মঙ্গলবার বেহালার একটি জনসভায় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ও পার্থ চট্টোপাধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র।
সকালের যাবতীয় প্রচার বাতিল করে সে দিন বাড়িতে মিটিং করছিলেন তিনি। ‘অরাজনৈতিক মিটিং’। ভোটের মুখে রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে চাওয়ার ইচ্ছা কোনও প্রার্থীর পক্ষে কি আদৌ স্বাস্থ্যকর?
পার্থ চট্টোপাধ্যায় এক গাল হেসে বললেন, ‘‘তা নয়। আসলে এলাকার অরাজনৈতিক মানুষদের নিয়ে বসতে হচ্ছে দফায় দফায়। কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ স্কুল বা কলেজের শিক্ষক। আমাকে চেনেন। সভা-টভা করে নয়, আমার হয়ে নিজেদের মতো করে মানুষকে বলবেন। তা-ই নিয়েই আলোচনা হচ্ছে, আর কী!’’
নারদ-কাঁটা তো আছেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অরাজকতা, পিএইচডি নিয়ে বিতর্কও এখন তীক্ষ্ণ ফলার মতো বিঁধে রয়েছে সব অর্থেই তৃণমূলের ‘হেভিওয়েট’ প্রার্থী পার্থবাবুর গলায়! এমন বহুমুখী আক্রমণ থেকে বাঁচতে এ বার অরাজনৈতিক লোকজনকেই বেশি করে পাশে চাইছেন তিনি। শুধু এলাকার বিশিষ্ট মানুষেরাই নন, বেহালা পশ্চিম কেন্দ্রের এই প্রার্থী খুল্লমখুল্লা জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের আমলে ক্লাবগুলোকে যে ভাবে সাহায্য করা হয়েছে, যে পরিমাণ টাকা-পয়সা দেওয়া হয়েছে, তা আর কেউ করেনি। তাই প্রয়োজনে সেই ক্লাবগুলিও পাশে দাঁড়াবে, সেটাই তো স্বাভাবিক! তাঁর কথায়, ‘‘ক্লাবগুলোর ভূমিকাই তো আসল। কোথায় আইনশৃঙ্খলার অবনতি হচ্ছে, কোথায় কে কোন সমস্যায় পড়ছে, এ সব খবর ক্লাবগুলোই আগে পায়। তাই সরকার তাদের পাশে থাকছে। তারাও সরকারের পাশেই থাকবে।’’ আদান-প্রদানের সম্পর্কের এই স্পষ্ট তত্ত্ব স্বীকার করে নিতে কুণ্ঠা নেই তাঁর।
ওই কেন্দ্রে এ বার পার্থবাবুর চতুর্থ বারের লড়াই। নিজেই বললেন, ‘‘আমার তো বিশেষ চাপ থাকার কথা নয়। গত বার ৬০ হাজার ভোটে জিতেছিলাম। কিন্তু ওই যে আপনাদের কী সব সমীক্ষা-টমীক্ষায় দেখিয়েছে, এ বার ভগ্নাংশের হিসেবে এগিয়ে থাকবে বাম প্রার্থী! আমি অবশ্য সেটাকে মোটেই গুরুত্ব দিচ্ছি না।’’
গুরুত্ব যদি না-ই দেবেন, তা হলে নিজের ভাবমূর্তি গড়তে এ ভাবে উঠেপড়ে লাগতে হচ্ছে কেন? কেন বলতে হচ্ছে, ‘‘শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে আমি যা করেছি, তা কেউ কোনও দিন করতে পারেনি। অধ্যাপকদের বকেয়া মিটিয়েছি। আংশিক সময়ের শিক্ষকদের পাশে দাঁড়িয়েছি। আর অনলাইন ভর্তি চালু করা? সে-ও তো আমারই অবদান।’’ কিন্তু অনলাইন প্রক্রিয়ার শুরুটা তো শোনা যায় ব্রাত্য বসুর আমলে হয়েছিল? খানিকটা মেজাজ হারিয়েই পার্থ বলে ফেলেন, ‘‘শক-হুণ-পাঠান-মোগলরা যদি দাবি করে তারা এই সমাজ গড়েছে, তা হলে কি সেটা মেনে নিতে হবে?’’ একই রকম তেতো শোনায় তাঁর গলা, যখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অরাজকতার প্রসঙ্গ ওঠে। এ ক্ষেত্রে তাঁর তোপ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির শিক্ষক ও পরিচালন সমিতিগুলির উপরে। ‘‘ওঁদের মধ্যে সহিষ্ণুতার অভাব। দলীয় সংকীর্ণতা নিয়ে কাজ করেন, তাই এ সব হয়। তবে ৮০০ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৮-১০টিতে কিছুটা গোলমাল হলে তা নিয়ে গেল-গেল করার কিছু নেই! ও সবে আমার কিছু হবে না!’’
মুখে যা-ই বলুন, একটি মুহূর্তও কোনও ভাবে নষ্ট করছেন না তৃণমূল সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই মন্ত্রী। অসহ্য গরমে ঘুরে ঘুরে প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। রক্তচাপ বেড়ে যাচ্ছে এক ধাক্কায় অনেকটাই। তবু ‘লড়কে লেঙ্গে...’ মনোভাব থেকে সরছেন না। বারবার জোর দিচ্ছেন নিজের অরাজনৈতিক পরিচিতির উপরে। ‘‘আমি একটা সংস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলাম, সবাই জানেন। দলীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করি। বেহালায় আমার অফিসের বাইরে ‘জনসংযোগ দফতর’ কথাটা লেখা আছে, তৃণমূলের দফতর লেখা নেই কিন্তু!’’
বারবার করে একই বিষয়ে এত কথা কেন বলছেন তৃণমূলের মহাসচিব? কেন দলীয় পরিচয়টা পিছনের দিকে ঠেলতে তাঁর এমন ছটফটানি? নারদ-কাঁটা চলার পথের মসৃণতা খর্ব করতে পারে, সেই ভয়ে? এ বার খানিকটা সতর্ক শোনায় তাঁর গলা। ‘‘আমি জীবনে কখনও অন্যায়ের সঙ্গে আপস করিনি। আজও করব না। দলেও আমার এই ভূমিকাটা বজায় রয়েছে। নানা দায়িত্বের চাপে মাঝেমধ্যে
হয়তো সেটা টের পাওয়া যায় না। কিন্তু সময় হলে সেই ভূমিকাটা ঠিকই জ্বলে ওঠে। ব্যস, আপাতত শুধু এটুকুই বলার।’’
কিন্তু যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা তো আপনার দলেরই অঙ্গ। খোদ মুখ্যমন্ত্রীও তো স্বীকার করেছেন সে কথা! পার্থর জবাব, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী কী বলেছেন, সেটা উনিই বলতে পারবেন। তবে দলের তরফে তো অভ্যন্তরীণ তদন্তের সিদ্ধান্ত হয়েছে।’’ কত দূর সেই তদন্তের অগ্রগতি?
এ বার একটু অসহিষ্ণু হয়েই তিনি বলেন, ‘‘ভোটের আগে এগুলো নিয়ে ভাবার সময়ই নেই। আর ওরা যদি ভিডিওটা প্রকাশের জন্য দু’ বছর অপেক্ষা করতে পারে, তা হলে আমরা ভোটের জন্য এক মাস অপেক্ষার সুযোগ পাব না?’’
নিজের কথায় নিজেই হা হা করে হাসতে থাকেন রামকৃষ্ণ মিশনের প্রাক্তন ছাত্র এবং নামী বহুজাতিকের মানবসম্পদ উন্নয়ন বিভাগের প্রাক্তন এই কর্তা। হাসির শেষটুকু কেমন যেন ম্লান হতে হতে মিলিয়ে যেতে থাকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy