চৈত্রের চিড়বিড়ে গরমেও কোনও ঘরে পাখা ঘুরছে না। টানা ছ’মাস এমনই অবস্থা বাঁকুড়ার রানিবাঁধে সিপিএমের জোনাল কমিটির অফিসে। কারণ? বিদ্যুতের বিল প্রচুর বকেয়া। লাইন কেটে দিয়েছে বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা।
এমনই চলবে? জোনাল কমিটির সম্পাদক গুরুপদ মাহাতো বললেন, ‘‘বিল মেটাব। শুধু টাকার পরিমাণ নিয়ে বারগেনিং চলছে।’’
বিদ্যুৎ দফতরের সঙ্গে বকেয়া নিয়ে ‘বারগেনিং’, কে-কোন আসনে লড়বে তা নিয়ে জোটের অন্দরে কংগ্রেসের সঙ্গে আলাপ চলতে পারে। কিন্তু এক সময়কার ঘোষিত শত্রু মাওবাদীদের সঙ্গে প্রাক-ভোট জঙ্গলমহলে দরদস্তুর করার প্রয়োজনই হচ্ছে না বামেদের। বারিকুল-বেলপাহাড়ি-বান্দোয়ান— তিন ‘ব’ নিয়ে তৈরি সাবেক সেই মুক্তাঞ্চলের যেখানে, যতটুকু আনাগোনা বা প্রভাব এখনও আছে মাওবাদীদের, সেখানে উপযাচক
হয়েই তাদের বার্তা— ‘তৃণমূলকে হারাতেই হবে, ভোটটা এ বার সিপিএম-কে দাও’।
রানিবাঁধ বিধানসভার অন্তর্গত বারিকুল এলাকার রামগড় গ্রামের একাধিক বাসিন্দার দাবি, ‘‘মাওবাদীরা তো প্রচার করছে, এ বার তৃণমূলকে হারাতে ভোটটা সিপিএম-কে দিতে হবে।’’ রামগড় গ্রামের বাসিন্দা ও রাউতোড়ার পঞ্চায়েতের তৃণমূলের প্রধান চৈতালি বাস্কেও মেনেছেন, ‘‘রাতে জঙ্গল-পথ দিয়ে গ্রামে ঢুকে মাওবাদীরা আমাদের হারাতে বলছে।’’
ভোটের ফায়দা লুটতে এ বারের এই মাওবাদী উলট-পুরাণে সিপিএম এক রকম উল্লসিত। এতটাই যে, রানিবাঁধের সিপিএম প্রার্থী তথা টানা দু’বারের বিধায়ক দেবলীনা হেমব্রম বলছেন, ‘‘মাওবাদীরাও তো মানুষ, তাঁরাও তো সাধারণ মানুষের জন্যই লড়াই করছেন। তাঁরাও সামিল হোন আমাদের সঙ্গে।’’ আর সিপিএমের রাউতোড়া লোকাল কমিটির সম্পাদক লক্ষ্মীকান্ত টুডুর মুখে খই ফুটছে, ‘‘হাজার হলেও মাওবাদীরা তো কমিউনিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী। গত বার ওদের ভুল হয়েছিল। এখন ভুলটা বুঝতে পেরেছে।’’ গত লোকসভা ভোটের হিসেবে রানিবাঁধ কেন্দ্রে সিপিএম ও কংগ্রেসের ভোট যোগ করলে ১৬ হাজারের বেশি ভোটে এগিয়ে তৃণমূল। দেবলীনা বলছেন, ‘‘মাওবাদীরা আমাদের ভোট দিতে বলছে। এতে সুবিধে হবেই।’’
কিন্তু তৃণমূল-আমলে যৌথ বাহিনীর দৌলতে কোণঠাসা মাওবাদীরা কল্কে পাচ্ছে কী ভাবে?
উত্তর যেন মিলল রাউতোড়ার ৩০ কিলোমিটার দূরে, পুরুলিয়ার বান্দোয়ান পঞ্চায়েতের শিরকা গ্রামে। ইন্দিরা আবাসের প্রাপ্য ঘর পেতে পাঁচ হাজার টাকা করে কমিশন দিতে হচ্ছে— এমনই অভিযোগ গোপাল মাহালি, মণীন্দ্র সিংহ, নির্মল সিংহদের। বান্দোয়ান গ্রাম পঞ্চায়েতও তৃণমূলের দখলে। অথচ ‘পরিবর্তন’-এর পাঁচ বছর পরেও শিরকায় পানীয় দলের সমস্যা মারাত্মক। স্নান ও শৌচকর্মের জন্য জল নেই, সাকুল্যে দু’টো কুয়ো শুকিয়েও খটখটে।
পিচ রাস্তা থেকে দশ কিলোমিটার ভিতরে, জঙ্গল ঘেরা এই গ্রামই বান্দোয়ানে পশ্চিমবঙ্গের শেষ বিন্দু। এক কিলোমিটার দূরে ঝাড়খণ্ডের পূর্ব সিংহভূম জেলার পটমদা এলাকার বীরখাম গ্রাম। যেখানে মাওবাদী স্কোয়াডের ঘন ঘন আনাগোনা এখনও অব্যাহত। ২২ মার্চ রাতে, গ্রামে ঢোকার মুখে কালভার্টের পাশে চার স্থানীয় তৃণমূল নেতাকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলে চিহ্নিত করে তাঁদের অবিলম্বে রাজনীতি ছাড়ার হুমকি দিয়ে পোস্টার সেঁটেছিল মাওবাদীরা। তাদের মধ্যে আছে শিরকার তৃণমূল নেতা তেজো মাহাতোর নামও। তেজোর স্ত্রী পঞ্চায়েত সদস্য। এলাকার যুবক মাধব কর্মকার, থোলু হেমব্রমেরা বলেন, ‘‘হবেই তো। যা করছে এরা (তৃণমূল), পুরোদমে মাওবাদীরা ফিরে এল বলে!’’
বান্দোয়ানের সিপিএম বিধায়ক এবং এ বারেরও প্রার্থী সুশান্ত বেসরা বলেন, ‘‘তৃণমূলের সঙ্গে যোগসাজস করে ওদের যে ক্ষতি হয়েছে, সেটা বুঝতে পেরেছে মাওবাদীরা। সেই জন্যই ওরা এ বার আমাদের সমর্থনের কথা বলছে।’’ লোকসভা ভোটের হিসেবে তৃণমূলের চেয়ে এই আসনে ১৪ হাজারের বেশি ভোটে পিছিয়ে বাম-কংগ্রেস জোট।
জঙ্গলমহলের তৃণমূলের এক নেতা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, এই এলাকায় ২০০৩ থেকে ২০১১ পর্যন্ত বেছে বেছে বামেদের উপরে হামলা করেছে মাওবাদীরা। তাঁর টিপ্পনী, ‘‘বামেরা ভাবছেন, ষাঁড়ের শত্রু বাঘে মারলে তাঁদের সুবিধে। কিন্তু সেই বাঘ তাঁদের উপরে চড়াও হলে কী হবে, সেটা জেনেও ভুলে থাকতে চাইছেন।’’ আর বাঁকুড়া জেলা পরিষদের সভাধিপতি ও তৃণমূলের তরফে জঙ্গলমহলের দায়িত্বে থাকা নেতা অরূপ চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘দ্বিচারিতা, দ্বিচারিতা। না হলে ইন্দিরা গাঁধীকে ‘স্বৈরাচারী, ডাইনি’ বলার পরে তাঁর দলের সঙ্গে কোন মুখে জোট করে বামেরা?’’
মাওবাদীদের অযাচিত সাহায্য নিতে কেমন লাগবে? চুপ করে থাকেন পশ্চিম মেদিনীপুরের লালগড়ের সিপিএম নেতা তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১০-এর সেপ্টেম্বরে লালগড়ের গোটা পার্টি নেতৃত্ব যখন প্রায় এলাকাছাড়া, সেই সময়ে তরুণবাবু নিজের বাড়ির সামনেই মাওবাদীদের হাতে গুলিবিদ্ধ হন। চার-চারটে অস্ত্রোপচার করে, ধারদেনায় আকণ্ঠ ডুবে প্রাণে বেঁচেছেন বটে, কিন্তু এখনও শরীরে যন্ত্রণা ও জটিলতা। কেমন লাগবে ভোটে মাওবাদী-সাহায্য? তরুণবাবুর জবাব, ‘‘দুর্ভাগ্যজনক। যাঁরা এখন মাওবাদীদের প্রতি নরম, তাঁদের তো আমার মতো শারীরিক যন্ত্রণা বা অন্য বাম-কর্মীর মতো স্বজন হারানোর বেদনা পেতে হয়নি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy