সোহম চক্রবর্তী
পরিচালক, ক্যামেরাম্যান, সহনায়িকা সামলেছেন অনেক। ফিল্মের দুনিয়ার সঙ্গে পরিচয় সেই ছোট্ট বয়স থেকে। কিন্তু, ভোটের লড়াইয়ে নেমে যে ‘মহাকাল’ সামলাতে হবে, তা ভাবেননি সোহম চক্রবর্তী!
বাঁকুড়ার যে আসনে এ বার বাংলা ছবির এই নায়ককে প্রার্থী করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সেই বড়জোড়ায় মহাকাল অর্থাৎ, হাতির সমস্যা এক নম্বরে। ফলে, তৃণমূলের তারকা প্রার্থীকেও হাতি-হোমওয়ার্ক সারতে হয়েছে। কিন্তু, হাতি সমস্যা মানে তো মাঠে নেমে হাতি তাড়ানো নয়। বরং বোঝায় হাতিকে ঘিরে রাজনীতি। এবং আরও অনেক কিছুই।
এই ‘অনেক কিছু’ আসলে কী, বিস্তর কাঠখড় পুড়িয়ে তার উত্তর মিলল সনাতন মাকুড়ের কাছ থেকে। বছর খানেক আগে তাঁর দেড় বিঘে জমির ধান পায়ে মাড়িয়ে নষ্ট করেছিল হাতির পাল। তাঁর কাছে প্রশ্ন ছিল, হাতির হামলার ক্ষতিপূরণ আপনি না পেয়ে কি শাসকদলের লোকজন পেয়েছে? এমন কিছু কূট প্রশ্ন নয়। নেহাতই নিরীহ। সেই প্রশ্নের জবাব দিতেও অনেক ভাবতে হল বড়জোড়া ব্লকেরই জঙ্গল ঘেঁষা এক গ্রামের ওই বাসিন্দাকে। চাপাচাপির পরে জানালেন, ক্ষতিপূরণের জন্য তিনি আবেদন করেছিলেন বন দফতরে। কর্মীরা তাঁর জমি দেখেও গিয়েছিলেন। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত ক্ষতিপূরণটা জোটেনি।
কেন? গলার স্বরটা নেমে এল খাদে, ‘‘কেন খোঁচাচ্ছেন বলুন তো? আমি একা নই, গ্রামের অনেক ক্ষতিগ্রস্তই ক্ষতিপূরণ পায়নি। অথচ এমন কিছু লোক ক্ষতিপূরণের টাকা পেল, যাদের ক্ষতি হয়নি।’’ তা হলে পেলটা কারা? ‘‘তৃণমূলের লোকেরা পেয়েছে! এ আর নতুন কী!’’—আর কথা বাড়ালেন না তিনি।
সনাতন এখানে উদাহরণ মাত্র। হাতির হামলার ক্ষতিপূরণ নিয়ে এই রাজনীতি ঠিক এতটাই বাস্তব বড়জোড়ায়! বিরোধীরাও নিজেদের ভোটের প্রচারে ক্ষতিপূরণ পাইয়ে দেওয়ার নামে শাসকদলের নেতা-কর্মীদের একাংশের কাটমানি খাওয়ার প্রসঙ্গ তুলছেন। ফলে, সেই বাস্তবও সামলাতে হবে সোহমকে। তাঁর কথায়, “ভোটে জিতলে বড়জোড়ার এই সমস্যা মেটাতে যা করার নিশ্চয় করব।’’
শুধুই বড়জোড়া নয়, বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর, পাত্রসায়র, সোনামুখী কিংবা পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতা, গোয়ালতোড়, শালবনি, নয়াগ্রাম ব্লকের বিস্তীর্ণ তল্লাটে হাতি মানেই মূর্তিমান বিপদ! ফি-বছর হাতির দলের হানায় মৃত্যুর বহর বাড়ছে। এবং হাতিও তাই আজ ভোট-রাজনীতির হাতিয়ার। যার সাম্প্রতিক নিদর্শন মিলেছে বর্ধমানে। বাঁকুড়া থেকে দামোদর পেরিয়ে ঢুকে পড়েছিল দু’টি হাতি। লোকজন নাগাড়ে উত্ত্যক্ত করায় একটা সময় খেপে গিয়ে আছড়ে মারে পাঁচ জনকে। গ্রামবাসীর ক্ষোভ চড়চড় করে বাড়ছিল গলসি, ভাতার, মন্তেশ্বরে। ভোটের বাজারে বিপদ বাড়াতে চাননি তৃণমূল নেতারা। অভিযোগ, তাঁদের চাপেই পরের পর ঘুমপাড়ানি গুলি ফুঁড়ে মেরে ফেলা হয় একটি পূর্ণবয়স্ক হাতিকে। বাঁকুড়ার এক তৃণমূল নেতা স্পষ্ট বলে দিচ্ছেন, ‘‘একটা হাতি মারলে যদি অনেক ভোট সুরক্ষিত করা যায়, তা হলে সেটাই করতে হবে! সবটাই রাজনীতির অঙ্ক!’’
হাতির হানায় ক্ষয়ক্ষতিও সেই রাজনীতিরই শিকার। বন্যাত্রাণ নিয়ে রাজনীতি এ রাজ্যে নতুন নয়। কিন্তু, হাতির হানায় মৃত্যু কিংবা ফসলের ক্ষয়ক্ষতির আড়ালে যে কী ভাবে শাসকদল ফায়দা লোটে, সে-সব গল্প বেশির ভাগ সময়েই চাপা পড়ে থাকে। ক্ষতিপূরণ পাওয়া অনেকেই জানাচ্ছেন, শাসকদলের নেতাদের পরামর্শ মতো তাঁদের কিছু টাকা ‘কাটমানি’ দিলেই ক্ষতিপূরণের অঙ্ক চড় চড় করে বেড়ে যায়। আকারে বড় হলেও হাতি তাই রাজনীতির বোড়ে।
সোহম কিন্তু স্পষ্ট বলছেন, ‘‘অভিযোগ সত্যি হলে দলনেত্রীকে জানিয়ে কাটমানি প্রথাটাই তুলে দেব! এমন ব্যবস্থা নেব, যাতে হকের টাকা থেকে কাটমানি নেওয়ার আগে সবাই পাঁচ বার ভাবে।’’ যা শুনে তৃণমূলেরই নিচুতলার কর্মীদের বক্তব্য, সোহম আবেগের বশে এ কথা বলছেন। ‘কাটমানি’ প্রথা তুলব বলেই তোলা যাবে না। এর শিকড় এখন অনেক ছড়িয়েছে। এক তৃণমূল নেতার রসিক মন্তব্য, ‘‘চলতি প্রবাদটা একটু ঘুরিয়ে বলা যায়, রাজনীতির বাজারে জ্যান্ত হাতিও লাখ টাকা!’’
ঘটনাও হল, ক্ষতিপূরণ পাওয়ার স্বার্থে ক্ষতিগ্রস্তেরাও ‘কাটমানি’ প্রথা মেনে নিচ্ছেন। বাঁকুড়ার পাত্রসায়রের ময়রাপুকুর গ্রামের বাসিন্দা এক তৃণমূল কর্মীকে এ ভাবেই ক্ষতিপূরণ পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাঁর কথায়, “নেতারা বলেছিলেন, যা ক্ষতি, তার চারগুণ বাড়িয়ে আবেদন করতে। ক্ষতিপূরণ যা পাব, তার অর্ধেক আমার। বাকিটা তাঁদের।” পাত্রসায়রেরই বর্গাশোল গ্রামের এক চাষির জানালেন, গত আমন মরসুমে তাঁর বিঘে দেড়েক জমির ধানের কিছুটা নষ্ট হয়েছিল হাতিদের চলাফেরায়। শাসকদলের স্থানীয় এক নেতার পরামর্শে দু’বিঘে জমির জন্য ক্ষতিপূরণের আবেদন করেন। ক্ষতিপূরণ যা পেয়েছেন, তার অর্ধেক ওই নেতা ‘মিষ্টি’ খেতে নিয়েছেন।
রাজ্যে পালা বদলের পরে ক্ষতিপূরণের অঙ্কটা বেড়েছে অনেকটাই। কাটমানির পরিমাণও তাই বেড়েছে। সোনামুখীর ইছারিয়া গ্রামের বাসিন্দা, বাঁকুড়া জেলা পরিষদের বিরোধী দলনেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘তথ্য জানার অধিকারে আবেদন করে জেনেছি, সোনামুখী পঞ্চায়েত সমিতির এক কর্মাধ্যক্ষ তাঁর স্বামী, শ্বশুর ও ভাসুরের নামে আলাদা আলাদা ভাবে হাতির হানায় ঘর ভাঙার ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। হাতি তাঁদের বাড়ি ভেঙেছে ঠিকই। কিন্তু, তাঁরা সকলে একই ছাদের তলায় থাকেন! এখন ক্ষতিপূরণের নামে কাটমানি দিতে হচ্ছে এলাকার তৃণমূল নেতাদের।’’
সুব্রতবাবু যা-ই বলুন না কেন, এমন নয় যে, হাতির হানায় ক্ষতিপূরণের রাজনীতি তৃণমূল সরকারের আমলেই হয়েছে। দীর্ঘ বাম-শাসনেও ছবিটা এক ছিল ওই সব এলাকায়। বড়জোড়া গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্য তৃণমূল নেত্রী টিঙ্কু মণ্ডলের বক্তব্য, “বাম আমলে ক্ষতিপূরণ পাইয়ে দেওয়ার নামে কাটমানি নেওয়া হত। আমরা সেই সময় এই ঘটনার প্রতিবাদে নানা আন্দোলন করেছিলাম।” বাঁকুড়ার গঙ্গাজলঘাটির চাষি বিক্রম হাজরা, অনন্ত দাসরা কিন্তু বলে দিচ্ছেন, “ঘাম ঝরিয়ে ধারদেনা করে মাঠে ফসল ফলাই। আর সেই ফসল পায়ে মাড়িয়ে নষ্ট করে হাতির পাল। একটা সময় তৃণমূল প্রতিবাদ করত। এখন কিছু সিপিএম নেতা এসে আমাদের পাশে দাঁড়ান। কিন্তু, কেউই হাতি সমস্যার সুরাহা করেন না।’’
আসলে হাতি থাকলেই ক্ষতি আছে। ক্ষতি থাকলেই ‘কাটমানি’। অঙ্কটা ভারী সহজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy