হরিণঘাটায় পুড়ে খাক সিপিএম প্রার্থীর পোলিং এজেন্টের বাড়ি। —নিজস্ব চিত্র।
একতরফা মার থেকে বাঁচতে ‘প্রতিরোধ’ করার রাস্তা নিয়েছিলেন ওঁরা।
যাঁরা প্রতিরোধ করছেন, তাঁদের উপরে প্রতিশোধ নিতে শুরু করে দিয়েছে আতঙ্কে দিশেহারা তৃণমূল। তবে প্রতিশোধ নিতে গিয়ে পাল্টা মার খেয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে।
শুক্রবার সিপিএমের প্রাক্তন মন্ত্রী বঙ্কিম ঘোষ, প্রাক্তন বিধায়ক ননী মালাকার-সহ জোটের সাত নেতা যেমন মার খেয়েছেন, চড়থাপ্পড়-ঘুষি খেয়েছেন তৃণমূলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা চঞ্চল দেবনাথও। হরিণঘাটা থানায় জোটকর্মীদের বিক্ষোভ হাজির হয়ে দু’কথা শোনাতে গিয়েছিলেন তিনি। নদিয়া জেলা পরিষদ সদস্য চঞ্চলের আক্ষেপ, ‘‘বামেদের ভরা বাজারেও ওদের হাতে মার খেতে হয়নি। আজ খেতে হল!’’
দাপুটে তৃণমূল নেতার এই কথাই আসলে বুঝিয়ে দিচ্ছে, পরিস্থিতি কতটা অগ্নিগর্ভ। জমি হারাতে থাকা তৃণমূল যত বদলা নিতে চেষ্টা করছে, বাম-কংগ্রেস জোটের কর্মীরাও তত মরিয়া হয়ে রুখে দাঁড়াচ্ছেন। এক সময়ে বসে যাওয়া সিপিএম কর্মীরা ময়দানে ফিরতে শুরু করাতেও ধৈর্য হারাচ্ছে ভৈরব বাহিনী। যে সব জায়গায় ভোট হয়ে গিয়েছে সেখানে যেমন, যেখানে ভোট এগিয়ে আসছে, সে সব এলাকাতেও একই ছবি।
বৃহস্পতিবার ভোট শুরু হতেই নদিয়ার কল্যাণী ও চাকদহ বিধানসভা এলাকায় ভয় দেখানো, মারধরের রাস্তা নিয়েছিল তৃণমূল। তা সত্ত্বেও বহু মানুষ বেরিয়ে এসে ভোট দিয়েছেন। মেরে হাত ভেঙে দেওয়া সত্ত্বেও সস্ত্রীক ভোট দিয়ে এসেছেন শিক্ষক। দলবদ্ধ ভাবে ভোট দিয়েছেন মহিলারাও। তাতে তৃণমূলের ভৈরব বাহিনীর রাগ আরও বেড়েছে।
ভোট মিটতেই শুরু হয়েছে বদলা নেওয়ার পালা। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে হরিণঘাটায় সিপিএম প্রার্থীর এজেন্টের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। সুকুর আলি নামে ওই এজেন্ট স্থানীয় নগরউখড়া-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের কংগ্রেস নেতা। বাড়ি পারুলিয়া গ্রামে। রাত ১টা নাগাদ দমবন্ধ হয়ে কাশতে-কাশতে ঘুম ভেঙে উঠে তিনি দেখেন, ঘর জ্বলছে। কোনও রকমে স্ত্রী আর ১৩ বছরের ছেলে সাহিনকে নিয়ে টালির চালের মাটির বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি। কিন্তু জিনিসপত্র কিছু বের করে আনতে পারেননি। চোখের সামনেই সব ছাই হয়ে যায়।
ঘটনার জেরে সকাল থেকে গোটা এলাকা অশান্ত হয়ে ওঠে। পারুলিয়ায় অবরোধ করা হয় হরিণঘাটা-হাবরা রাজ্য সড়ক। পরে হরিণঘাটা থানায় যান সিপিএম ও কংগ্রেসের স্থানীয় নেতারা। শ’চারেক মানুষ অবরোধ- বিক্ষোভে সামিল হন। এরই মধ্যে জোটের হাতে তাঁদের দুই কর্মীর মার খাওয়ার অভিযোগ জানাতে থানায় এসে পৌঁছন চঞ্চলবাবু।
প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, চঞ্চলবাবু এসেই সিপিএমের জেলা পরিষদ সদস্য নারায়ণ দাসকে ডেকে ধমকে বলেন, ‘‘তোমাদের আমলেও তো আমাদের অনেক ঘরবাড়ি পুড়িয়েছ। তখন কী হয়েছিল?’’ তিনি সম্ভবত বোঝেননি, আগে যারা চোখরাঙানি দেখে সিঁটিয়ে যেত, এখন তারা পাল্টা দিচ্ছে। বুঝে ওঠার আগেই চড়-ঘুষি খেয়ে যান তিনি। পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে ভিতরে নিয়ে যায়। লাঠি চালিয়ে জনতাকে হটিয়েও দেয় তারা। জনা পনেরোকে আটকে করা হয়।
বঙ্কিমবাবুরা অভিযোগপত্র লেখার জন্য হরিণঘাটার প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক ননী মালাকারের বাড়িতে গিয়েছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে জনা চল্লিশ তৃণমূল কর্মী-সমর্থক সেখানে হামলা করে। বঙ্কিমবাবুরা একটি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেন। তৃণমূলের বাহিনী জানালা ভেঙে ঘরে ঢুকে লাঠি দিয়ে তাঁদের এলোপাথাড়ি মারে। মাথায় লাঠি লেগে লুটিয়ে পড়েন হরিণঘাটা-৪ লোকাল সদস্য নারায়ণ সরকার। ইট দিয়ে মারা হয় বঙ্কিমবাবুকে। তাঁর কথায়, ‘‘কোনও রকমে মাথাটা আড়াল করতে না হলে ওরা আমায় মেরেই ফেলত।’’
এর মধ্যে পুলিশে খবর গিয়েছিল। পুলিশ গিয়ে আহতদের কল্যাণী জেএনএম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে কল্যাণী থানায় আনা হয় নেতাদের। থানায় বসেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন নারায়ণ সরকার। অসুস্থ বোধ করতে থাকেন বঙ্কিমবাবুও। তাঁদের একটি স্থানীয় নার্সিংহোমে ভর্তি করানো হয়। তবে বঙ্কিমবাবু-সহ সাত জোটের নেতার নামে অভিযোগ দায়ের হয়েছে, যেমন হয়েছে চঞ্চলবাবুর নামেও।
গত মঙ্গলবার উত্তর ২৪ পরগনার শাসন লাগোয়া কীর্তিপুর এলাকায় তৃণমূলের হামলায় জখম হয়ে মারা গিয়েছেন সিপিএমের নুর ইসলাম মিস্ত্রি। গত বিধানসভা ভোটের পরে তিনি রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। এলাকা ছেড়েও চলে গিয়েছিলেন। কিছু দিন ফিরে জোটের হয়ে প্রচারে মানতেই নিশানা হয়ে যান। এই খুনের প্রতিবাদে সভা করায় এ দিন আক্রান্ত হলেন ৬২ বছর বয়সী সিপিএম নেতা মহাদেব ঘোষ। সকালে বারাসত ২ নম্বর ব্লক অফিস সংলগ্ন দলীয় অফিস খুলে পরিষ্কার করে কীর্তিপুরের বাড়িতে ফিরছিলেন মহাদেববাবু। পথে কীর্তিপুর ১ নম্বর পঞ্চায়েতের তৃণমূলের প্রধান মোকাজ্জেল আলি, মান্নান আলি এবং তাঁদের দলবল তাঁকে বেধড়ক মারধর করে বলে অভিযোগ। বারাসত ২ পঞ্চায়েত সমিতির তৃণমূল সদস্য মান্নান আলিকে পুলিশ ধরেছে।
সকালে হাওড়ার জয়পুরে খালনা এলাকায় নবকুমার দাস নামে এক সিপিএম কর্মী মার খান। প্রচারের কাজ সেরে বাড়ি ফেরার সময়ে তৃণমূলের লোকজন তাঁর উপরে চড়াও হয় বলে অভিযোগ। রাত ৮টা নাগাদ আবার নদিয়ারই কৃষ্ণগঞ্জে এক সিপিএম সমর্থকের বাড়িতে চড়াও হয়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপায় তৃণমূলের লোকজন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাঁকে কৃষ্ণগঞ্জ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy