কেউ ছিলেন ছাপোষা শিক্ষক, কেউ অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী, কেউ আবার দলের সব সময়ের কর্মী।
পরিবর্তনের জমানায় ভাগ্যের চাকা ঘুরেছে। এঁদের কেউ পেল্লায় বাড়ির মালিক, কেউ নতুন গাড়ি চড়ছেন, কেউ আবার মেয়ের বিয়েতে এলাহি খাওয়াচ্ছেন। স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি মেলালে এঁরা সকলেই লক্ষ-লক্ষপতি। কারও সম্পদ আবার কোটির কোঠায়।
নন্দীগ্রাম আন্দোলনের নেতা শেখ সুফিয়ানের একতলা বাড়ি রাতারাতি তিন তলা অট্টালিকা হয়ে যাওয়ায় ক্ষোভে ফুঁসেছিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে। বাড়ির উঠোনে পা রেখেই ছিটকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। সেই মুখ্যমন্ত্রীর সাধের জঙ্গলমহলে তাঁর দলেরই মন্ত্রী-বিধায়কদের শ্রী-সম্পদের বাড়বাড়ন্ত কিন্তু সুফিয়ানের থেকে নেহাত কম নয়। আগামী ৪ ও ১১ এপ্রিল যে সব কেন্দ্রে ভোট, সেখানে মনোনয়নের সময় জমা দেওয়া সম্পত্তির হিসেব সংক্রান্ত হলফনামাই দেখিয়ে দিচ্ছে জঙ্গলমহলের জেলাগুলিতে বহু তৃণমূল প্রার্থীর সম্পত্তি বহু গুণ বেড়েছে। বিশেষ করে যাঁরা গত পাঁচ বছর বিধায়ক ছিলেন, তাঁদের তো আঙুল ফুলে কলাগাছ!
কেমন? ২০১১ সালে নয়াগ্রাম থেকে জেতেন দুলাল মুর্মু। সেই সময় পেশায় শিক্ষক দুলালবাবুর স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ৮২ হাজার ৭৯ টাকা। দুলালবাবু এ বারও প্রার্থী। এখন স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ ৪৫ লক্ষ ১৯ হাজার ৭৪৭ টাকা। অর্থাৎ সম্পত্তি বেড়েছে ৪৫ গুণেরও বেশি। নয়াগ্রামে দেশের বাড়ি হলেও শিক্ষকতার সূত্রে দীর্ঘ দিন কাঁথিতে ছিলেন দুলালবাবু। সেই কাঁথি পুর-এলাকারই ৭ নম্বর ওয়ার্ডে দুলালবাবুর বিশাল দোতলা বাড়ি মাথা তুলেছে। এলাকাবাসী জানাচ্ছেন, কাঁথি-রসুলপুর রাস্তার ধারে প্রায় চার কাঠা জমিতে ওই বাড়ির দাম কম করে ৫০ লক্ষ টাকা। গত পাঁচ বছরেই ৮ লক্ষ টাকার গাড়ি, ৫ ডেসিমেল জমি কিনেছেন বিদায়ী বিধায়ক। ব্যাঙ্কে গচ্ছিত প্রায় ১৩ লক্ষ টাকা।
মাওবাদী-পর্বে লালগড়ে সিপিএম নেতা অনুজ পাণ্ডের দো’তলা বাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল জনগণের কমিটির লোকজন। সেই জঙ্গলমহলে তৃণমূলের অন্যতম আদিবাসী মুখ সুকুমার হাঁসদা। পেশায় চিকিৎসক সুকুমারবাবু আদিবাসী উন্নয়নমন্ত্রীও ছিলেন। ২০১১ সালে তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ৫৭ লক্ষ ৮০ হাজার ২৭১ টাকা। আর এ বারের হলফনামা অনুযায়ী, সুকুমারবাবুর সম্পত্তির পরিমাণ ১ কোটি ৩১ লক্ষ ২৪ হাজার ৭১০ টাকা। ঝাড়গ্রাম শহরে সুকুমারবাবুর বাড়ির অন্দরমহলের ভোলও পাল্টে গিয়েছে। দামি মার্বেল বসেছে, এসেছে মূল্যবান আসবাব। দুবরাজপুরে জমিও কিনেছেন ডাক্তারবাবু। আর এক মন্ত্রী পুরুলিয়ার বলরামপুরের শান্তিরাম মাহাতোর আবার পাঁচ বছরে অস্থাবর সম্পত্তি চার গুণেরও বেশি বেড়েছে। ২০১১-সালে ৭ লক্ষ ৯২ হাজার ২২৪ টাকার অস্থাবর সম্পত্তি ছিল। এ বার অঙ্কটা দাঁড়িয়েছে ৩২ লক্ষ ৬৬ হাজার ২১১ টাকা।
নারদ-হুলে জেরবার তৃণমূল। তার মধ্যে জঙ্গলমহলের মতো পিছিয়ে পড়া এলাকার তৃণমূল বিধায়কদের সম্পদের বাড়বাড়ন্ত ভোটের মুখে শাসক দলের ভাবমূর্তি নতুন করে প্রশ্নের মুখে ফেলছে! বিরোধীরা বিঁধছেন, জঙ্গলমহলের গরিবগুর্বো মানুষের মুখে হাসি না ফুটুকু, গত পাঁচ বছরে মুখ্যমন্ত্রীর দলের বিধায়কদের হাসি চওড়া হয়েছে। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য দীপক সরকারের অভিযোগ, “তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা উন্নয়নের টাকায় ভাগ বসিয়েছেন। তাই ফুলেফেঁপে উঠেছেন।” বহু বারের কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়ার আবার কটাক্ষ, ‘‘কোন ফর্মুলায় সম্পত্তি বাড়ছে তা নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার!’’
বিরোধী-শিবিরের খোঁচা যদিও গায়ে মাখছেন না বিতর্কিত তৃণমূল প্রার্থীরা। নয়াগ্রামের দুলালবাবুর যেমন দাবি, “আমি শিক্ষকতা করতাম। সাধারণ মানুষের মতোই জীবনযাপন করি।’’ সুকুমার বাবু অবশ্য সম্পত্তির উৎসের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমি সরকারি চিকিৎসক ছিলাম। ২০১১-র পরে অবসরকালীন টাকা পেয়েছি। সেটাই ব্যাঙ্কে রেখেছি।’’ যদিও সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের একাংশই জানাচ্ছেন, অবসরের পরে চিকিৎসকরা বড়জোর ১৫-২০ লক্ষ টাকা পেতে পারেন। অথচ পাঁচ বছরে ৭৩ লক্ষ ৪৪ হাজার ৪৩৯ টাকার সম্পত্তি বেড়েছে!
মেদিনীপুর বা ঘাটালের তৃণমূল প্রার্থীদের সম্পত্তি বৃদ্ধির পরিমাণও অবাক করার মতো। ২০১১ সালে মৃগেন মাইতি যখন মেদিনীপুর থেকে তৃণমূলের টিকিটে বিধায়ক হলেন, তখনই তিনি সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। সেই সময় স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে তাঁর সম্পত্তির ছিল ৩১ লক্ষ টাকার কিছু বেশি। পাঁচ বছরে তা দাঁড়িয়েছে ৭০ লক্ষ ৮৮ হাজার টাকা। মেদিনীপুরের সিপাইবাজারের বাসিন্দা মৃগেনবাবু ব্যাঙ্কে গচ্ছিত টাকার অঙ্কটা ৭ লাখ থেকে এক লাফে ৩২ লাখে গিয়ে পৌঁছেছে! মৃগেনবাবু ‘এ সব কুৎসা’ বলে প্রসঙ্গ এড়াচ্ছেন। ঘাটালের বিদায়ী বিধায়ক শঙ্কর দোলুইয়ের বাড়ি পালাবদলের পরই দোতলা হয়েছে। বছর কয়েক আগে ছোট মেয়ের বিয়েতে এলাহি খরচও করেন শঙ্করবাবু। গত পাঁচ বছরে তাঁর সম্পত্তির মূল্য ১৭ লক্ষ ৬৭ হাজার থেকে বেড়ে হয়েছে ৫৬ লক্ষ ২২ হাজার টাকা। শঙ্করবাবুর নির্দিষ্ট কোনও পেশা নেই। তিনি সর্বক্ষণের তৃণমূল কর্মী। তা হলে এত সম্পত্তি? মৃদু হেসে শঙ্করবাবুর জবাব, ‘‘বিধায়ক ভাতা আর চাষবাসের সূত্রেই যা আয়।’’ তা শুনে হাসছেন ঘাটালের এক সিপিএম নেতাও। বলছেন, ‘‘তৃণমূলে যে টাকার চাষ হয়, সে তো নারদেই দেখেছি!’’
(সহ-প্রতিবেদন সুব্রত গুহ, প্রশান্ত পাল, কিংশুক গুপ্ত, অভিজিৎ চক্রবর্তী)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy