—প্রতীকী ছবি।
কেমন আছেন বাসিন্দারা। কোন বাঁকে রাজনীতি। আখ্যান জঙ্গলমহলের
ভরদুপুরে গৃহস্থের বাড়িতে ঢুকতে কেমন যেন অস্বস্তি হয়। হয়তো বা বিশ্রাম নিচ্ছেন বাড়ির লোকজন। বাঁশপাহাড়ির চাকাডোবা গ্রামে ওই বাড়িতে ঢুকতেও প্রাথমিক ভাবে অস্বস্তি ছিল। কিন্তু কোথায় কী! বাড়ির সবাই কাজে মগ্ন। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে কুলো, ঝুড়ি থেকে শুরু করে নানা ধরনের সরঞ্জাম তৈরিতে ব্যস্ত সবাই।
বাড়ির উঠোনে প্লাস্টিকের চেয়ার টেনে এনে বসান তপন ও তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মী। মাটির তৈরি পাশাপাশি ঘর, সে ঘরের সামনে ইটের দেওয়াল একদা উঠেছিল বটে, কিন্তু তা আর সম্পূর্ণ হয়নি। বিষণ্ণ হাসেন তপন মাহালি, ‘‘টাকা পাব কোথায়? তাই আর হয়নি।’’ ১৯৯৮ থেকে মাওবাদী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তপন। ২০০১-এ আত্মসমর্পণ করেন তিনি।
কিন্তু ওই পর্যন্তই। সেই থেকে এ পর্যন্ত কোনও চাকরি জোটেনি তাঁর। প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন অনেক, তবে তাতে পেট ভরেনি। ছেলে পড়ে কলেজে, মেয়ে স্কুলে। তপনের বাবা শ্রাবণকেও পুলিশ গ্রেফতার করেছিল মাওবাদী-যোগের অভিযোগে। তাঁকে এমনকি, কেএলও-র হিংসাত্মক কার্যকলাপের মামলায় জড়িয়ে শিলিগুড়িতে চালান করা হয়।
তপন সমাজের মূলস্রোতে ফিরেছেন বটে, কিন্তু সমাজ কি তাকে মূলস্রোতে মিশিয়েছে? এ প্রশ্ন তাঁর নিজেরই। বাড়ির দাওয়ায় বসে বছর চল্লিশের তপন বলেন, ‘‘একশো দিনের কাজও পাইনি।’’ আত্মসমর্পণের পরে জামশেদপুরে ঠিকাদারের অধীনে কাজ করতেন তপন। এখন সংসার চলছে কী করে? তপন ছাড়াও তাঁর স্ত্রী, মা, দাদা কঞ্চির কাজ করেন। সেই ঝুড়ি, কুলো বাজারে বেচতে যান তপনরা।
জঙ্গলমহলের একদা ত্রাস এই মাওবাদীদের আত্মসমর্পণের ক্ষেত্রে রাজ্য প্রশাসন তাদের কথা রাখছে না বলে তপনদের মতো অনেকেরই অভিযোগ। তবে সকলেই তপনের মতো দুর্ভাগা নন। যেমন আনন্দ মুড়া। বাড়ি বাঁশপাহাড়ির চাকাডোবা গ্রামে। তিনিও আত্মসমর্পণকারী মাওবাদী। কিছু দিন আগেই স্পেশাল হোমগার্ড পদে নিয়োগপত্র হাতে পেয়েছেন ৫২ বছর বয়সে। নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে তিনি ও তাঁর মতো আরও কয়েক জন এই নিয়োগপত্র হাতে পান।
আনন্দ ’৯৫ সাল থেকে মাওবাদী সংগঠন এমসিসি-র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে পিডব্লিউজি-র সঙ্গে দলটি মিশে যায়। তৈরি হয় সিপিআই (মাওবাদী)। জঙ্গলমহলে মাওবাদী আন্দোলন যখন তুঙ্গে, সে সময় ২০০৮-’০৯-এ জামশেদপুরে পালিয়ে যান আনন্দ। চাকাডোবা গ্রামের বাড়িতে বসে আনন্দ যা বলতে থাকেন, তাতে তাঁর গলায় যথেষ্ট সংশয়ের সুর শোনা যায়। ‘‘জানি না, কী হবে। বাড়িতে ছেলে-মেয়ে-বউ। এক দিন যে পুলিশের সঙ্গে লড়াই করেছি, সেই পুলিশের সঙ্গেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করব!’’
শুধু সেটাই কি অস্বস্তির কারণ? কথা বলতে বলতে আনন্দ বলে ফেলেন, ‘‘জঙ্গলমহলে যদি কোনও দিন ওরা আবার ফিরে আসে, সে দিন কী হবে জানি না!’’ বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না, ‘ওরা’ বলতে তিনি কী বলতে চান! আনন্দের ছেলে সৌরভ মাধ্যমিক দেবে। মেয়ে তনুশ্রী ভূগোলে অনার্স নিয়ে প্রথম বছর। দারিদ্রে মোড়া আনন্দের সংসার। স্ত্রী বেহুলা অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে রান্না করেন। কিন্তু অফুরান প্রাণশক্তি। এ বার মুক্ত বিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক দিয়েছেন তিনি।
আত্মসমর্পণকারী মাওবাদীদের নিয়ে কিন্তু সৃষ্টি হয়েছে এক সামাজিক সঙ্কটও, যা কার্যত অদৃশ্য। যেমন, আনন্দের সঙ্গে আরও যে ১৩ জন আত্মসমর্পণ করেছিলেন, এখনও চাকরি হয়নি তাঁদের। এই নিয়ে নানা কটাক্ষের মধ্যে পড়তে হচ্ছে বেহুলাদের।
সঙ্কট আরও আছে। মাওবাদীদের হাতে নিহত, নিখোঁজ বা জখমদের পরিবারের যাঁরা একই সঙ্গে হোমগার্ডের ট্রেনিং নিচ্ছেন, তাঁরা অনেকেই তা করতে চাইছেন না। কেউ কেউ বলছেন, ‘ওদের হাতে আমাদের বাবা-কাকা-বেটারা মরেছে, আর আমরাই ওদের সঙ্গে ট্রেনিং নেব?’ এই কারণে ইতিমধ্যেই দু’জন চাকরি ছেড়েছেন। ‘মাওবাদী হানায় শহিদ ও নিখোঁজ পরিবারের যৌথ মঞ্চ’-র সম্পাদক শুভঙ্কর মণ্ডল যেমন বলছেন, ‘‘যারা আমাদের পরিবারকে মারল, তাদের সঙ্গেই ট্রেনিং করতে কি মন চায়? আপনিই বলুন! চাকরির সুবাদে যদি একসঙ্গে পোস্টিং হয় সেটা কোনও মতে মেনে নিতে হবে।’’ শুভঙ্করের ভাইও মাওবাদীদের হাতে খুন হন।
এই মঞ্চের পক্ষ থেকে রাজ্য পুলিশ-প্রশাসনের কাছে মাওবাদীদের হাতে ক্ষতিগ্রস্ত ৪৫৫টি পরিবারের এক জন করে চাকরির দাবি জানিয়ে একটি তালিকা পেশ করা হয়েছিল। তার মধ্যে এখনও পর্যন্ত প্রায় ৩৩৫ জন হোমগার্ডের চাকরি পেয়েছেন। শুভঙ্কর জানান, ঝাড়গ্রাম জেলা ছাড়া বাঁকুড়ায় ৪১ জন, পুরুলিয়ায় ৩৮ জন ও পশ্চিম মেদিনীপুরের ৯৩ জন
চাকরি পেয়েছেন।
কিন্তু সমস্য আরও তীব্র ‘নিখোঁজ’দের নিয়ে। যেমন, ঝাড়গ্রামে নিখোঁজ আছেন ৮৩ জন। পশ্চিম মেদিনীপুরে ২৫ জন। এঁদের কারও ডেথ সার্টিফিকেট নেই। কোনও পরিবারের দুই ভাই নিখোঁজ। তাঁদের স্ত্রীরা সরকারি বা বেসরকারি কোনও সাহায্য পাচ্ছেন না।
বেলপাহাড়ির কংগ্রেস নেতা সুব্রত ভট্টাচার্য বাম সরকারের আমলে মাওবাদীদের আত্মসমর্পণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর কথায়: ‘‘যথাযথ তালিকা তৈরি করে মাওবাদীদের চাকরি বা পুনর্বাসনের এই বৈষম্য দূর করার দরকার। যাঁরা চাকরি পেয়েছেন বা পাননি, এমন লোকেদের ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখাটা খুবই জরুরি। সরকারকে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে, এই বৈষম্য যেন নতুন করে সামাজিক সঙ্কটের সৃষ্টি না করে।’’
যে মাওবাদী হিংসাকে কেন্দ্র করে জঙ্গলমহলের রাজনীতি আবর্তিত হয়েছে বছরের পর বছর, সেই রাজনীতিরই ধ্বংসাবশেষের আগুন এখনও নেভেনি। কবে সম্পূর্ণ নিভবে, তা কি জঙ্গলমহল নিজেও জানে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy