ব্রিগেডে নানা ভঙ্গিমায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। —নিজস্ব চিত্র
ব্রিগেডে মিটিং শুরু। দুপুর ২টো বেজে ৩৩ মিনিট।
গলা কখনও খাদে। কখনও চড়ায়। চোখ কখনও ডাইনে। কখনও বাঁয়ে। দু’হাতে হাজারো মুদ্রা। কখনও আঙুল ওঁচানো। কখনও আবার দু’হাত জড়ো। কখনও হাত উপরে তুলে নমস্কারের ভঙ্গিমা। কখনও হাতে হাতে তালি। কখনও বাজাচ্ছেন পোডিয়ামের পিঠ। হিন্দির ভাঁজে ভাঁজে মেশাচ্ছেন বাংলা বাক্য। কখনও নরম। কখনও গরম। কখনও আক্রমণে ঝাঁঝালো। কখনও মুহূর্তের নীরবতা। পরমুহূর্তে আবার সুর সপ্তমে।
রবি-ব্রিগেডে ঝাড়া ৬৮ মিনিট ভাষণ দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। মোবাইলের অ্যাপ তখন জানান দিচ্ছে, কলকাতার তাপমাত্রা ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁয়েছে। তাত এতটাই যে, মোদীকে বেশ কয়েক বার মুছতে হল গাল-কপাল। ছোট্ট জলের গ্লাসেও চুমুক দিলেন বার পাঁচেক।
দিল্লি থেকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ বিমান কলকাতার মাটি ছুঁয়েছিল দুপুর ১টা ২৩ মিনিটে। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে সোজা রেসকোর্সের মাঠ। ব্রিগেডের আকাশে যখন মোদীর হেলিকপ্টার ভাসছে, তখন সমবেত জনতা ‘মোদী... মোদী... মোদী...’ চিৎকারে উল্লসিত। হেলিপ্যাড থেকে কালো টয়োটা ফরচুনার মোদীকে সোজা পৌঁছে দেয় ব্রিগেডের হ্যাঙ্গার মঞ্চের ঠিক পাশে। তখন ২টো ২৬ মিনিট।
মিনিট সাতেকের মধ্যে মঞ্চে উঠে জনতাকে দু’হাত জড়ো করে প্রণাম করলেন মোদী। বললেন, ‘‘শ’য়ে শ’য়ে মিটিং করেছি। এত বড় জনসমাগম আগে দেখিনি। ভাল লাগছে। হেলিকপ্টার থেকে দেখছিলাম। ময়দানে কোনও খালি জায়গা নজরে পড়ছিল না। সব রাস্তা লোকে ভর্তি। অনেকে পৌঁছতেও পারবেন না।’’ ভিড়ের বহর দেখে মোদীর আরও মন্তব্য— ‘‘মনে হচ্ছে আজ ২ মে।’’ যে দিন বাংলার বিধানসভা ভোটের ফলপ্রকাশ!
তার আগেও এক বার জনতাকে প্রণাম করেছেন প্রধানমন্ত্রী। সাদা কুর্তা-পাজামা, হাল্কা আকাশি মাস্ক, গলায় পদ্মছাপ গেরুয়া-সবুজ উত্তরীয়, বুকের কাছে পদ্ম ব্যাজ, চোখে রিমলেস চশমা— মোদী ভাষণ দিতে উঠেই প্রথমে প্রণাম করেছিলেন ব্রিগেড-জনতাকে। পোডিয়ামে ওঠার আগে মাস্ক খুলে নিয়েছিলেন। ভাষণ শুরু করেছিলেন গম্ভীর স্বরে। গলা একেবারে খাদে নামিয়ে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘ভারত মাতা কি...’। জনতা ‘জয়’ধ্বনি দিতেই তিনি দু’হাত উপরে তুলে ‘বন্দে... বন্দে...’ বলতে বলতে জনতার কাছ থেকে আদায় করে নিচ্ছিলেন ‘মাতরম’ আওয়াজ। তার পর কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা। মুহূর্তেই গলা চড়াইয়ে তুলে বললেন, ‘‘কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে আমার সাদর প্রণাম।’’
নিজে প্রণাম করলেও মোদী কিন্তু প্রণাম নেননি। মঞ্চে ওঠার পর পরই মোদীকে উত্তরীয় পরিয়েছিলেন অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তী। প্রধানমন্ত্রী তাঁর দু’হাত জড়িয়ে ধরেন। মিঠুন প্রণাম করতে গেলে তিনি মাঝপথেই আটকে দেন। ধুতি-পাঞ্জাবি পরা মিঠুন ঝুঁকলেও পরমুহূর্তে সোজা হয়ে যান।
মঞ্চে উঠেই এক দিক থেকে অন্য দিকে হাত নাড়তে নাড়তে হেঁটে বেড়িয়েছেন। কিন্তু ভাষণ শুরু হতেই তাঁর শরীর এবং চোখ ক্রমাগত ঘুরছিল ব্রিগেড-জনতার ডাইনে-বাঁয়ে। সম্ভবত মঞ্চের একপাশে পাশে রাখা টেলি প্রম্পটার দেখে ভাষণ দেওয়ার কারণেই প্রধানমন্ত্রীকে প্রায় কখনওই মঞ্চের সোজাসুজি থাকা জনতার দিকে তাকাতে দেখা যায়নি। বক্তব্য শুরুর মিনিট ১৮ পর মঞ্চে-থাকা কারও কাছ থেকে জল চাইলেন। মুখের কাছে ডান হাতের বুড়ো আঙুল নিয়ে গিয়ে ইশারায় বোঝালেন, জল খাবেন। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। তার পর থেকে বার পাঁচেক তাঁকে চুমুক দিতে দেখা গিয়েছে জলের গ্লাসে। ছোট্ট সাদা তোয়ালেতে বেশ কয়েক বার মুখ এবং গাল মুছতেও দেখা গিয়েছে।
মোদীর বক্তব্য মূলত বাঁধা ছিল দু’টি শব্দে— ‘আসল পরিবর্তন’। ওই শব্দবন্ধের ব্যাখ্যায় নিজের ভাষণের তিনটি ভাগকে অত্যন্ত নিপুণতার সঙ্গে জুড়েছেন মোদী। প্রথম ভাগে তিনি ‘স্বপ্নের ফেরিওয়ালা’। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগে ‘আক্রমণাত্মক’। শেষ দুই ভাগে প্রধানমন্ত্রীর আক্রমণ মূলত বিরোধী দল এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কেন্দ্র করে। ‘বাংলা চায় উন্নতি’, ‘বাংলা চায় শান্তি’, ‘বাংলা চায় প্রগতি’, ‘বাংলা চায় সোনার বাংলা’র মতো বাক্য প্রধানমন্ত্রী তুলে ধরেছেন হিন্দি-ঘেঁষা বাংলায়। শেষের দিকে আবারও বললেন, ‘‘ভয় পাবেন না। নির্ভয়ে বিজেপি-কে ভোট করুন। বাংলাকে ভয় মুক্ত করুন। বাংলা উন্নতি চায়। বাংলার জয়। ভারতের জয়।’’
বিকেল ৩টে ৪০ মিনিট। মোদী ফিরলেন তাঁর ‘বন্দে...’ স্লোগানে। সঙ্গে জনতার সঙ্গত ‘মাতরম...’। দ্রুত লয়ে স্লোগান শেষ করে মঞ্চ ছাড়লেন মোদী। ব্রিগেড ময়দানের চার দিক থেকে ওঠা ধুলো তত ক্ষণে ঝাপসা করে দিয়েছে মঞ্চের মোদীকে। মাঠ ফাঁকা হতে শুরু করেছে।
ব্রিগেডে মিটিং শেষ। বিকেল ৩টে বেজে ৪১ মিনিট।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy