গত ২০ মার্চ বীজপুরের বাঘমোড় এলাকায় শুভ্রাংশু রায়ের হয়ে প্রচারে দেখা গিয়েছিল হালিশহরের উপ-পুরপ্রধান রাজা দত্তকে। —ফাইল চিত্র।
রাজার ইচ্ছে। কী না হয়!
ত্রিপুরার শেষ রাজা বীর বিক্রমকিশোর মাণিক্য রুদ্রসাগরে ‘নীরমহল’ বানাতে চেয়েছিলেন। তৈরি হয়েছিল তাঁর সেই সাধের মহল।
‘হাভেলি শহর’-এর (হালিশহরের আদি নাম) রাজারও তেমন সাধ জেগেছিল। সরকার-বাজারে কয়েক বিঘার মিছরি-পুকুর ভরাট করে তেমন হাভেলি তৈরির পরিকল্পনাও প্রায় পাকা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মত বদলান রাজা। হাভেলি তৈরির চেয়ে পুকুর-ভরাটের কাঁচা টাকাই তাঁর ‘পাখির চোখ’ হয়ে যায়। কয়েক মাসের মধ্যে রাজার সেই সাধ পূরণ করে চ্যালারা। মাঠ হয়ে যায় বিরাট পুকুর। এ কথা বলছেন রাজারই এক ঘনিষ্ঠ।
কেউ বাধা দেয়নি?
২০১১ থেকে এ বার বিধানসভা ভোটের আগে পর্যন্ত হালিশহর-বীজপুরে রাজ-বিদ্রোহের কথা ভাবতেই পারতেন না কেউ। বাধা আর কে দেবে? রাজা দত্তের মাথায় যে মুকুল রায় (সেই সময় তৃণমূলের নাম্বার টু) এবং তস্য পুত্র শুভ্রাংশুর হাত! জানেন এলাকার সবাই। স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের মধ্যে রাজা দত্তের বিরোধী গোষ্ঠীর নেতারাও মানছেন, এ তল্লাটে মুকুলবাবু বা তাঁর ছেলের অগোচরে কিছু হওয়া অসম্ভব। পুকুর-ভরাটও।
বিরোধীদের দাবি, হালিশহর-কাঁচরাপাড়ায় পুকুর-ভরাটের পরিকল্পনা থেকে প্রোমোটিং— প্রতিটি ক্ষেত্রে নজরানা পৌঁছয় রায় পরিবারে। তবেই মেলে সবুজ সঙ্কেত। তাই কয়েক বছর আগেও ভূমি দফতরের খতিয়ানে যে হালিশহরে কয়েকশো জলাভূমির অস্তিত্ব ছিল, বর্তমানে তার অধিকাংশই ‘ভ্যানিশ’। সৌজন্যে— রাজা দত্ত। বর্তমান হালিশহরের উপ-পুরপ্রধান। এমনকী, পুকুর-ভরাটের জন্য যে বালি বা ‘রাবিশ’ ফেলা হয়, তারও ‘কমিশন’ রায়বাড়িতে যায় বলে অভিযোগ।
নির্বাচন কমিশনের কাছে দাখিল করা হলফনামা তুলে বিরোধীরা আরও বলছেন, ২০১১ সালে বীজপুরের তৃণমূল প্রার্থী হিসেবে শুভ্রাংশু তাঁর অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ দেখিয়েছিলেন ১০ লক্ষ ৯১ হাজার টাকা। আর এ বার তিনি সেই সম্পত্তির পরিমাণ দেখিয়েছেন ৭০ লক্ষ ৫১ হাজার টাকা। অর্থাৎ, অস্থাবর সম্পত্তি বেড়েছে প্রায় সাত গুণ! শুভ্রাংশুর ব্যবসা রয়েছে। তা সত্ত্বেও পাঁচ বছরে এই পরিমাণ সম্পত্তি করা অনেকটাই ‘রাজার নজরানা’র ফলে বলে দাবি বিরোধীদের। এ নিয়ে শুভ্রাংশুর কোনও প্রতিক্রিয়া মেলেনি। শুক্রবার বাড়িতে তাঁর দেখা পাওয়া যায়নি। মোবাইল ফোনও বন্ধ ছিল। তাঁর বাবা মুকুলবাবু
জানান, তিনি ভোট-প্রচারে ব্যস্ত রয়েছেন। বাসিন্দারা মনে করছেন, রাজা দত্তকে আড়াল করতেই এই এড়িয়ে যাওয়া।
এই রাজার জন্য শুভ্রাংশুকে একাধিকবার দলে অস্বস্তিতেও পড়তে হয়েছে। বছর খানেক আগে বাজারে আলুর জোগান কম থাকার সময়ে আলুর ট্রাক ছিনতাই করা হোক বা এলাকার পানশালাগুলিতে রাজার ওঠাবসা! কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি বীজপুরের তৃণমূল প্রার্থীকে। তা হলে যে ‘রাজার নজরানা’ মিলত না— টিপ্পনী বিরোধীদের।
কিন্তু প্রশাসন কেন ব্যবস্থা নেয়নি রাজার বিরুদ্ধে? প্রশাসনেরই একটি সূত্র জানাচ্ছে, এ পর্যন্ত রাজার বিরুদ্ধে মৎস্য দফতর এবং পরিবেশ দফতরের করা বেশ কিছু অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা রুজু করা হলেও সেই মামলা তুলেও নেওয়া হয়েছে।
এই যেখানে অবস্থা, সেখানে রাজার বিরুদ্ধাচারণ করে, কার সাধ্যি? তা হলেই যে রাজরোষে পড়তে হবে। প্রথমে শান্ত গলায় বোঝানো, তারপরে তাঁর চ্যালাদের হুঁশিয়ারি এবং শেষে তাদের তাণ্ডব সহ্য করতে হবে বলে অভিযোগ।
সেই তাণ্ডবের চেহারা গত রবিবার রাতেই দেখেছেন হালিশহরের বারেন্দ্র গলির সমাজপতি পরিবার। প্রহৃত হয়েছেন ওই বাড়ির মেয়ে দেবশ্রী এবং তাঁর শিশুকন্যা সায়ন্তিকা। তা সত্ত্বেও তাঁরা পরের দিন ভোট দিতে গিয়েছেন। ভোটদানে সাহস জুগিয়েছেন এলাকার বাসিন্দাদেরও। মুখ খুলেছেন তাণ্ডব নিয়ে। তার পরে শুভ্রাংশু ওই পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত তিনি কোনও যোগাযোগ করেননি বলে দাবি সায়ন্তিকার দাদু টিটু সমাজপতির। তিনি বলেন, ‘‘বিদায়ী বিধায়ক আমাদের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করেননি। কারণ রাজা দত্ত’র মদতেই এই হামলা হয়েছে। আর রাজা
বিদায়ী বিধায়ক আর তাঁর বাবার কথায় চলেন।’’
শুভ্রাংশু যোগাযোগ না করলেও এ দিন এলাকার তৃণমূল সাংসদ দীনেশ ত্রিবেদী সায়ন্তিকা ও তাঁর মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। ছোট্ট মেয়েটির থেকে সে দিনের ঘটনার বর্ণনা শোনেন তৃণমূল সাংসদ। আশ্বস্ত করেন দোষীদের শাস্তি নিয়ে। এতে হালিশহরবাসী কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন ঠিকই। কিন্তু তাঁদের প্রশ্নও রয়ে গিয়েছে। গৃহবধূ অনিন্দিতাদেবী, রিম্পাদেবীদের প্রশ্ন, ‘‘অপরাধী যদি নিজের দলের মাথাদের মদতপুষ্ট কেউ হয় সাজা দেওয়াতে পারবেন
তো দীনেশবাবু?’’
এ দিন ওই বাড়িতে যান প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী এবং বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুও। তাঁদের কোলে চড়ে সায়ন্তিকার প্রশ্ন, ‘‘আর ওরা ভয় দেখাবে না তো?’’ অধীরবাবু জানতে চান, ‘‘তোমার ভয় করছে?’’ সায়ন্তিকার ছোট্ট উত্তর, ‘‘তখন করেছিল। এখন আর করছে না।’’ অধীরবাবু বলেন, ‘‘এ বারের নির্বাচনে সায়ন্তিকা ও তার মা সবচেয়ে বড় আবিষ্কার। ওঁদের দেখেই তো বাংলার মানুষ শাসক দলের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কথা ভাবতে পারছেন। এখানে পুকুর-ভরাটের কমিশন সরকারের উপরতলা পর্যন্ত যায়। বিধায়ক কি ঠুলি পরে ছিলেন?’’ অধীরের কাছে ‘রাজ-সন্ত্রাস’ নিয়ে অভিযোগও জানান এলাকাবাসী।
রাজা দত্তের অবশ্য এ দিনও টিকি দেখা যায়নি। সায়ন্তিকার বাবাকে দিয়ে মুচলেকা লেখানোর পর থেকে তিনি বেপাত্তা। শূন্য পড়ে রয়েছে তাঁর রাজপাট। বকুলতলার বাঁশের মাচা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy