গত ২১ নভেম্বর প্রকাশিত আনন্দবাজার। (ডান দিকে) ষাটপলশায় সিপিএম প্রার্থীর সমর্থনে মিছিল। (ইনসেটে) মিছিলে সে দিন জখম হওয়া ফরিদার রহমান।—নিজস্ব চিত্র
ঘা শুকোলেও শরীরে এখনও রয়ে গিয়েছে ক্ষত। অনেকের ভাঙা হাত-পা আজও জোড়া লাগেনি। আর তাঁরাই দলীয় পতাকা ধরে পা টেনে টেনে হাঁটলেন মিছিলে।
হাঁটলেন সেই পথ দিয়ে, যেখানে ঠিক পাঁচ মাস আগেই আক্রান্ত হতে হয়েছিল তাঁদের। সেদিন আক্রান্ত নেতাদের অন্যতম, ময়ূরেশ্বর কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী অরূপ বাগের সমর্থনেই দেখা গেল এমন দৃশ্য। শনিবার ময়ূরেশ্বরের ষাটপলশা এলাকার দাঁড়কান্দি থেকে ষাটপলসা তৃণমূলের পার্টি অফিস পর্যন্ত ওই মিছিলের ডাক দিয়েছিল বাম-কংগ্রেস জোট। ২০১১ সালের পরে এলাকায় এত বড় মিছিল দেখে উজ্জীবিত জোটের নেতারা।
ঘটনা হল, গত ২১ নভেম্বর ষাটপলশায় সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রামচন্দ্র ডোম, এলাকার প্রাক্তন বিধায়ক তথা প্রাক্তন সভাধিপতি ধীরেন লেট, বিদায়ী বিধায়ক অশোক রায়, জেলা সম্পাদক মনসা হাঁসদা, জেলা কমিটির সদস্য তথা ময়ূরেশ্বর কেন্দ্রের এ বারের প্রার্থী অরূপ বাগের নেতৃত্বে জাঠা মিছিলের আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু, সেই মিছিল সম্পূর্ণ হয়নি। মাঝপথেই হামলা চালায় দুষ্কৃতীদের দল। নেতা-কর্মীদের অনেকের হাত-পা ভেঙে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়। এমনকী, প্রবীণ ধীরেনবাবুকে কান ধরে ওঠবোস করিয়ে ‘আর সিপিএম করব না’ বলতে বাধ্য করানোরও অভিযোগ। সেই দৃশ্য মোবাইলে তুলে ছড়িয়েও দেওয়া হয়। প্রাণ ভয়ে বাম নেতা-কর্মীরা সে দিন মিছিল ছেড়ে মাঠ দিয়ে দৌড়ে পালাতে বাধ্য হন। মারাত্বক আহত অবস্থায় বিনা চিকিৎসায় স্থানীয় একটি আদিবাসী পাড়ায় দীর্ঘক্ষণ আত্মগোপন করে পড়েছিলেন অরূপ বাগ, জোনাল কমিটির সদস্য শৈলেন দাঁ, ডাবুক পঞ্চায়েতের প্রাক্তন প্রধান ফরিদার রহমানেরা। সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরাই সে দিন তাঁদের উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দেন। গোটা ঘটনায় নিশানায় শাসকদল তৃণমূল থাকলেও তারা অভিযোগ মানতে রাজি হয়নি।
সে দিনের সেই বীভৎস স্মৃতি আজও ভোলেননি ফরিদার। আজও জোড়া লাগেনি তাঁর ভাঙা ডান হাত, ডান পা। আজও মাথার সেলাইয়ে হাত পড়লে টনটন করে ধীরেনবাবু, অরূপবাবুদের। ঘা শুকোলেও আজও শরীরের বিভিন্ন অংশে ক্ষতচিহ্ন রয়ে গিয়েছে শৈলেন দাঁ, কানাই বাগদি, চরণ পালদের। কিন্তু, অধিকাংশেরই চোখেমুখে সে দিনের সেই ভীত-সন্ত্রস্ত্র ভাবটুকু নেই। বরং শারীরিক প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি অধিকাংশেরই চোখেমুখে কেমন যেন অদম্য চাঙা ভাব। ভাল করে হাঁটতে পারছিলেন না ফরিদার। তবু ব্যান্ডেজ বাঁধা হাতে পতাকা ধরেই স্লোগানে গলা মেলাচ্ছিলেন তিনি। পরে বললেন, ‘‘সে দিন প্রাণে বাঁচব ভাবিনি। দু’বার অস্ত্রোপচারের পরেও হাত-পা জোড়া লাগেনি। কিন্তু মিছিলের কথা শুনে আর ঘরে বসে থাকতে পারিনি। প্রতিবেশীর মোটরবাইকে চড়ে ২০ কিলোমিটার দূর থেকে ছুটে এসেছি।’’
শুধু ফরিদারই নয়, আক্রান্তদের অনেককেই যোগ দিতে দেখা গিয়েছে এ দিনের মিছিলে। এলাকার নির্বাচনী দায়িত্বপ্রাপ্ত সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য দীপঙ্কর চক্রবর্তীর পাশাপাশি ছিলেন কংগ্রেসের নেতা-কর্মীরাও। মিছিলকে রীতিমতো নেতৃত্ব দিতে দিতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন সে দিন সব থেকে বেশি নিগ্রহে ও অত্যাচারের মুখে পড়া প্রবীণ ধীরেনবাবু। অরূপবাবুর দাবি, ‘‘তৃণমূলের সন্ত্রাসের ভয়ে সে দিনের জাঠায় ৩০০ মানুষকে সামিল করতে বেগ পেতে হয়েছিল। আর এ দিন প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ স্বতস্ফূর্ত ভাবে মিছিলে যোগ দিয়েছেন। বহু দিন পরে এলাকায় এত বড় মিছিল হয়েছে।’’ পুলিশের যদিও দাবি, মিছিলে হাজার তিনেক লোক হয়েছিল।
বস্তুত, কয়েক মাস আগেও মিছিলের ডাক পেলে এলাকার সাধারণ সমর্থকরা তো বটেই নেতা-কর্মীদেরও অনেকের নানা অছিলায় এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা ছিল বলে সিপিএম কর্মীদেরই একাংশ জানাচ্ছেন। কিন্তু, কী এমন ঘটল যে মিছিলে লোক উপচে পড়ছে? এলাকার বিদায়ী বিধায়ক অশোকবাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘প্রথমত, নির্বাচন কমিশনের ভরসায় মানুষের ভয় ভেঙেছে। তৃণমূলের লাগামছাড়া অত্যাচার আর দুর্নীতিতেও মানুষ বীতশ্রদ্ধ। তারই প্রতিফলন এ দিনের মিছিল।’’ অন্য দিকে, মিছিলের ভিড় দেখে রীতিমতো উজ্জীবিত ধীরেনবাবু। তাঁর বক্তব্য, ‘‘এলাকায় সন্ত্রাস কায়েম করতেই জাঠার দিন তৃণমূলের গুন্ডারা আমাদের উপর হামলা চালিয়েছিল। সাধারণ মানুষ যে তা ভাল চোখে দেখেনি, তার প্রমাণ এই জমায়েত। এই একজোট হওয়া মানুষই এ বার তৃণমূলের ভোট-লুঠ রুখে দেবে।’’
সিপিএম নেতাদের মুখে এমন ব্যাখ্যা শোনা গেলেও জেলার রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞেরা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকের কথা। ষাটপলশা এলাকাতেই জেলা পরিষদের খাদ্য কর্মাধ্যক্ষ জটিল মণ্ডলের বাড়ি। ওই তৃণমূল নেতার দাপটে বাঘে-গরুতেও একঘাটে জল খায় বলে এলাকায় প্রচলিত আছে। লিখিত অভিযোগে নাম না থাকলেও এলাকায় কান পাতলে শোনা যায়, বামেদের জাঠায় হামলায় তাঁর ‘ভূমিকা’র কথা। গত বার অশোকবাবুর কাছে হারলেও এ বারও ময়ূরেশ্বর কেন্দ্রে তিনি-ই ছিলেন প্রার্থী পদের প্রধান দাবিদার। দলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের ‘আশীর্বাদ’ও ছিল তাঁর মাথায়। তার পরেও দল তাঁকে বাদ দিয়ে প্রার্থী করেছে অভিজিৎ রায়কে। তাতেই বেজায় চটেন জটিল। জেলা নেতৃত্বের দৃষ্টি আর্কষণের জন্য প্রার্থী বদলের দাবিতে দলের ষাটপলশা কার্যালয়ে বিক্ষোভ সংঘটিত করার অভিযোগও ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে।
পরে অবশ্য অভিজিৎবাবুর সমর্থনে সম্প্রতি বিভিন্ন সভা-সমাবেশে দেখা যাচ্ছে তাঁকে। জটিলের অনুগামীদেরই একাংশের দাবি, ‘‘দাদা এখনও বিষয়টিকে মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। প্রচারে যোগ দিলেও ক্ষতটা রয়েই গিয়েছে। তাই পাঁচ বছর আগের মতো সক্রিয় হতে দেখা যাচ্ছে না দাদাকে।’’ জটিলের এই ‘নিষ্ক্রিয়তা’ই বামেদের সংগঠিত করতে অনেকটাই সাহায্য করেছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত। জটিলবাবু অবশ্য সেই ব্যাখ্যা উড়িয়েই দিয়েছেন। তাঁর পাল্টা দাবি, ‘‘দলীয় প্রার্থীকে জেতাতে আমার সক্রিয়তায় কোনও খামতি নেই। বামেদের মিছিলে মেরে কেটে ১০০০-১২০০ লোক হয়েছিল। অধিকাংশই বহিরাগত। তাই ওই মিছিল নিয়ে আমাদের কোনও চিন্তা নেই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy