ভোটের হাওয়ায় এখন পুরস্কারের ঘ্রাণও!
দক্ষিণ দিনাজপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শিলিগুড়ি শহর, পুরস্কারের ইশারা অনেক জায়গাতেই স্পষ্ট। কোথাও ঝাঁ চকচকে মোবাইল মিলতে পারে। আবার কোথাও মিলতে পারে বাইক। কোথাও আবার এলইডি পৌঁছে যাবে বুথ নেতার ঘরে। আর কোনও বিধানসভায় ভাল ফল হলে, লটারি মেলার মতো ভাগ্য খুলে যাওয়ার সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে। সে ক্ষেত্রে আস্ত চার চাকার গাড়ি মিলতে পারে।
ভোট-বাজারে কান পাতলে ছোট-বড় কিছু নেতা বাতাসে কী ছড়িয়ে ভোট করানোয় নেমেছেন, তা বোঝা যায়। কোথাও মিলতে পারে ঠিকাদারির লাইসেন্স। কোথাও জুটতে পারে চুক্তি ভিত্তিক চাকরিও।
মালদহের এক নেতা তো আগাম হিসেবে মোবাইলও দিয়েছেন কয়েকজনকে। নতুন সেই স্মার্ট ফোন দেখিয়ে ‘ভোট-টানিয়ে’রা ফিসফিসিয়ে জানান, বুথে ঠিকঠাক লিড হলে ঠিকাদারির কাজও মিলবে। মালদহের আর এক নেতা তো, জাতীয় সড়কের ধারে ধাবা খোলার সব ব্যবস্থা করে দেওয়ার টোপও ছেড়েছেন বাজারে। দক্ষিণ দিনাজপুরের এক নেতা টোটো কিনে দেবেন বলে জানিয়ে রেখেছেন। আগাম হিসেবে কিছু নগদও দিয়েছেন বলে এক ‘ভোট-টানিয়ে’ দাবি করলেন। সেই দিনাজপুরের আর এক নেতার কাছে প্রত্যন্ত গ্রামের এক ভোট-টানিয়ে দাবি করেছেন, তাঁর একটা অটো চাই।
বলাই বাহুল্য সব রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেই পুরস্কারের কথা শুনে নেতারা তীব্র স্বরে বিরোধিতা করেছেন। তাঁদের একটাই কথা, ‘‘এ সব আমাদের দলের রেওয়াজ নয়। আমাদের কর্মীরা নীতি-আদর্শের জন্য পরিশ্রম করেন। একটা টাকাও নেন না। ভোটের কাজ করে বলে কর্মীদের দিকে আমাদেরও খেয়াল রাখতে হয়। সেটাকে পুরস্কার বলাটা ঠিক হবে না।’’
তা হলে এমনি এমনিই রটছে? কোনও কোনও পার্টি অফিসে গেলে কেন আলোচনা শোনা যাচ্ছে, আগের কোনও ভোটে ঠিকঠাক ‘লিড’ দিয়ে অমুকে কত কামিয়েছে, তমুকে পুরসভায় চুক্তিভিত্তিক চাকরি পেয়েছে। তবে শুধু পুরস্কার নয়, দলের প্রার্থী পিছিয়ে থাকলে রয়েছে তিরস্কারের শঙ্কাও। নানা দলের নেতা-কর্মীদের একাংশের সুবাদে যে সব তথ্য সামনে উঠে এসেছে তা এরকম:
লিড দাও, পুরস্কার নাও
গত পুরসভায় শিলিগুড়িতে কয়েকটি ওয়ার্ডে ‘লিড’-যাতে হয় সে জন্য বিশাল পরিশ্রম করেছিলেন কয়েকজন। হাতে হাতে মিলেছে পুরস্কার। কয়েকজন ঠিকাদারি লাইসেন্স পেয়েছেন। কয়েকজন চুক্তির ভিত্তিতে কাজ পেয়েছেন। বাকিদের নানা ভাবে কাজে যোগ দেওয়ানোর চেষ্টাও চলছে।
মিলেছে জার্সি গাই
কোচবিহারের এক সীমান্ত গ্রামের কথা। সেখানে পঞ্চায়েতের চারটি বুথে ব্যবধান বাড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্য হাসিল করেছিলেন এক লড়াকু চাষি। তাঁর অনেক দিনের স্বপ্ন ছিল, একটি ছোট খাটাল করা। তা সত্যি হয়েছে। নেতারা টাকা দিয়ে ৩টি জার্সি গরু কিনে দিয়েছেন। এখন সাইকেলে করে দুধ বিলি করে অনেকটাই অবস্থা ফিরেছে তাঁর। এ বারের ভোট প্রচারেও মিছিলের সামনেই দেখা যাচ্ছে তাঁকে। বাইকে চেপে দুধ বিলি করলে সময়ও বাঁচবে, বাড়বে আয়ও। আপাতত বাইকের স্বপ্নেই ভোটের কাজে জান-মান লড়িয়েছেন তিনি।
টোটোর লাইসেন্স
শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি দুই শহরের রাস্তাতেই টোটো-র বড্ড ভিড়। জলপাইগুড়ি শহরে তো টোটোর সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। টোটো চালকেরা এবং তাঁদের পরিবারের ভোট যোগ করলে, সংখ্যা নেহাত মন্দ নেই। কিন্তু সমস্যা হল, টোটো রুটের লাইসেন্স নেই কারও। জলপাইগুড়িতে গত পুরসভায় এক এক শ্রমিক সংগঠনের নেতা নিজের পাড়ার ভোট করিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। ভোটের ফলে পাড়ায় তাঁর দল এগিয়ে থাকায় পুরস্কার পেয়েছেন দলের নাম প্রতীক দেওয়া বিশেষ স্টিকার। সেই স্টিকার তিনি বাছাই করা টোটো চালকদের দিচ্ছেন। সেই চালকদের এখন পুলিশি হয়রানি পোহাতে হয় না। সংগঠনের এক নেতার কথায়, স্টিকারগুলি কিন্তু নেহাতই সস্তা নয়।
পার্কিঙের অনুমতি
জলপাইগুড়ি শহর লাগোয়া একটি মন্দিরের সামনে পার্কিঙের ইজারা নিয়ে বড্ড দর কষাকষি চলে। যদিও বছর দু’য়েক আগের পঞ্চায়েতে ভোটে গ্রামে দলের হারের পরে, ডাক পড়ে ‘বসে’ যাওয়া এক নেতার। এক জেলা নেতা শর্ত দেন, পঞ্চায়েত সদস্যদের ভাঙিয়ে বোর্ড আনতে পারলে, পুরস্কার মিলবে। দর কষাকষিতে দড় সেই বসে যাওয়া নেতা বছর খানেকের মধ্যেই নিজেদের দখলে বোর্ড আনেন। পুরস্কারে মেলে সেই মন্দিরের পার্কিঙের ইজারা। পার্টি-কর্মীরা বলেন, এ তো এক ধরনের জেতা, এ ও তো পুরস্কার বটে।
বিল্ডিং প্ল্যান? পাশ পাশ
স্থানীয় কাউন্সিলর বেঁকে বসায় জমি পেয়েও বাড়ি তুলতে পারছিলেন না সদস্য প্রোমোটারিতে হাতেখড়ি দেওয়া দুই যুবক। বাড়ির নকশা না বদলালে সেই কাউন্সিলর কিছুতেই অনুমতি দেবেন না বলে জানিয়ে দেন। কাউন্সিলরের দলের বড় নেতাকে ধরেও কোনও কাজ হয়নি। জলপাইগুড়ি শহরের ওই দুই যুবক হতাশ হয়ে পড়েন। যদিও, গত বছরের পুরভোটের আগে সেই কাউন্সিলরই তাদের ডেকে পাড়ার দুই গলির প্রচারের খরচ থেকে বাড়ি বাড়ি জনসংযোগের দায়িত্ব দেন। ভোটের ফলে দেখা যায়, মুখ রেখেছে দুই পাড়া। মিলে যায় বাড়ির নকশার অনুমতিও। এখন এলাকারই আরও একটি জমিতে প্রোমোটিং শুরু করেছেন দুই যুবক।
পিছোলে টিকিট নয়
সদ্য পুরভোট শেষ হয়েছে শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি দুই শহরে। বিধানসভা ভোটে নিজেদের ওয়ার্ডে লিড দিতে না পারলে, আগামীবারের পুরভোটে ওয়ার্ডের টিকিট মিলবে না বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে একটি দলের কাউন্সিলরদের। সেই কাউন্সিলররা এখন নিজেদের পদ বাঁচাতেই দুপুর-সন্ধ্যে চষে ফেলছেন নিজের ওয়ার্ড। কে জানে, বিধানসভার পাকে পড়ে পুরসভা না হাতছাড়া হয়।
ওয়ার্ডে না থাকলে বাদ
পুরভোটে হেরেছেন যাঁরা, তাঁদের মাথাতেও ঝুলছে শাস্তির খাঁড়া। এই তো দিন কয়েক আগে জলপাইগুড়িতে দলের ওয়ার্ডের নেতা-কর্মীদের নিয়ে বৈঠক হয়েছিল। সেই বৈঠকেই বিধানসভা কেন্দ্রের দলের পর্যবেক্ষক সাফ জানিয়েছেন, যাঁরা পুরভোটে হেরেছেন, তাঁদেরই ওয়ার্ডের বিধানসভায় লিডের দায়িত্ব নিতে হবে। লিড না পেলে আগামী পুরভোটের সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা থেকে নাম বাদ যাবে তাঁর।
বদলির তালিকাও হচ্ছে
বদলির হুমকিতে মিল রয়েছে কোচবিহার-জলপাইগুড়ি-আলিপুরদুয়ারে। কলকাতা থেকে আসা নেতা তিন জেলার প্রাথমিক শিক্ষক সংগঠনের নেতাদের ডেকে সভা করেছেন। বলে গিয়েছেন, ভোটের ফল আশানুরূপ না হলে, পদ খোয়াতে হতে পারে। তাই এখন জেলা নেতারা সংগঠনের সদস্যদের জানাতে ভুলছেন না, বদলির সিদ্ধান্ত স্থানীয় ভাবেই নেওয়া হয় এবং ভোটের পরে বদলির তালিকাও তৈরি হবে।
অঙ্কণ: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy