Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪

জোড়াফুলের বনে কে যেন বেলাইন

কদম-কদম এগোচ্ছিলেন তেরঙা পাড় আর জমিতে জোড়া ঘাসফুল তোলা শাড়ি পরা মহিলারা।কল্যাণী স্টেশন লাগোয়া রাস্তা ভাগ হয়ে দু’দিকে গিয়েছে। মহিলাদের মিছিল সটান ডান দিকে বাঁক নিল। রে-রে করে এগিয়ে গেল পিছনের পুরুষ মিছিল— ‘‘ও দিকে নয়, ও দিকে নয়। চলো সোজা রাস্তায়।’’

সুপ্রকাশ মণ্ডল
কল্যাণী শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০১৬ ০১:৪৩
Share: Save:

কদম-কদম এগোচ্ছিলেন তেরঙা পাড় আর জমিতে জোড়া ঘাসফুল তোলা শাড়ি পরা মহিলারা।

কল্যাণী স্টেশন লাগোয়া রাস্তা ভাগ হয়ে দু’দিকে গিয়েছে। মহিলাদের মিছিল সটান ডান দিকে বাঁক নিল। রে-রে করে এগিয়ে গেল পিছনের পুরুষ মিছিল— ‘‘ও দিকে নয়, ও দিকে নয়। চলো সোজা রাস্তায়।’’

ফিরল মিছিল। চলল সোজা রাস্তা ধরে। অনেক পিছনের ম্যাটাডরে বেঞ্চের উপরে তখন দাঁড়িয়ে কল্যাণী বিধানসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী রমেন্দ্রনাথ বিশ্বাস।

মাইকে ঘোষণা হচ্ছে, ‘‘কেউ অন্য দিকে যাবেন না। সবাই এক সঙ্গে হাঁটুন।’’ তবে কি অন্য দিকে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে? তালে-তালে এক সঙ্গে আর পড়ছে না পা?

এই কেন্দ্রের সব এলাকাই এক সময়ে চাকদহ বিধানসভার অন্তর্গত ছিল। তখন ঘোর বদনামও ছিল এই কেন্দ্রের। ২০০৬ পর্যন্ত বিধায়ক বাম জমানার উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী সত্যসাধন চক্রবর্তী। কিন্তু তাঁকে নাকি টুকে পাশ করতে হত! ভোট দেওয়া দূরের কথা, ভোটের দিন বিরোধী ভোটাররা বাড়ি থেকে বেরনোর সাহস পর্যন্ত দেখাতে পারতেন না, অভিযোগ বিরোধীদের।

২০০৬ সালে সাবেক চাকদহ কেন্দ্র থেকে কল্যাণী, গয়েশপুর, সগুনা, মদনপুরের মতো এলাকাগুলি বাদ পড়ে। ২০১১ সালে কোনও পক্ষই এই কেন্দ্রে সন্ত্রাসের অভিযোগ আনেনি। তৃণমূল ড্যাং-ড্যাং করে জেতে (কংগ্রেসের সঙ্গে তাদের জোট ছিল তখন)। তার পর থেকে যত ভোট হয়েছে, ঝোড়ো হাওয়ায় দুলেছে জোড়াফুল। পাশাপাশি, উঠেছে ভোট ছিনতাইয়ের অভিযোগও।

কল্যাণী বিধানসভা এলাকায় রয়েছে দু’টি পুরসভা— কল্যাণী ও গয়েশপুর। রয়েছে মদনপুর, সগুনার মতো দু’টি পঞ্চায়েত এলাকা। রয়েছে কাঁচরাপাড়া পঞ্চায়েতের একাংশ। দীর্ঘদিন ধরেই জেলার মধ্যে অন্যতম উত্তেজনাপ্রবণ এলাকা বলে চিহ্নিত গয়েশপুর। ২০০৫ সালে সিপিএম বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় গয়েশপুর পুরসভা দখল করেছিল। ২০১০ পর্যন্ত ওই পুরসভা ধরে রাখতে পেরেছিল তারা। দুষ্কৃতী দিয়ে রিগিংয়ের অভিযোগও উঠেছিল। ২০১৫ সালের পুরভোটে অবশ্য ছবিটা আমূল পাল্টে যায়। সিপিএম প্রার্থীই দিতে পারেনি। বিনা যুদ্ধেই বোর্ড গড়ে তৃণমূল।

এখন যা অবস্থা, তিনটি পুরসভার সব ক’টিই শাসক দলের পকেটে। সব পঞ্চায়েত তাদের দখলে। প্রার্থী বিদায়ী বিধায়ক। ২০১১ সালে যা-ও বা দু’পক্ষের প্রাপ্ত ভোটে ৯ শতাংশের ফারাক ছিল, ২০১৪-র লোকসভা ভোটে এসে তা প্রায় দ্বিগুণে দাঁড়ায়। অবস্থা এমনই দাঁড়ায় যে সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপি সকলের ভোট যোগ করলেও তৃণমূলের চেয়ে অনেকটাই পিছনে থাকে।

তবে আর বেলাইন হওয়ার ভয় কীসের? তৃণমূলের তো চোখ বুজে হরিনাম সংকীর্তন করার কথা!

সিপিএম শিবিরের দাবি, হিসেবচা অত সোজা নয়। উপরে-উপরে সব শান্ত দেখালেও ভিতরে চোরাস্রোত যে বইছে তা তৃণমূল নেতারাও ভাল করে জানেন। শনিবারই মদনপুরে তৃণমূল ছেড়ে সিপিএমের শরণে এসেছেন বেশ কিছু কর্মী। সিপিএম প্রার্থী তথা প্রাক্তন সাংসদ অলকেশ দাসের দাবি, অনেকেই তলায় তলায় তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। ভয় পাচ্ছেন অনেকে। তাঁদের বলা হচ্ছে, মিটিং-মিছিলে আসার দরকার নেই। ভোটটা দিলেই হবে।

একদফা প্রচার সেরে ভরদুপুরে কল্যাণী জোনাল অফিসে বসে খাওয়া সারছিলেন দু’বারের সাংসদ অলকেশ বলেন, ‘‘পুরো এলাকা চষে ফেলেছি। ইতিমধ্যে চারশো কিলোমিটারের বেশি হাঁটা হয়ে গিয়েছে। যেখানেই যাচ্ছি, মানুষ বলছেন, ভোট দিতে পারলে আমাদেরই সমর্থন করবেন।’’ তাঁর দাবি, এই পাঁচ বছরে সর্বত্রই মানুষ আঙুল ফুলে কলাগাছে হতে দেখেছেন। দেখেছেন, কল্যাণী শহর ও তার আশপাশে অবৈধ জমি, মাটি, বালির কারবারে কী ভাবে তৃণমূলের লোকেরা জড়িয়েছে, নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ে কী ভাবে অশান্ত করেছে গোটা এলাকা। মানুষ বীতশ্রদ্ধ।

শিল্প আনতে ব্যর্থতাও কল্যাণী শিল্পাঞ্চলে তৃণমূলের বিরুদ্ধে যাবে বলে মনে করছে জোট শিবির। গত বিধানসভার প্রচারেও তৃণমূল নিয়ম করে বলত, ক্ষমতায় এলে তারা কল্যাণীতে শিল্পের জোয়ার এনে দেবে। কিন্তু মার্কশিটে একটি মস্ত ঢ্যাঁড়া। গত পাঁচ বছরে কল্যাণীতে নতুন করে একটি কারখানাও তৈরি হয়নি। খোলেনি বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার দরজা। বরং বন্ধ হয়েছে স্পিনিং মিলের মতো সরকারি সংস্থার ঝাঁপ। নিজেদের আশ্বাসই এখন হুল হয়ে বিঁধছে তৃণমূলকে।

তা হলে তৃণমূল প্রার্থী কী ভাবে জোর দিয়ে বলছেন, তিনি জিতছেনই? অলকেশের কটাক্ষ, ‘‘কল্যাণীতে উনি এখন পিতামহ ভীষ্মের ভূমিকায়। অসহায় হয়ে নিজের লোকেদেরই ক্ষমতা দখলের লড়াই দেখছেন!’’ কম ক্ষমতা সত্ত্বেও কংগ্রেসও কিছুটা রান পাবে বলে তাঁদের আশা। সিপিএম নেতারা বলছেন, কংগ্রেস নেতাদের আন্তরিকতা দেখার মতো। সকাল থেকে রাত তাঁরা এক সঙ্গে প্রচার করছেন, কোনও প্রত্যাশা ছাড়াই।

পচাঁত্তরে পা দেওয়া রমেন্দ্রনাথ এই সব অর্বাচীনদের আমল দিতে নারাজ। তা বলে প্রচারে একটুও ফাঁকি নেই তাঁর। প্রতি দিন নিয়ম করে চষছেন এক এলাকা থেকে আর এক এলাকা। প্রতিটি সভায় নিয়ম করে জানাচ্ছেন, বাস স্ট্যান্ড থেকে অটো স্ট্যান্ড, স্কুল-কলেজ, শ্মশান থেকে বিসর্জনের ঘাট— বিধায়ক কোটার টাকায় কী কী করেছেন তার ফিরিস্তি দিচ্ছেন। বলছেন, ‘‘আমার পুরো এলাকা ঘোরা হয়ে গিয়েছে। এলাকার মানুষের সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ। আশা করি, তাঁরা আমায় নিরাশ করবেন না।’’

শনিবার বিকেলে সগুনা বাজারের রাস্তা পেরোচ্ছিল তৃণমূলের মিছিল। মাইকে বারবার ঘোষণা হচ্ছে—‘‘আমাদের প্রার্থীকে ভোট দিন। ১৯ মে আবার আপনাদের সামনে দিয়ে এই ভাবেই বিজয় মিছিল করব।’’

শুনে, পাশে চায়ের দোকানে বসে ভুরু কোঁচকান এক প্রৌঢ়। বিড়বিড় করে বলেন, ‘‘তবে যে দিদি বলেন, জিতলে বিজয় মিছিল হবে না? খালি রবীন্দ্র সঙ্গীত বাজবে! এদের দেখছি, কথায় কাজে মিল নেই!’’

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016 Kalayani
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy