলেটি ঠান্ডা গলায় বলেছিল, ‘‘কাল ভোট মত দিজিয়ে।’’ কেন? জবাব এসেছিল, ‘‘কিঁউকি হম মানা কর রহে হ্যায়!’’
৪৭ বছরের কাজী সাহেব বালিগঞ্জ কেন্দ্রের ভোটার। অভিযোগ, ভোট দিতে না যাওয়ার হুমকি শুনেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কেন্দ্রের অনেকেও। কাজী সাহেব বাঙালি। মুখ্যমন্ত্রীর কেন্দ্রে যাঁরা হুমকি পেয়েছেন, তাঁরা মূলত অবাঙালি। যাঁদের ভোটে লোকসভায় ভবানীপুর কেন্দ্রে বিজেপির কাছে পিছিয়ে পড়েছিলেন তৃণমূল প্রার্থী। ভবানীপুর, চক্রবেড়িয়া, উড স্ট্রিটের একাধিক বহুতলে ঢুকে বেল বাজিয়ে তৃণমূল কর্মীরা শনিবার ভোট না দিতে শাসিয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ। তবে কাজী সাহেবের মতো প্রকাশ্যে সে কথা বলতে সাহস পাচ্ছেন না ওঁরা।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি শুনে নিরাপত্তারক্ষীরা আরও ভাল করে সদর দরজা এঁটে দিয়েছেন। গাড়িতে চেপে ওই সব আবাসন থেকে যাঁরা বেরিয়েছেন, তাঁরাও কথা বলার জন্য দাঁড়াননি।
তবে রাজ্য বিজেপির তরফে এদিন রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী অফিসার (সিইও) সুনীল গুপ্তর দফতরে ২০টি আবাসন ও বহুতলের তালিকা দিয়ে অভিযোগ করা হয় বাসিন্দাদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। সেই তালিকা ধরে ধরে আনন্দবাজার সেখানে পৌঁছে যায় এ দিন দুপুরেই। ভবানীপুরে গাঁজা পার্কের কাছে একটি বহুতলে ঢুকতেই নিরাপত্তারক্ষী পথ আগলালেন। ইন্টারকমে ধরিয়ে দিলেন আবাসন কমিটির সম্পাদক দীনেশ মেটাকে। কেউ এসে হুমকি দিয়েছেন কি না প্রশ্ন করতেই একটু থমকালেন দীনেশ। তার পর বললেন, ‘‘এমন কোনও ঘটনা আমার জানা নেই।’’
এলাকার আর একটি বহুতলের ফ্ল্যাটে কলিং বেল টিপতেই এক মহিলা দরজা সামান্য ফাঁক করলেন। ‘‘কেউ এসে হুমকি দিয়েছে?’’ প্রশ্নটা শুনেই বললেন, ‘‘আমায় কেউ কিছু বলেনি। আমি এমন কিছু শুনিনি।’’ বিজেপি নেতা জয়প্রকাশ মজুমদারের জমা দেওয়া তালিকায় নাম ছিল উড স্ট্রিটের একটি আবাসনেরও। কথা বলার জন্য আবাসনের চেয়ারম্যান আর কে সুদের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে তিনি রাজি হননি। তাঁর মোবাইল নম্বরও দিতে রাজি হননি নিরাপত্তারক্ষী।
সন্ধ্যায় অবশ্য এক পরিচিতের মোবাইল থেকে সন্ত্রস্ত ভোটারদের বেশ কয়েক জন কনফারেন্স কল-এ আনন্দবাজারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তাঁদেরই এক জন বলেন, ‘‘গত দু’দিন ধরেই এলাকার কিছু তৃণমূলকর্মী (পরিচিত মুখ) আমাদের ফ্ল্যাটে আসছেন। বলছেন, ‘ভোট দিতে যাওয়ার দরকার নেই।’ ওই ভোটারের প্রশ্ন, ‘‘রাজ্যের ভোট অবাধ ও স্বচ্ছ হবে না কেন? গত পাঁচ বছরে ভাল কাজ হয়ে থাকলে ভোটাররা তো এমনিই ভোট দেবে।’’
আর এক জন বলেন, ‘‘টিভিতে দেখেছি কেন্দ্রীয় বাহিনী সন্ত্রস্ত ভোটারদের ভোট দেওয়াতে নিয়ে যাচ্ছে। আমরাও আশা করি প্রশাসনের সাহায্য পাব।’’ কেউ তাঁদের সাহায্য করতে না এলেও তাঁরা ভোট দিতে যাবেন বলে জানিয়েছেন ওই বাসিন্দারা।
ভবানীপুরে বহুতলের বাসিন্দাদের যাঁরা হুমকি দিয়েছিলেন, তাঁরা পরিচিত মুখ। কিন্তু পার্ক সার্কাসের কাজী সাহেব হুমকি দিতে আসা যুবককে আগে দেখেননি বলেই জানিয়েছেন। এলাকায় সমাজবিরোধী এবং বাইক বাহিনীর বিরুদ্ধে হুমকি দেওয়া ও সন্ত্রাস ছড়ানোর অভিযোগ জানিয়েছেন বেহালা পূর্ব কেন্দ্রের নির্দল প্রার্থী অম্বিকেশ মহাপাত্র এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায়ও। সিইও-র কাছে তাঁদের অভিযোগ, অভিযোগ জানালেও হরিদেবপুর ও ঠাকুরপুকুর থানার ওসি সে সব খবর ফাঁস করে দিচ্ছেন। রিটার্নিং অফিসারকে বলেও লাভ হচ্ছে না।
কিন্তু এ সব হুমকিতে কতটা ভয় পাচ্ছেন ভোটারেরা? তাঁদের বেশির ভাগেরই মত, হুমকিতে পিছিয়ে এলে আগামী দিনে দুষ্কৃতীরা মাথায় চড়ে বসবে। যে ভাবে মার খেয়ে হাত ভাঙা কল্যাণীর শিক্ষক ও তাঁর স্ত্রী কিংবা হালিশহরে আক্রান্ত শিশুর মা প্রতিরোধ গড়ে ভোট দিয়েছেন, সেই পথে হেঁটেই আজ, শনিবার বুথে যাবেন তাঁরা। ভবানীপুর এলাকার এক ভোটারের বক্তব্য, ‘‘আমার ভোট আমিই দেব। ভয় পেয়ে ঘরে বসে থাকার কোনও মানে হয় না।’’
আর পার্ক সার্কাসের কাজী সাহেব বলছেন, ‘‘আমি দুপুরে ভোট দিতে যাব। দেখি কে আমায় আটকায়!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy