Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪

কমিশনের ঘরে খবরদারি শাসক দলের

বজ্র আঁটুনির কথা বলছে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু ফস্কা গেরো তার ঘরেই! ভোটার বা রাজনৈতিক দলের কর্মীদের অভিযোগ শোনার জন্য আরামবাগ ব্লক অফিসে খোলা হয়েছে বিশেষ কেন্দ্র, ‘কমপ্লেন মনিটরিং সেল’। অথচ, সেখানে ‘খবরদারি’ করছেন শাসক দলের নেতারাই!

পীযূষ নন্দী
আরামবাগ শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:৪৮
Share: Save:

বজ্র আঁটুনির কথা বলছে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু ফস্কা গেরো তার ঘরেই!

ভোটার বা রাজনৈতিক দলের কর্মীদের অভিযোগ শোনার জন্য আরামবাগ ব্লক অফিসে খোলা হয়েছে বিশেষ কেন্দ্র, ‘কমপ্লেন মনিটরিং সেল’। অথচ, সেখানে ‘খবরদারি’ করছেন শাসক দলের নেতারাই!

ব্লক অফিসের ওই সেলে গেলেই দেখা যাচ্ছে, তৃণমূলের দুই যুবনেতাকে। মাঝেমধ্যে ব্লক অফিসে ঘুরে যাচ্ছেন আরামবাগ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি শিশির সরকার-সহ তৃণমূল নেতারা। সাধারণ মানুষের এ নিয়ে অভিযোগের
অন্ত নেই। সুর চড়িয়েছে বিরোধীরাও। অভিযোগ, দিনের যে কোনও সময় ওই কেন্দ্রে অভিযোগ জানাতে গিয়ে সাধারণ মানুষ বিড়ম্বনায় পড়ছেন। শাসক দলের নেতাদের কাছে কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে।
আর অভিযোগ যদি শাসক দলের বিরুদ্ধে হয়, তো কথাই নেই। শুনতে হচ্ছে হুমকি!

কেমন সে ‘খবরদারি’?

সূত্রের খবর, গত ৩১ মার্চ মাধবপুর পঞ্চায়েত এলাকায় সিপিএমের বুথ স্তরের সভার ভিডিওগ্রাফি করেন কমিশনের কর্মীরা। পরের দিন ব্লক অফিসের ‘কমপ্লেন মনিটরিং সেল’-এ তা যাচাই হচ্ছিল। অভিযোগ, সেই সময় তৃণমূলের এক যুবনেতা বিনা অনুমতিতে সেখানে ঢুকে ভিডিও দেখতে শুরু করেন। বাধা দেওয়ায় কর্মীদের হুমকি শুনতে হয়। সেই ভিডিওতে কার কার ছবি রয়েছে, সেই তালিকাও করে ফেলেন ওই যুবনেতা। এক পঞ্চায়েত কর্মীর ছেলেকে ভিডিওতে দেখতে পেয়ে ওই যুবনেতা তাঁর ছবি নিজের মোবাইলে তুলে নেন। পরের দিনই ওই পঞ্চায়েত কর্মীর ছেলেকে ভোটের পরে দেখে নেওয়ার হুমকি দেওয়া হয় বলে অভিযোগ।

তার আগে গত ২৮ মার্চ সালেপুর-২ পঞ্চায়েত এলাকার ডোঙ্গল সেতুর কাছে দলীয় পতাকায় মোড়া মণ্ডপে শ’পাঁচেক কর্মী-সমর্থককে দুপুরে ভোজ খাইয়েছিল তৃণমূল। এতে নির্বাচন বিধিভঙ্গের অভিযোগ তুলেছিল সিপিএম। কমিশনের
তোলা সেই ভিডিও যাচাইয়ের সময়েও মিছিলের অংশটুকু রেখে বাকি সবটাই মুছে ফেলার জন্য চাপ দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। সরকারি কর্মীরা তা অস্বীকার করায় যে পঞ্চায়েত কর্মী সেই ভিডিও-রেকর্ডিং করেছেন তাঁকে ওই পঞ্চায়েতে চাকরি করা যাবে না বলে হুমকি দেওয়া হয় বলেও অভিযোগ।

এতেই শেষ নয়। আরামবাগের কালীপুরের এক বাসিন্দা গত ২৪ মার্চ জোর করে তাঁর বাড়ির দেওয়ালে তৃণমূল লিখছে বলে অনলাইনে অভিযোগ জানান। ২৬ মার্চ তাঁর ঘরে হাজির হয়ে তৃণমূল নেতারা হুমকি দেন বলে অভিযোগ। ‘‘ওই দিনই হাতে হাতে সেই দেওয়াল লেখার আনুমতি দিতে বাধ্য হই’’— বলে জানিয়েছেন ওই গ্রামবাসী।

এ তো গেল সাধারণ গ্রামবাসীর অভিযোগ। ওই সেলের কমিশনের কর্মীরাও যেন কিছুটা তটস্থ! কোনও অভিযোগের প্রশাসনিক তদন্ত রিপোর্ট, ফ্লাইং স্কোয়াড বা কমিশনের বিশেষ নজরদারি দলের গতিবিধি এবং বিরোধী দলের অনলাইনে সভা-মিছিলের অনুমতি নেওয়ার বিষয়টিও যে শাসক দল জেনে যাচ্ছে তা মেনে নিয়েছেন ওই কর্মীরা। তাঁরা মানছেন, নিরপেক্ষতা বজায় রেখে কাজ করা যাচ্ছে না। অভিযোগ, প্রচারে ব্যয় সংক্রান্ত ভিডিও-রেকর্ডিংয়ের রিপোর্ট নিয়েও শাসকদলের নেতারা হামেশাই চোটপাট করছেন। ‘স্পর্শকাতর বুথ’ নিয়ে গোপন রিপোর্ট তৈরির সময়ও ওই নেতারা ঢুকে পড়ছেন। ফলে, নিরাপত্তার অভাব হচ্ছে।

প্রশাসন যে হেতু এখন পুরোপুরি কমিশনের আওতায়, তাই ব্লক অফিসও এখন কমিশনেরই অফিস। অথচ, সেখানকার কর্মীরাই আতঙ্কিত! কেন কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছেন না তাঁরা? ওই কর্মীদের অভিযোগ, বিষয়টি প্রশাসনিক কর্তাদের নজরে আনা সত্ত্বেও কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি।

আরামবাগের বিডিও বদরুজ্জামান বলেন, ‘‘ইতিমধ্যে কমপ্লেন মনিটরিং সেল অন্য ঘরে সরিয়ে দিয়েছি। সেই ঘরে কোনও অবাঞ্ছিত অনুপ্রবেশ ঘটছে কি না, খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হবে।’’ মহকুমাশাসক তথা রিটার্নিং অফিসার প্রতুলকুমার বসু বলেন, “আমার কাছে এ বিষয়ে কোনও খবর বা অভিযোগ আসেনি। নির্বাচন কমিশনের নিয়মকানুন পালনের ক্ষেত্রে
কোনও বিচ্যুতি দেখলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’

ভয়মুক্ত পরিবেশে ভোটের জন্য নির্বাচন কমিশন এ বার প্রথম থেকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে ভোটারদের অভিযোগ খতিয়ে দেখে নিষ্পত্তি করতে। বিধানসভা পিছু ২-৩টি ফ্লাইং স্কোয়াড এবং ২-৩টি বিশেষ নজরদারি দল গড়া হয়েছে। অনেক আগে থেকেই এ বার এলাকায় টহল দিচ্ছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। ভোটারদের অভিযোগের চটজলদি সমাধানের জন্য ‘সমাধান’ নামে একটি অ্যাপ সফটওয়্যারও চালু হয়েছে। কিন্তু তাতে লাভ কী হল, প্রশ্ন তুলেছে বিরোধীরা।

সিপিএমের আরামবাগ জোনাল কমিটির সদস্য মোজাম্মেল হোসেন বলেন, ‘‘কমিশনের যাবতীয় আয়োজন তৃণমূল, পুলিশ এবং প্রশাসনের একটা অংশ ষড়যন্ত্র করে ভেস্তে দিচ্ছে। কেউ অভিযোগ করলেই তা তৃণমূল জেনে নিয়ে বাড়িতে গিয়ে শাসাচ্ছে। আমরা বিষয়টি নির্বাচন কমিশনে জানিয়েছি।’’ ব্লক কংগ্রেস সভাপতি প্রভাত ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘সকাল থেকেই তো তৃণমূল নেতারা ওখানে বসে থাকছেন। মানুষ নির্ভয়ে অভিযোগ জানাবেন কী ভাবে?? এ সব বন্ধ না হলে সুষ্ঠু ভোট অসম্ভব।’’

পক্ষান্তরে, কমিশনের কাজে হস্তক্ষেপের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন তৃণমূল নেতা শিশির সরকার। তাঁর দাবি, ‘‘কেউ প্রয়োজনে ব্লক অফিসে যেতেই পারেন। কিন্তু কমিশনের কাজে নাক গলানোর অভিযোগ মিথ্যা এবং উদ্দ্যেশ্যপ্রণোদিত।”

তা হলে কমিশনের কর্মীরা আতঙ্কিত কেন? উত্তর নেই শিশিরবাবুর।

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy