পানা সরিয়ে পারাপার। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।
‘স্রোতস্বিনী ইছামতী’— সে যেন এক গল্পকথা!
কচুরিপানায় ভরা নদীর বর্তমান চেহারাটা দেখলে তা মনে হয় বইকি। এক সময়ে জোয়ার-ভাটা খেলত যে নদীর বুকে, তা আজ সমস্ত গৌরব হারিয়েছে। বর্ষায় নদীর দু’কূল ছাপিয়ে বন্যার আশঙ্কা বাড়ানোর জন্য নদীর দু’পাড়ের বহু মানুষ আজ হয় তো শাপশাপান্তই করেন একদা প্রিয়তম নদীটিকে।
সেই নদী, যা এক সময়ে বহু মানুষের জীবিকার সংস্থান করত, স্নানের ঘাট ভরে থাকত গল্পগাছায়। নদীর পাড়ের মধুর হাওয়ায় পেয়ে তরতরিয়ে বইত ডিঙি নৌকো। বহু মানুষের দামাল কৈশোরের সঙ্গী এই নদী আজ সব গৌরবই হারিয়েছে। যে জন্য প্রকৃতি যত না দায়ী, মানুষের ভূমিকাও বা কম কীসে? তবে বহু মানুষের আবেগ জড়িয়ে থাকায় ইছামতী সংস্কার প্রতিবারই বনগাঁয় ভোটের মুখে পরিচিত আলোচ্য বিষয়। নদী দিয়ে জল না বয়ে যাক, নানা প্রতিশ্রুতির বান ডাকে ভোট এলেই। মৃতপ্রায় নদীর তাতে প্রাণ ফেরে না।
বনগাঁ মহকুমার বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, নদী কার্যত খালের চেহারা নিয়েছে। কোথাও আবার নদীর বুকে দীর্ঘদিন ধরে কচুরিপানা জমে শুকোতে শুরু করেছে। বছরের বেশির ভাগ সময়েই নদীর জলের মুখ দেখতে পান না নদীপাড়ের বাসিন্দারা। যেখানে কচুরিপানার আগ্রাসন নেই, সেখানেও বেআইনি ভাবে নদীর মধ্যে মৎস্যজীবীরা পাটা-ভেচাল-কোমর দিয়ে জলের গতি আটকে দিয়েছেন।
খাতায় কলমে নদিয়ার মাজদিয়ার পাবাখালিতে মাথাভাঙা নদী থেকে ইছামতীর সৃষ্টি হয়েছে। সেখান থেকে বসিরহাটের হাসনাবাদ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ওই নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ২০৬ কিলোমিটার। তবে ইছামতীর আজ আর কোনও উৎসমুখ খুঁজে পাওয়া যায় না। পাবাখালি থেকে ফতেপুর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১৯ কিলোমিটার নদী পথে কোনও জল নেই। সেখানে নদীর মধ্যে এখন চাষ-আবাদ করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। গাড়িও চলে। ফতেপুর থেকে মোবারকপুর হয়ে নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ফের দত্তফুলিয়ার কাছে নদী এ দেশে ঢুকেছে।
ইছামতী নদী সংস্কার সহায়তা কমিটি সূত্রে জানা গিয়েছে, দত্তফুলিয়া থেকে বনগাঁ পর্যন্ত নদীর দূরত্ব সাড়ে ৩৫ কিলোমিটার। ওই অংশের হালও খুবই শোচনীয়। কমিটির দাবি, বাম আমলে নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জ পঞ্চায়েত সমিতির পক্ষ থেকে উৎসমুখ থেকে সাড়ে ১৯ কিলোমিটার অংশে নদীর জমি পাট্টা দেওয়া হয়েছিল। ফলে নদীর পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। কমিটির সম্পাদক সুভাষ চট্টোপাধ্যায় দীর্ঘদিন ধরে নদীর পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন। তিনি বলেন, ‘‘যে নদীর উৎসমুখ নেই, তাকে মৃত নদী বলে। ইছামতীও তাই। নদীর প্রাণ ফেরাতে হলে দ্রুত উৎসমুখে ড্রেজিং করে পলি তুলে সংস্কার করতে হবে। কেন্দ্র সরকারকে ওই কাজে উদ্যোগী হতে হবে।’’ কমিটির পক্ষ থেকে রাজ্য সরকারের কাছে নদীর তলদেশের একটি ‘কম্প্রিহেন্সিভ প্ল্যান’ তৈরিরও দাবি করা হয়েছে। সেটা তৈরি হলে নদীর অবস্থার পুরো ছবিটা স্পষ্ট হবে। সেই মতো সংস্কারের কাজও করা যাবে।
ড্রেজিং করে পলি তোলার কাজ অবশ্য আগেও হয়েছে। বাম আমলে ২০০৫ সালে গাইঘাটার কালাঞ্চি সেতু থেকে স্বরূপনগরের তেঁতুলিয়া সেতু পর্যন্ত নদী পথে প্রায় ২৫ কোটি টাকা খরচ করে পলি তোলা হয়েছিল। অভিযোগ উঠেছিল, নদীর পলি তুলে পাড়ে রাখার ফলে বর্ষায় সেই পলি ফের নদী গর্ভে চলে গিয়েছিল। যদিও নদী সংস্কারের ফলে নদী পাড়ের বাসিন্দারা সাময়িক সুফল পেয়েছিলেন। সে বছর আর তাদের বন্যায় ভাসতে হয়নি। নদী মরে যাওয়ার কারণে প্রায় প্রতি বছরই ভারী বৃষ্টি বনগাঁ ও বসিরহাট মহকুমার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়।
২০১০ সালে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে গাইঘাটার বর্ণবেড়িয়া থেকে কালাঞ্চি সেতু পর্যন্ত ২০.৪১ কিলোমিটার অংশে প্রায় ১৫ লক্ষ ঘন মিটার পলি তোলা হয়েছিল। কেন্দ্রের খরচ হয়েছিল ৩৯ কোটি টাকা। গভীরতা বেড়েছিল ২.৬ মিটার। তৃণমূল সরকারের আমলেও কালাঞ্চি সেতু থেকে স্বরূপনগরের টিপি পর্যন্ত প্রায় ১৫ কিলোমিটার অংশে পলি তোলা হয়েছে। মাঝে মধ্যেই নদী থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে কচুরিপানা তোলা হয়। কিন্তু কিছু দিন যেতে না যেতেই ফের কচুরিপানায় মুখ ঢাকে নদী। একমাত্র অতি বর্ষা হলেই নদী কচুরিপানা মুক্ত হয়। বাসিন্দারা জানিয়েছেন, কচুরিপানা সরিয়েও যদি স্রোত না ফেরে, তবে কাজের কাজ কিছুই হবে না।
এই পরিস্থিতিতে নদীর উৎসমুখ সংস্কারের দাবি জোরাল হয়েছে। তবে স্থানীয় মানুষের অভিজ্ঞতা বলে, ঢের প্রতিশ্রুতি মিললেও কাজের কাজ হয়নি কিছুই। প্রাক্তন বিধায়ক তথা সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য পঙ্কজ ঘোষ বলেন, ‘‘ইছামতী নদীতে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হলে উৎসমুখে জল প্রবাহ সৃষ্টি করতে হবে। পলি তুলতে হবে। আমাদের আমলে উৎস মুখে একটি স্লুইস গেট তৈরির পরিকল্পনাও করা হয়েছিল। তারপর আর কিছু কাজ এগোয়নি।’’ পঙ্কজবাবুর দাবি, ‘‘শুধু নদী সংস্কার করলেই হবে না। নদীর সঙ্গে প্রায় ৪০টির মতো খাল-বাওর জড়িয়ে আছে। তা-ও সংস্কার করতে হবে। প্রাকৃতিক ভারসাম্যের জন্যেও যা জরুরি।’’
বনগাঁ উত্তরে তৃণমূলের বিদায়ী বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস অবশ্য দাবি করেন, রাজ্য সরকার নদী সংস্কারের দিকটি গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। ইতিমধ্যেই কচুরিপানা তোলা, ড্রেজিং করে পলি তোলার কাজ হয়েছে। এখনও চলছে। মুখ্যমন্ত্রী ইছামতীকে বাঁচাতে সব সহযোগিতা করছেন বলে দাবি বিশ্বজিৎবাবুর। সেই সঙ্গে প্রতিশ্রুতি, ‘‘উৎসমুখও সংস্কার করা হবে।’’
এ সব কথা নতুন করে আর কানে ঢোকে না হৃতযৌবনা ইছামতীর!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy