Advertisement
২৭ নভেম্বর ২০২৪

পার্টির টানে দাদার গড়ে কোমর বেঁধেছেন বৌদি

কর্তার ইচ্ছায় কর্ম হয়। কিন্তু কর্মের ইচ্ছা তো কর্ত্রীরও হতে পারে! ইচ্ছা তাঁর হয়। এবং হলে তিনি একাই কাফি! ব্যাকরণ মেনেই!

ব্যস্ততার ফাঁকে বৌদির যত্নে। বেলদা সিপিএম কার্যালয়ে। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল

ব্যস্ততার ফাঁকে বৌদির যত্নে। বেলদা সিপিএম কার্যালয়ে। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল

সন্দীপন চক্রবর্তী
নারায়ণগড় শেষ আপডেট: ৩১ মার্চ ২০১৬ ০৩:৫০
Share: Save:

কর্তার ইচ্ছায় কর্ম হয়। কিন্তু কর্মের ইচ্ছা তো কর্ত্রীরও হতে পারে! ইচ্ছা তাঁর হয়। এবং হলে তিনি একাই কাফি! ব্যাকরণ মেনেই!

কাশীপুরের মাঠে ছোট্ট মঞ্চের দিকে পিছন ফিরে একটা চেয়ার টেনে বসে আছেন তিনি। আটপৌরে শাড়ি, মুখে হাসি। দমকা হাওয়ায় বারবার লুটিয়ে পড়ছে পলিথিনের চাঁদোয়া। বাগে আনতে না পেরে শেষ পর্যন্ত চাঁদোয়া মাটিতে নেমে এসেছে চাটাই হয়ে! আদিবাসী মহিলাদের নিয়ে ধামসা-মদল সহযোগে মিছিল ঢুকছে মাঠে। বারবার এগিয়ে গিয়ে তিনিই স্থানীয় উদ্যোক্তাদের বলছেন, ওঁদের বসার ব্যবস্থা করতে।

মঞ্চে কর্ডলেস মাইক্রোফোন হাতে ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছেন প্রধান বক্তা। কিন্তু গলা জুতে আসছে না! চেষ্টা করছেন, বোঝাই যাচ্ছে। নীচের চেয়ার থেকে ছিটকে আসছে স্বগতোক্তিটা— ‘‘গলাটা পড়ে গিয়েছে! এত বললে তো হবেই!’’

প্রচারের ঠাসা কর্মসূচির ফাঁকে বেলদা জোনাল কার্যালয়ের এক তলায় দুপুরের খাওয়া। হেভিওয়েট নেতা এবং তাঁর গুটিকয়েক অতিথি এসেছেন বলেই ঘরোয়া আসরেও একটু বেশি যত্নের ছোঁয়া। পরিবেশন নিজের হাতে তো করেছেনই। খাওয়া মিটতে না মিটতেই আটপৌরে শাড়ি হাসি মুখেই পৌঁছে গিয়েছেন রান্নাঘরে। থালা নিয়ে এগোচ্ছেন সিঙ্কের দিকে। দলীয় কার্যালয়ের সর্বক্ষণের কর্মী বাধা দিতে গিয়ে সস্নেহ ধমক খাচ্ছেন। ‘‘একা হাতে আর কত করবি? আমি একটু হাত লাগালে কী হয়েছে?’’

এ বার তা হলে রহস্যের পর্দা তুলেই নেওয়া যাক! আটপৌরে শাড়ির আঁচলটা কোমরে গুঁজে যিনি তদারকি করছেন, তাঁরই নাম ঊষা মিশ্র। পরিচয়? সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রের সহধর্মিণী। মানে রাজ্য সিপিএমের ফার্স্ট লে়ডি! তা-ই বলে কলকাতা থেকে ট্রেন এবং বাস ধরে নারায়ণগড় পৌঁছে যেতে তাঁর বাধে না। পার্টি অফিসের রান্নাঘরে বাসন ধুয়ে দিতে আটকায় না। আবার নারায়ণগড়ের প্রার্থীর জন্য একেবারে ঘরোয়া জনসংযোগের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতেও কোনও সমস্যা নেই। সবই নিজের ইচ্ছায়!

সিপিএমের অন্দর মহল থেকে মাঝেমধ্যে দাদা-বৌদির গল্প বেরিয়েছে। কিন্তু সে সব ভারী তত্ত্বের এবং রাজনৈতিক কৌশলের লড়াইয়ের গল্প। প্রকাশ ও বৃন্দা কারাটকে সে কারণেই সম্ভ্রম নিয়ে দেখে গোটা দল। এই দাদা-বৌদির কাহিনির সঙ্গে তার কোনও মিল নেই। এই বৌদির চারপাশে কোনও জ্যোতির্বলয় নেই। কোনও দিন ছিলও না। সাধারণ পার্টিকর্মী হিসাবে দাদার হস্তক্ষেপ ছাড়াই কাজ করে যেতে তিনি অভ্যস্ত। দাদা দলের রাজ্য সম্পাদক হয়ে যাওয়ার পরেও সে অভ্যাস থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার কোনও প্রয়াস নেই।

নারায়ণগড়ে লোকসভা বা পঞ্চায়েত ভোট হোক, ঘাঁটি গেড়ে ঊষাদেবী থাকবেন। তবু এ বারের থাকাটা অন্য রকম। এই নারায়ণগড়েই স্কুল, বৃদ্ধাবাস এবং বেসরকারি সংস্থা চালান তিনি। সূর্যবাবু বিরোধী দলনেতা হওয়ার সময় থেকেই তাঁকে ঘোড়া থেকে ফেলতে তাঁর ঘরে হানা দিয়েছিল তৃণমূল সরকার! ঊষাদেবীর সেই সংস্থাকে জড়িয়ে আনা হয়েছিল দুর্নীতির অভিযোগ। পাঁচ বছর ধরে পিছনে লেগে রয়েছে সিআইডি। মোক্ষম নানা মুহূর্তে সেই অভিযোগ নিয়ে হুঁশিয়ারি আসে সূর্যবাবুর জন্য! গত বছর ফেব্রুয়ারিতে সিপিএমের রাজ্য সম্মেলনে তাঁর রাজ্য সম্পাদক হওয়ার সময়টায় যেমন হইচই, তল্লাশি শুরু হয়েছিল। সেই তল্লাশি-তদন্তের অকুস্থল নারায়ণগড়েই ফের প্রার্থী হয়েছেন কর্তা। আর ঘাঁটি আগলে গিন্নির পড়ে থাকার মধ্যেও এ বার যেন অনুচ্চারিত একটা বিবৃতি আছে— একই ময়দানে একই ভাবে আছি। পারলে বধ করে দেখাও!

দাদা বলছেন, ‘‘আমরা তো বসেই আছি জেলে যাব বলে! অভিযোগ প্রমাণ করুক না, নিয়ে যাক জেলে!’’ আর বৌদি মানতেই নারাজ যে, তিনি বিশেষ কিছু করছেন। তাঁর কথায়, ‘‘আমি এখানকার ভোটার, এখানকার কর্মী। সূর্যবাবুর সারা রাজ্যে কাজ আছে। আমি এখানেই আছি।’’ সূর্যবাবূ দৌড়ে বেড়াচ্ছেন জেলায় জেলায়। তার মাঝে অল্প সময় বার করে নারায়ণগড়। আর ভোটটা না মেটা পর্যন্ত ঊষাদেবীর ঠিকানা নারায়ণগড়ের খাকুরদা। সূর্যবাবুর বয়ানে, ‘‘আমি সম্পাদক তো কী হয়েছে! আমাদের পার্টিতে নির্দিষ্ট ভাবে দায়িত্ব নিতে হয়, চিঠি দিয়ে জানাতে হয়। ও (ঊষাদেবী) সে ভাবেই এখানে এসেছে।’’

সমস্ত বাধা একের পর এক অতিক্রম করে রাজ্য সম্পাদক নিজে দায়িত্ব নিয়ে বামেদের পাশে কংগ্রেসকে টেনে এনেছেন। ভোট যত কাছে আসছে, প্রচারে আগ্রাসনকে উচ্চ থেকে উচ্চতর মাত্রায় তুলে নিয়ে যাচ্ছেন। তবু নারায়ণগড়ে সামান্য সময়েই যুগলবন্দিটা অন্য রকম! রাজ্য সম্পাদক আসবেন বলে নারায়ণগড়ে প্রচারের অন্যতম ভারপ্রাপ্ত নেতা ভাস্কর দত্ত নিজের গাছ থেকে দু’টুকরো আম নিয়ে এসেছিলেন। পরিবেশনে বৌদির হাতে পড়তেই তিনি বলে দিলেন, ‘‘এটা সূর্যবাবুকে দেওয়া যাবে না! যে নিরামিষ খাচ্ছে, তাকে দেব।’’ আম চলে গেল অতিথি এক সাংবাদিকের পাতে! আবার দই নিতে অনিচ্ছুক দাদাকে বলা হল, ‘‘গরমে দইটা দরকার। নাও না একটু!’’ দাদার থালায় দই ঢেলে দিল বৌদির হাতই।

যুগলবন্দিটা আসলে এই রকমই। পক্ষপাতিত্ব নেই! ভালবাসা আছে!

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy