এক দিকে শাসকের ‘সন্ত্রাস’ নিয়ে এককাট্টা বিরোধীরা। অন্য দিকে সেই অভিযোগ উড়িয়ে উন্নয়নের ধ্বজা ওড়াতে ব্যস্ত শাসক দল। তাদের মুখে বুলি, ‘রাজনৈতিক সন্ত্রাস এখানে অতীত’। কিন্তু সত্যিই কী খোলামেলা ভাবে নিজের মত প্রকাশের স্বাধীনতা মেলে এ তল্লাটে?
এই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে হুগলির জাঙ্গিপাড়ার আনাচে-কানাচে। পরস্পরের প্রতি আঙুল তুলে কে সাধারণ মানুষের কত কাছের, তা বোঝানোর চেষ্টায় কোনও ত্রুটি রাখতে চাইছে না রাজনৈতিক দলগুলি। দিলাকাশ, রাজবলহাট, সীতাপুর, কুলাকাশের রাস্তা মুখরিত তৃণমূল, জোট, বিজেপির ‘কে কত কাছের’ স্লোগানে।
১৯৭৭ সাল থেকে জাঙ্গিপাড়া জুড়ে সিপিএমের একতরফা প্রাধান্য ছিল। রটনা ছিল, জাঙ্গিপাড়া জোনাল কমিটির সম্পাদক অরূপ বসুমল্লিকের নামে ‘বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খায়’। সিপিএমের দাপটে খড়কুটোর মতো উড়ে যেত বিরোধীরা। ২০১১-র বিধানসভা ভোটের পর অবশ্য ছবিটা উল্টে গিয়েছে। শাসক তৃণমূলেরই এখন রমরমা চতুর্দিকে। এক সময় যে ‘শেষ কথা’ বলতেন সিপিএম নেতারা, এখন তা বলছেন তৃণমূলের নেতারা। এমনই অভিযোগ এখানকার মানুষের।
সিপিএমের অভিযোগ, গত পাঁচ বছরে তাদের উপর অত্যাচার কম হয়নি। দলের জোনাল কার্যালয়ে হামলা, কর্মীদের ভয় সবই হয়েছে। অনেক পার্টি অফিস খোলাই যায়নি। নির্বাচন ঘোষণার পরে এলাকায় কমিশনের নড়াচড়া শুরু হওয়ার পর বন্ধ পার্টি অফিসের তালা খুললেও বহু ক্ষেত্রেই তা ব্যবহার করার জায়গায় নেই। আসলে মানুষই ওদের পাশ থেকে সরে গিয়েছে। সে জন্যই পার্টি অফিস খুলতে পারছে না ওরা, বলছেন তৃণমূলে নেতা-কর্মীরা।
প্রচারের ময়দানে তৃণমূল ও জোটের প্রার্থী। ছবি: দীপঙ্কর দে।
বিদায়ী বিধায়ক তথা তৃণমূল প্রার্থী স্নেহাশিস চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘গত পাঁচ বছরে হুগলির প্রত্যন্ত এই ব্লকে যে পরিমাণে কাজ হয়েছে, বামফ্রন্টের ৩৪ বছরে তা দেখেননি এখানকার মানুষ।’’ উন্নয়নের ফিরিস্তি দিতে শুরু করলেন প্রার্থী—বাম আমলের শেষ দিকে জাঙ্গিপাড়ার তৎকালীন বিধায়ক তথা রাজ্যের উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী সুদর্শন রায়চৌধুরীর চেষ্টায় একটা কলেজ তৈরি হয় বটে, কিন্তু সেটির ইউজিসি-র অনুমোদন ছিল না। রাজ্যসভার সাংসদ তপন সেনের তহবিলের টাকা এবং নিজের এলাকা উন্নয়ন তহবিলের অর্থে কলেজের পরিকাঠামো ঢেলে সাজা হয়। প্রাইভেটে এম এ চালু করা হয়েছে। জাঙ্গিপাড়া, মশাট, সীতাপুর, শিয়াখালা-সব জায়গাতেই রাস্তাঘাট ছিল ভাঙাচোরা। আর এখন সব রাস্তাই পাকা। জাঙ্গিপাড়া হাসপাতালকে আদর্শ গ্রামীণ হাসপাতাল হিসেবে গড়ে তোলা গিয়েছে। এসএনসিইউ-সহ আধুনিক পরিষেবার বন্দোবস্ত করা হয়েছে গ্রামবাসীদের জন্য। রয়েছে ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান। এফসিআইয়ের গুদাম, কিসান মান্ডি, আইটিআই কলেজ হয়েছে।
তৃণমূলের ‘উন্নয়ন’-এর ফিরিস্তি শুনে চোখ কুঁচকেছে বিরোধীদের। তাঁদের বক্তব্য, উন্নয়নের নামে কোটি-কোটি টাকা শুধু লুঠ হয়েছে। বাম-কংগ্রেস জোটের সিপিএম প্রার্থী প্রতীম সিংহ রায় বলেন, ‘‘যে সব রাস্তা হয়েছে বলে ওরা কৃতিত্ব নিচ্ছে, তার অনেকগুলোই বাম আমলে মঞ্জুর হয়ে গিয়েছিল। তা ছাড়া শুধু রাস্তাঘাট আর কয়েকটা ভবন তৈরির নাম যদি উন্নয়ন হয়, তা হলে তা হয়েছে বই কী! কিন্তু মানুষের অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর কী উন্নতি হয়েছে, ওঁরা সেটা বলবেন? অর্থনীতি এবং সামাজিক ক্ষেত্রে অবক্ষয় হয়েছে।’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘মানুষ কিন্তু গত পাঁচ বছরের দুর্নীতি, মুখ বন্ধ করে রাখা, মিথ্যা মামলায় আমাদের কর্মীদের ফাঁসানো, পার্টি অফিসে ভাঙচুর, লুঠপাট, আগুন—এ সবের জবাব চাইবেন।’’
একই সুর সিপিএমের জাঙ্গিপাড়া জোনাল কমিটির সম্পাদক অলোক সিংহরায়ের গলাতেও। তাঁর টিপ্পনি, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকার বা আগের আমলের কাজ নিজেদের বলে চালিয়ে দিচ্ছে ওরা। ভেঙে না পড়লে বোধ হয় ওরা সেটা স্বীকার করবে না!’’ অলোকবাবুর দাবি, ‘‘সিঙ্গুরে ওঁরা গাড়ি কারখানা করতে দিলেন না, কৃষিজমির উপরে হচ্ছে বলে। এখানে গুদাম থেকে আইটিআই কলেজ সবই তো কৃষি খামারের জমিতে হল। আকাশে তো হয়নি! অবশ্য ওই সব করেও মানুষের লাভ কিছুই হয়নি।’’
২০১১র বিধানসভায় তৃণমূল পেয়েছিল ৮৭,১৩৩টি ভোট। তাদের সঙ্গে কংগ্রেসের জোট ছিল। সিপিএম পেয়েছিল ৭৪,০৫৭টি ভোট। বিজেপি পেয়েছিল ৫৬৬৩টি ভোট। ২০১৪র লোকসভায় তৃণমূলের ভোট ছিল ৮৩,১৬২টি। সিপিএমের ৬০,৬৪৯টি। কংগ্রেস পেয়েছিল ৬০৬৬টি ভোট। বিজেপি পেয়েছিল ২৮,০১২টি ভোট। সেই হিসাবে বাম-কংগ্রেস জোটের ভোট জুড়লেও এগিয়ে তৃণমূল।
স্থানীয় সিপিএম, কংগ্রেস নেতৃত্ব অবশ্য এই হিসাবকে মাথায় রাখতে নারাজ। তাঁদের বক্তব্য, ২০১১-র পর একে একে সামনে আসা সারদা, নারদ এবং সব শেষে সদ্য বিবেকানন্দ উড়ালপুল নিয়ে বেকায়দায় পড়েছে তৃণমূল। তাদের সম্পর্কে মানুষের ধারণাও বদলেছে।
তৃণমূল প্রার্থীর অবশ্য দাবি, ‘‘আমরা ক্ষমতায় আসার পর এখানে বিরোধীদের কোনও মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়নি। সবাই নিজেদের মত প্রকাশ করতে পারছেন। জাঙ্গিপাড়ায় এখন আর কেউ কাউকে হুমকি দেয় না।’’ তবে উন্নয়ন নিয়ে চিৎকার করলেও লড়াইয়ে সামনের রাস্তা যে বন্ধুর তাও জানেন স্নেহাশিস। বিশেষ করে দলের মধ্যেই একাংশের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ইতিমধ্যেই নানা প্রশ্ন উঠেছে। প্রার্থী হিসাবে তাঁকে মানতে চাননি অনেকে। বিধায়কের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও ছিল। যা নিয়ে দলের উপর মহলে চিঠিও দিয়েছিলেন ব্লকের যুব নেতা। তাতে কাজ না হওয়ায় পদত্যাগ করেছেন ওই নেতা। দলের শীর্ষনেতারা বিধায়কের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ পাত্তা না দিলেও তৃণমূলের অন্দরে এ নিয়ে জলঘোলা থামেনি। ভোটে তার প্রভাব পড়বে কি না সেই প্রশ্ন ইতিমধ্যেই উঠে গিয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy