সেতু দুর্ঘটনায় স্বামীকে হারিয়েছেন চৈতালি। পাশে জা মিঠু ভট্টাচার্য। প্রতিবাদে ভোট বয়কট করেছেন দু’জনেই। —নিজস্ব চিত্র।
ভোটের বুথে কেউ ছেলের কথা তুলবেন কি না, ভেবে দুশ্চিন্তায় ছিলেন বৃদ্ধ। কেউ উচ্চবাচ্য না-করায় যেন শান্তি পেলেন কৃষ্ণচন্দ্র দত্ত। ভোট দিয়ে বেরিয়ে ৮৬ বছরের বৃদ্ধ বললেন, ‘‘আমি আগ বাড়িয়ে কাউকে আমার মরা ছেলের কথা বলিনি। ওরা খেয়াল করলেই ভূতে এসে ওর ভোটটাও দিয়ে দিত।’’
পুত্রহারা বৃদ্ধের বৌমা অবশ্য একটু অন্য রকম ভাবছেন। বিবেকানন্দ উড়ালপুলের নীচে দুর্ঘটনার বলি তপন দত্তের স্ত্রী কুমকুমের ধারণা, কে আছেন আর নেই— ওদের নিশ্চয়ই হিসেব করাই আছে! সুতরাং মৃত স্বামীর ভোটটা যে শেষমেশ কেউ দিয়ে দেননি, নিশ্চিত হতে পারছেন না তিনি।
উড়ালপুল বিপর্যয়ে প্রিয়জন হারানোর শোকও ভোটের দিনে তাই অন্য ব্যঞ্জনা পেল। টেগোর ক্যাসল রোডের আদ্যিকালের বাড়ির ভাড়াটে, সদ্যপ্রয়াত তপন দত্তের ছেলে, কলেজপড়ুয়া ধীমানের এখনও তালিকায় নাম তোলা হয়নি। তপনবাবুর স্ত্রীর এ বার ভোট দিতে যেতে পা সরছিল না। কিন্তু বৃদ্ধ শ্বশুরমশাইয়ের তাড়নায় নিজের ভোট ‘নষ্ট’ হওয়া ঠেকাতেই যেতে হল। শ্যামপুকুর কেন্দ্রের নতুনবাজারে বালকৃষ্ণ বিঠ্ঠলনাথ বালিকা বিদ্যালয়ে যাওয়ার সময়েও শ্বশুরমশাই বারবার বোঝালেন, ‘‘তপনের নামটা আগ বাড়িয়ে কাউকে বলবার দরকার নেই। তা হলেই দেখবে, ওর নামেও জাল ভোট পড়ে গেল।’’
সকালে আলমারির লকার খুলেই স্বামীর ভোটার কার্ডটা চোখে পড়েছিল কুমকুমের। তখন থেকেই ভিতরটা খাঁ-খাঁ করছে। ভোট দিতে যাওয়ার সময়ে আর থাকতে পারলেন না। স্বামীর নাম লেখা নির্বাচন কমিশনের কাগজটা নিস্ফল আক্রোশে কুচিকুচি করে ছিঁড়লেন তিনি। উত্তর কলকাতার এই হতভাগ্য ভোটারেরা যেখানে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রযোগ করলেন, তার ঢিল ছোড়া দূরত্বে নতুনবাজার রাজবাড়ি চত্বর। ভোট নিয়ে এলাকায় যাবতীয় জল্পনা-উত্তেজনার পটভূমিতে কানদোই পরিবারের ফ্ল্যাটখানা সেখানে থম মেরে রয়েছে। পুত্র-পুত্রবধূ অজয় ও সরিতা কানদোই এখন বাড়ির ঠাকুরঘরে ছবি। ৭৫ বছরের গৃহকর্তা জগদীশপ্রসাদ কানদোইকে সংসার চালাতে বেহাল হাঁটুতেই জোড়াবাগানের কাঠগোলায় যেতে হচ্ছে। হেঁসেল সামলাচ্ছেন বৃদ্ধা বিমলা দেবী। দু’জনের কেউই বুথমুখো হলেন না।
দু’জনেই অবশ্য ভোট দিয়েছেন বৃহস্পতিবার। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য।
অজয়-সরিতার দুই ছেলে, সদ্য যুবক অভিষেক ও নিখিল অবশ্য রবীন্দ্র সরণির উপরে মহেশ্বরী স্কুলে ভোটটা দিয়ে এসেছেন। নিচু গলায় অভিষেক বললেন, ‘‘ভোটে জিতে কেউ জনগণের ভাল করবে ভেবে আর ভোট দিই না।এ শহরে মাথার উপরে উড়ালপুল ভেঙে পড়ে শুধু মা-বাবাকেই কেড়ে নেয়নি, সব কিছুর উপরে বিশ্বাসটাও ভেঙে দিয়েছে।’’ চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি পাঠরত অভিষেক বা বাংলা অনার্স প্রথম বর্ষ ধীমান তবু সরকারি প্রতিশ্রুতির দিকে চেয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। সরকারি চাকরির জন্য তাঁদের নথি জমা দিতে বলা হয়েছে। ‘‘ভোটের পরে সত্যিই মিলবে তো সরকারি চাকরি,’’— এই আশাটুকুই বাধ্য হয়ে আঁকড়ে রয়েছেন তপন দত্তের পুত্র।
একই দশা নিহত গোলাপ মালির পুত্র বিকাশ ওরফে বান্টিরও। কালীকৃষ্ণ ঠাকুর স্ট্রিটের মুখে তাঁর বাবা গোলাপের ফুলের ডালার উপরেই ভেঙে পড়েছিল উড়ালপুল। এর পর থেকে মা-ছেলের খাওয়া, না-খাওয়ার ঠিক নেই। এ তল্লাটে ঠিক ভোটের আগের দিনই বান্টির বিয়ে ঠিক ছিল। সে সবও ভেস্তে গিয়েছে। সরকারি চাকরির আশা নিয়ে তাকিয়ে থাকা বান্টি ও তাঁর মা মালতী এ দিন বুথমুখো হলেন না।
জোড়াসাঁকো ও শ্যামপুকুর কেন্দ্রের সীমানায় রাজপথ জুড়ে পড়ে থাকা ধ্বংসস্তূপ, ক্রেনের তাণ্ডব ও বিকট শব্দই যেন ভোটের সুরটা বেঁধে দিল। কালী মন্দিরের মাথায় এক নম্বর কালীকৃষ্ণ ঠাকুর স্ট্রিটে উড়ালপুলের নীচে ভেঙে পড়া গাড়িবারান্দার ভগ্নাংশটুকু লেগে আছে। দোতলার জানলা খুললেই ধ্বংসস্তূপের অন্ধকার। ভাঙাভাঙির শব্দে বাড়িটাই কেঁপে কেঁপে ওঠে। সাবেক বাসিন্দা ভট্টাচার্যেরা ওই বাড়ির দোতলার ঘরেই ভোটের দিনটা গুমরে পড়ে রইলেন।
আগের রাতে শাসক দলের প্রার্থী স্মিতা বক্সী তাঁদের বাড়ি এসে বুথে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু বাড়ির ছেলে উত্তম ভট্টাচার্য সদ্য মারা গিয়েছেন। উড়ালপুল দুর্ঘটনার সময়ে পালাতে গিয়ে পড়ে চোট পান তিনি। তা থেকে জটিলতার জেরেই তাঁর মৃত্যু বলে পরিজনেদের দাবি। উত্তমবাবুর স্ত্রী চৈতালি, বোন, ভাইয়ের ছেলে-মেয়েরা সবাই এক জায়গায় বসে। চৈতালি বললেন, ‘‘আমাদের ভোট পুল ভাঙার দিনেই চুকে গিয়েছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy