পাশে চাই। সোমবার চাতরা পঞ্চায়েতের বঠিয়া গ্রামে নির্যাতিতা বধূ। ছবিটি তুলেছেন অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়।
বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে কপালে।
ফিকে হলুদ রঙের কলকা আঁকা সুতির শাড়ির আঁচলে মুছে নিলেন মধ্য ছাব্বিশের যুবতী।
নাকছাবিটা পাক দিয়ে একবার ঠিক করে নিলেন। রোদ পড়ে চিক চিক করছে পাথরটা।
কে এই যুবতী?
ইনি, সাত্তোরের নির্যাতিতা। এ বার নির্বাচনে মুরারইয়ের ভোট প্রার্থী।
আলাদা করে বলে দিতে হয় না কোন দলের হয়ে ভোট চাইতে পথে নেমেছেন তিনি। সর্বাঙ্গে তাঁর গেরুয়া রঙ জড়িয়ে। ফিকে হলুদ শাড়ি, গেরুয়া ব্লাউজ, মাথায় পদ্মফুল আঁকা গেরুয়া টুপি আর গলায় পদ্ম ফুল আঁকা উত্তরীয় নিয়ই গত এক মাস ধরে মুরারইয়ের গ্রামের পর গ্রামে চষে বেড়াচ্ছেন সাত্তোরের নির্যাতিতা হাইতুন্নেসা। সোমবার যেমন।
ছোট্ট জটলার মধ্যে দাঁড়িয়ে দ্রুত ঠিক করে নিলেন পরের পরের গ্রামে ভোট প্রচারের কর্মসূচি।
বলছেন, ‘‘আমি সাত্তোরের নির্যাতিতা । পুলিশ ও রাজ্যের শাসক দলের নেতাদের দ্বারা আমি অত্যাচারিত। এখন বিজেপি-র প্রার্থী হয়ে আপনাদের কাছে এসেছি । আমি নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে লড়াই চালাচ্ছি। আপনাদেরকে সেই লড়াই এ সামিল হওয়ার জন্য বলতে এসেছি। আপনাদের সমর্থন পেলে সেই লড়াই চালিয়ে যেতে পারব। তাই আপনারা আমাকে সমর্থন করুন।”
বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ঘোষণা করার আগে তিনি জানতেন, এবারে তাঁকে লড়াইয়ের ময়দানে নামতে হবে। এবং সেই লড়াই এ জেতা বা হারার চাইতে তিনি যে একজন রাজ্যে নারী নির্যাতনের প্রতিবাদী চরিত্র সেটা মাঠে ময়দানে নেমে দেখাতে হবে। তাই বাড়ি থেকে প্রায় ১০৭ কিলোমিটার দূরে, নিজের কেন্দ্র মুরারইয়ের একটি লজে ডেরা বেঁধেছেন। তাঁর দাবি, স্বামী, পাঁচ বছরের একমাত্র ছেলে, শ্বশুর, শাশুড়িদেরকে ঘরে রেখে তিনি নারীর সম্ভ্রম ইজ্জত বাঁচাতে পথে নেমেছেন।
সোমবার হাইতুন্নেসা বিবির প্রচার কর্মসূচি ছিল মুরারই থানার চাতরা পঞ্চায়েতের বঠিয়া গ্রামে। সকাল ৮টায় মুরারই স্টেশন লাগোয়া নিজের ডেরা থেকে বেড়িয়ে আধ কিলোমিটার দূরে চাতরা-মুরারই রাস্তার উপর আর একট লজে যান। সেখানে দলের জেলা নেতৃত্ব সামাদ সেখ, সুধীর রঞ্জন দাস গোস্বামীরা ছিলেন। সেখান থেকে হালকা খাবার খেয়ে বেড়িয়ে পড়েন প্রচারে। পথে হেঁটে মানুষের সঙ্গে কোথাও কথা বলছেন, কোথাও নিজের পরিচয় দিয়ে জানতে চাইছেন তাঁদের সুযোগ-সুবিধা।
গ্রামের পথে হাঁটতে হাঁটতে আয়েষা সিদ্দিকা নামে এক ছাত্রীকে বলেন, ‘‘আমাকে চেন? আমি সাত্তোর থেকে এসেছি, একজন নির্যাতিতা।’’
আয়েষার উত্তর, ‘‘না।’’
প্রার্থী বলেন, ‘‘আমি সাত্তোরের নির্যাতিতা।’’
এরপরই ওই ছাত্রী বুঝতে পারল কে এই মহিলা। সে বলে, ‘‘তখন টিভিতে আপনার মুখ দেখা যায়নি। যার জন্য চিনতে পারিনি।’’
দু’জনের কথার মাঝে আয়েষার মা-কাকিরা বাইরে এসে পড়েন। এত দিন টেলিভিশনের পর্দায় মুখ ঢাকা অবস্থায় যাকে দেখেছেন, তাঁর সঙ্গেই কথা বলেন তাঁরা। শোনেন সাত্তোরে তাঁর উপরে নির্যাতনের কাহিনি। হাইতুন্নেসা বলেন, ‘‘রাজ্যে একজন মহিলা মুখ্যমন্ত্রী অথচ তাঁর আমলেই সবচেয়ে বেশি নারী নির্যাতন, ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। প্রতিবাদ জানিয়ে পথে নেমেছি। আপনাদের পাশে চাই।’’ অদূরে প্রার্থীর গাড়ি দাঁড়িয়ে।
হাঁটছিলেন গাড়ির দিকে।
গরম হাওয়ায় চারপাশ রুখাশুখা।
সেই হাওয়া ঠেলেই এ বার বঠিয়া ছেড়ে পাশের গ্রাম কপিলশহর। পথে যেতে যেতেই বলছিলেন অন্ধকার সেই অভিজ্ঞতার কথা। ‘‘বাপের বাড়ি থেকে আমাকে পুলিশ তুলে নিয়ে যায়। সেই বর্বর অত্যাচারের ঘটনার পর আর বাপের বাড়ি যাওয়া হয়নি! দু’মাস ঘর থেকে বাইরে যেতে পারিনি। শারীরিক অসুস্থতা ছিলই, সেই সঙ্গে মনকে লড়াইয়ের জন্য আরও শক্ত করার প্রস্তুতি নেওয়া চলছিল। পরে পথে বেড়িয়ে সঠিক বিচারের আশায় উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছি।”
নির্যাতিতা হাইতুন্নেসার দাবি, শাসক দলের লোকেরা এলাকায় একশ দিনের কাজ, রাস্তা ঘাট নির্মাণের কাজে দুর্নীতি করছে। প্রতিবাদ করলে এলাকা দখলের নামে গ্রামে পাড়ায় পাড়ায় বোমাবাজি করছে। আর পুলিশ বিনা অপরাধে নিরীহ গ্রামবাসীদের নামে কেস দিয়েছে। তিনি তার প্রতিবাদ করায়, বাড়ি লাগোয়া স্বাস্থ্য কেন্দ্রে বালতি বালতি বোমা রেখেছিল শাসক দলের লোকেরা। যেদিন পুলিশ ও তৃণমূলের লোকেরা অত্যাচার করে, সে দিন থেকেই শাসক দল ও পুলিশের প্রতি তাঁর লড়াই শুরু হয়েছে।
একটানা কথা বলতে বলতে দূরের গ্রামের দিকে তাকিয়ে খানিকটা মনখারাপ নিয়েই বসেছিলেন গাড়িতে। নিস্তব্ধতা ভেঙে বললেন,
‘‘সব চেয়ে বেশি অবাক হয়েছিলাম কোথায় জানেন, মুখ্যমন্ত্রীর কথায়। মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, আমি নাকি খারাপ স্বভাবের। সেই জন্য পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করেছিল! একটা মেয়ের কাছে এটা কতটা অপমানের বলুন তো!’’ — মেয়েদের সুরক্ষা চেয়ে নিজের এই অপমানের প্রসঙ্গই এখন গাঁ-ঘরে বলছেন হাইতুন্নেসা। রাজ্য সরকারের কঠোর সমালোচনা করার ফাঁকে তাই জানিয়ে দিলেন, তিনি আর কারোও কাছেই দোষীদের শাস্তি চাইতে যাবেন না। সে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হোন বা সনিয়া গাঁধী। ঠাঠা রোদে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতে যেতে জানিয়ে দেন, বিজেপি-র হয়ে শাসকের বিরুদ্ধে মুরারইয়ে লড়াই তাঁর একার!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy