ভোটের মিটিং-মিছিল হচ্ছে। স্লোগানে গলাও মেলাচ্ছেন জোহান ওঁরাও, লুসিয়া চিকবরাইকরা। কিন্তু, গলা যে ওঠে না। গলায় জোর হবে কী করে! প্রায় ৬ মাস ধরে দু’বেলা ঠিকমতো খাবার জুটছে না ওঁদের। সরকারি তরফে মাথাপিছু মাসে ১৪ কেজি চাল মিলছে। ফেন ভাত ক’দিন খাওয়া যায়? পাথর ভেঙে, বাগানের পাতা তুলে তা বিক্রি করে কখনও শাক-সব্জি কেনা যাচ্ছে। আবার কখনও চেয়েচিন্তে চালাতে হচ্ছে। কাজেই ভোটের মিছিলে পা মেলালেও নেতার সুরে সুর মেলে না ডুয়ার্সের কুমলাই চা বাগানের প্রায় ১১০০ স্থায়ী শ্রমিকের।
অথচ ৬ মাস আগেও বেশ চলছিল ‘কিং অব ডুয়ার্স’। মানে কুমলাই চা বাগান। একটা সময়ে কুমলাইয়ের চা পাতার মান অন্য বাগানগুলিকে টেক্কা দিয়েছিল বলে ‘কিং অব ডুয়ার্স’ শিরোপা আদায় করেছিল। সব ঠিকঠাক ছিল। আচমকাই যেন অন্ধকার নামে ডুয়ার্সের কুমলাই চা বাগানে। গত ১৪ নভেম্বর বাগান বন্ধ করে চলে যান মালিকপক্ষ। শ্রমিকদের অভিযোগ, মালিকপক্ষের আর একটি বাগান গ্রাস মোড় দারুণ চলছে। এখন মালিকরা কুমলাইয়ের কারখানা বন্ধ করে দিতে চান। এখানকার পাতা গ্রাস মোড়ে নিয়ে যাবেন। সেখানেই একযোগে চা তৈরি হবে। কিন্তু, শ্রমিকরা তাতে নারাজ। কারণ, কারখানা বন্ধ হলে অনেক শ্রমিক কাজ হারাতে পারেন। তা নিয়ে কয়েক দফায় ত্রিপাক্ষিক বৈঠক ডাকা হলেও মালিকপক্ষের কেউ যাননি বলে অভিযোগ।
তবে কারখানার তৃণমূল প্রভাবিত শ্রমিক সংগঠনের নেতা মনোজ দাস বলছেন, ‘‘ভোটটা মিটলেই মালিকপক্ষের সঙ্গে বসা হবে। যে ভাবে হোক বাগান চালু করার ব্যবস্থা করতে আমাদের নেতারা চেষ্টা করে চলেছেন।’’ কংগ্রেস প্রভাবিত চা শ্রমিক সংগঠন কিংবা সিটুর নেতারাও আশ্বাস দিচ্ছেন। ভোটের বাজারে নেতাদের প্রতিশ্রুতি শুনে তাঁদের সভা-সমাবেশে হাজিরা দিলেও রাতে কিন্তু ঘুমোতে পারেন না ছেনো ওঁরাও, আশা ওঁরাও, আসাড়ি মুন্ডারা। ছেনো বলেন, ‘‘আমার স্বামী কাজ করতে বাইরে। দু ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করে। সারা দিন দিনমজুরি করে যা জোটে তা দিয়ে সংসার চলছে। ছেলেমেয়েদের ভাল করে খেতে দিতে পারি না। রোজ রাতে শোওয়ার সময়ে চিন্তা করি কাল কী দিয়ে ভাত দেব! ঘুম যে আসে না।’’
তবুও সাতসকালে উঠে পতাকা হাতে মিছিলে যোগ দিতে ছোটেন অনেকেই। কারণ, মিছিলের পরে চা-জলখাবারের বন্দোবস্ত থাকে যে। ছেলেমেয়ের জন্য লুচি-সবজি শালপাতায় মুড়ে ঘরে নিয়ে যাওয়া যায়। লুসিয়া বলেন, ‘‘আমাদের চোখে আর জল আসে না। এ ভাবেই চলছে। জানি না কবে বাগান খুলবে। ভোটের সময়ে ভাল লাগে একটাই ব্যাপার। তা হল, সব নেতারাই বলেন, ভোটের পরে বাগান খুলবে। কাজ হবে কি না হবে জানি না। কিন্তু শুনতে তো ভাল লাগে।’’
ডুয়ার্সে মোট চা বাগানের সংখ্যা ১৫৩। তার মধ্যে ২০টির মতো চা বাগান বন্ধ বা অচলাবস্থায় ভুগছে। এর মধ্যে বীরপাড়া, কালচিনি এলাকায় ডানকান গোষ্ঠীর ৭টি চা বাগান রয়েছে, রেডব্যাঙ্ক গোষ্ঠীর রয়েছে ৩টি বাগান। শতাংশের দিক থেকে ডুয়ার্সের ৯০ শতাংশের কাছাকাছি চা বাগান এই মুহূর্তে স্বাভাবিক রয়েছে। যে ক’টি চা বাগানে সমস্যা তার মধ্যে আবার রেডব্যাঙ্ক গোষ্ঠীর চা বাগানের জমির লিজ বাতিল করে দিয়েছে রাজ্য সরকার। সমবায়ের ভিত্তিতে বাগানে পরীক্ষামূলক ভাবে কাজও চলছে। যেখানে সিংহভাগ চা বাগানে সমস্যা নেই সেখানে সামান্য কয়েকটি চা বাগানে যেখানে দিনের পর দিন ধরে সমস্যা জিইয়ে রাখা আছে সেখানে স্বাভাবিক চা বাগানগুলো কী ভাবে চলছে, তার রসায়ন বন্ধ বাগানে কেন কার্যকর করা হচ্ছে না প্রশ্ন উঠছে তা নিয়েও।
গত পঞ্চাশের দশকে চা বাগিচা আইন তৈরি হলেও আজ পর্যন্ত সেই আইন বদল বা পরিমার্জন হয়নি। দুর্বল বাগানের ওপর চাপ কমাতে এই আইনে দ্রুত বদল আনা জরুরি বলে মনে করেন মালিকপক্ষের সব কটি সংগঠনই। আইটিপিএ, ডিবিআইটি-র মতো সংগঠনগুলো মনে করে, পঞ্চাশের দশকে ডুয়ার্সে হাসপাতাল, স্কুল, সড়ক কিছুই ছিল না। তাই সব দায়িত্বই চা বাগান মালিকের ওপর বর্তেছিল। পরবর্তীতে গ্রাম পঞ্চায়েত স্থাপন হয়েছে। আশির দশকে চা বাগান পঞ্চায়েতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। শহর বাজারে হাসপাতাল, সরকারি স্কুল সবই হয়েছে। তাই মালিকপক্ষ চাইছেন, বাগান সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় আইন সংশোধন হোক। তাতে অনেক জটিলতা কমে যাবে। বাগানে পর্যটন প্রসারের রাস্তাও মসৃণ হবে। কর্মসংস্থানের বিকল্প সুযোগ তৈরি হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy