তেখালি ব্রিজ অবধি পৌঁছনোর আগেই বাড়তে থাকে বুকের ধুকপুক। এই তো এখানেই মানব-বন্ধন ছিঁড়ে মাটি ভিজেছিল রক্তে। খালের ওপার থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসত হার্মাদের গুলি। গারুপাড়ার পথ ধরলেই হাত ধরে টানত মেয়ে-বউদের।
পরিবর্তনের খোঁজে এই গোকুলনগরেও এসেছিলেন দিদি। মাটির ঘরটায় বসে সে কথা ভেবে হাসি পায় নমিতা বিজলির। বলেন, ‘‘এই যে দেশের জন্য, গ্রামের জন্য এত মারধর সহ্য করা, কী ফল মিলল তার? কী পেলাম জীবনে?’’ তখন হার্মাদদের হাত থেকে বাঁচতে রাতের পর রাত জঙ্গলে, খাল পাড়ে, ঝোপেঝাড়ে লুকিয়ে থাকা! আর আজ এই ঘরটাই বিভুঁই হয়ে গেল!
নন্দীগ্রামে গোকুলনগরের বধূ নমিতা। ২০০৮-এর ১৪ মার্চ, ‘শহিদ দিবসে’র ঠিক এক বছর পরের দিনটাতেই রোজভ্যালির এজেন্ট হয়েছিলেন স্বামী সমীর বিজলি। ‘‘কেন যে বড় জামাইয়ের কথা শুনতে গেল মানুষটা? ক’টা টাকাই বা কমিশন পেত!’’ জামাই নিজে এলআইসি এজেন্ট। কিন্তু খেজুরি থেকে এ গাঁয়ে এসে রোজভ্যালির গুণ গাইত। বড় মেয়ে পিউও হয়েছিল সিনিয়র এজেন্ট। পরে পিউয়ের বাবাকেও ঢোকাল কোম্পানিতে। মাস গেলে আসত দু’আড়াই হাজার। নমিতা সস্নেহে বলেন, ‘‘জমিতে গতর খাটানো ভাল পারত না লোকটা। এজেন্টের কাজ পেয়ে যেন প্রাণে বেঁচেছিল। সেই প্রাণটাই থাকল না!’’
পোড়ো বাড়ির মতো মাটির ঘরে পাক খায় শব্দগুলো। ভিতর ঘরে এখনও পড়ে, খাবার গরম রাখার একটা বাক্স। ভাল ‘কালেকশন’-এর পুরস্কার। মাটির উনুন খোঁড়া রান্নাশালে কেমন বেমানান লাগে ওই ‘হটকেস’। কে জানত, এ সংসারে উনুনে আঁচ পড়াই বন্ধ হয়ে যাবে এত তাড়াতাড়ি!
খেজুরির শেরচকে বাপের বাড়ি বা মেয়েদের ঘরেই এখন পড়ে থাকতে হয় নমিতাকে। ঘরে ফিরলেই হার্মাদের গুলির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে ভিটেয় ঢোকে গাঁয়ের লোক। ‘কই চেকফেক কিছু পেলে না কি হে?’ ‘তোমার স্বামী তো ফাঁকি দিয়ে পগার পার!’ নমিতা ভাবেন, স্বামী জ্বলেপুড়ে খাক হওয়ার পরে কার ভরসায় থাকবেন এখানে? রাতবিরেতে মদ খেয়েও কেউ কেউ আসে! টাকার কথা বলতে!
তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্য সুদর্শন প্রামাণিকের বাড়িও বেশি দূরে নয়। আসেন তিনিও। ভোটের কথা বলে যান! থেমে থেমে বলেন, ‘‘আসলে ঘটনাটা যে এত দূর গড়াবে, তা বুঝতে পারিনি! এতগুলো লোকের টাকা... পাবলিক মানি... সব দিকই দেখতে হয়!’’ নমিতা ম্লান হাসেন, ‘‘সত্যিই তো উনি কী করতেন? ওরা কতগুলো ভোটার আর আমরা মোটে ক’জন! তা হলে কার দিকটা দেখবেন উনি?’’
তা ছাড়া এতগুলো খেটে-খাওয়া লোকের টাকা বলে কথা! সেটাও বোঝেন নন্দীগ্রামের বধূ। কিন্তু কী করবেন? ‘‘লোকের বিশ্বাসের আমানত, টাকার চিন্তাতেই তো মানুষটা শেষ হয়ে গেল!’’ সারদা কেলেঙ্কারি ধরা পড়ার পরেও কিছু দিন ভরসা ছিল। কাঁথিতে রোজভ্যালির অফিসে ভাঙচুরের পরেই ভয় ঢুকল। ঘরে বড় মেয়ের তখন দু’টো যমজ ছেলে। অসুস্থ হয়ে বাপের বাড়িতেই পড়ে। মেজ মেয়েটারও শরীর খারাপ। বিশের কোঠা না-পেরোতেই তিন মেয়ের মা। ওর স্বামীর ‘পেলাস্টিক’ কারখানার মজুরিতে কতটুকু হয়! তখনও ছোট মেয়ের বিয়ে হয়নি। একটা মানুষের ঘাড়ে সব কিছু। কত আর সহ্য করবে?
চিন্তায়-চিন্তায় বড় মেয়েটা আগেই গেল! সে দু’বছর আগের কথা। তখনই এজেন্টের কমিশন বন্ধ। পাওনাদারের চাপ। বাড়ির ভিতর ঘরে দাঁড়িয়ে পরিত্যক্ত খাটখানা দেখান নমিতা! ‘‘ওই খাটে শুয়েই কাঁদতে কাঁদতে বুকে ব্যথা শুরু হয়েছিল মেয়ের। খাট থেকে আছাড় খেয়ে পড়ল। স্ট্রোক হয়ে শেষ!’’ তার পরেও অবশ্য চেষ্টা করেছিল। চোরের মতো ছোট মেয়ের বিয়েটাও দেয় নমিতার বাপের বাড়িতে। গাঁয়ের লোকে জানলে তখনই কুরুক্ষেত্র করত। কিন্তু শেষমেশ হার মানতে হল।
বড় মেয়ে গত হওয়ার পরে ফের বিয়ে করে তত দিনে বড় জামাই সরে পড়েছে। রাতের পর রাত মানুষটা ঘুমোতে পারে না। সে রাতটাও খালি কেঁদেছিল। একটাই কথা, ‘‘পলিসির ৮-১০ লাখ টাকার ধাক্কা! কোথায় পাব? কী করে মুখ দেখাব!’’ মেজ মেয়েটাও সে রাতে এ ঘরে। তাকে ডেকে বলল, ‘‘আমি চলে গেলে তোর মাকে ওরা শেষ করে দেবে! মাকে দেখিস!’’ নমিতা বলেন, ‘‘এমন তো প্রায়ই বলত। তখনও কিছু বুঝিনি।’’ ভোররাতে একটু চোখ লেগে যায়! হঠাৎ খেয়াল হল, মানুষটা নেই! ধড়মড়িয়ে উঠতেই নমিতা দেখেন, মুখে কী যেন ভরে ছুটে জলের খোঁজ করছেন সমীর। ভিতর ঘরের তাকে রাখা গাছের ওষুধ থাইনেটের শিশিটা অর্ধেক খালি। মেজ মেয়ে, জামাই— সব ঝাঁপিয়ে পড়ে মুখে হাত ভরে দানাগুলো যত দূর সম্ভব বার করে আনে। চিৎকার করে গাঁয়ের লোক ডেকেছিলেন নমিতা। ‘চোরে’র বিপদে কেউ সাড়া দেয়নি।
তেঁতুলতলা ছাড়িয়ে কামারদাঁ-র স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মেজ জামাই একাই নিয়ে যায়। বাইকে যেতে যেতে লোকটা বলছিল, ‘‘কেন আমায় নিয়ে যাচ্ছ? পেটে যা পড়েছে, তাতে নাড়ি ফুটো হয়ে যাবে। ভগবানও বাঁচাতে পারবে না!’’ সেটাই ঘটল, কিছু ক্ষণে। এর পরে কাঁথিতে ময়না-তদন্ত। ‘‘গাঁয়ের লোক তখনও বিশ্বাস করছে না। বলছে, পালানোর মতলব।’’
স্বামীর সঙ্গে আর দেখা হয়নি নমিতার। কাঁথিতেই পুড়িয়ে আসে মেজ জামাই! নমিতার মনে পড়ে, যে দিন এত লোকের অভিশাপের বিষ বুকে নিয়ে লোকটা গ্রাম ছাড়ল, তার কিছু পরেই জাতীয় পতাকা উঠেছিল গারুপাড়ায়। তার পরে প্রভাত ফেরি! সেটা গত বছরের ২৬ জানুয়ারি।
এখন ফের গ্রামের পথে গাছে-গাছে ঝান্ডা। একটাই রং, একটাই প্রতীক! গোকুলনগরে ফিসফাস চলে, খালের ধারে কারা নাকি বিজেপি-র ঝান্ডা তুলতে গিয়েছিল, মোক্ষম শিক্ষা পেয়েছে। মাটির ঘরের দেওয়ালে-দেওয়ালে শুধু মমতাদি ও শুভেন্দু। ‘নন্দীগ্রাম উন্নয়নের দিশারী শুভেন্দু অধিকারী’! ফি-রবিবার খেজুরিতে আমানতকারী ও এজেন্ট সুরক্ষা মঞ্চের মিটিং অবশ্য বেসুরে বাজে। টিভিতে নাকি দেখিয়েছে, তোয়ালে জড়িয়ে টাকা নিচ্ছেন নন্দীগ্রামের নয়নের মণি শুভেন্দু! ভোটের হাওয়ায় গোকুলনগরের অসহায় মানুষগুলোও ভাবতে বসেন, টাকা ফেরত পেতে তবে কার দোরে হাত পাতব? সারদা-রোজভ্যালির টাকায় ফুলেফেঁপে ওঠা নেতারা কি কানাকড়ি ফেরত দেবে?
সাংবাদিককে দেখাতে নীল ‘চিকচিকায়’ গুছোন কাগজ, স্বামীর ডেথ সার্টিফিকেট, পিএম রিপোর্টের কপি বার করেন নমিতা। বলেন, ‘‘এই কাগজগুলোই এখন আমার সব।’’ ভোট উপলক্ষে গাঁয়ে ফিরে ভাবেন, ফের কবে আসব এখানে! বর্ষায় সবেদা গাছের শুঁটি ধরা দেখতে আসা হবে তো? ধন-মান-প্রিয়জন হারিয়ে ঘরে ফেরার আর্তিটুকু গাঢ় হয়। স্বপ্ন-ভাঙা নন্দীগ্রামের বাতাসে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy