Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
দক্ষিণদাঁড়ি

ডান্ডা উঠতেই ঠান্ডা সুজিতের গড়

ঠান্ডা গলায় একটাই কথা, ‘‘ষাট সেকেন্ড প্লাস ষাট সেকেন্ড। এই ভিড়টা সাফ করতে ঠিক দু’মিনিট লাগবে। আমাদের অ্যাকশন করতে দিন। আটকাচ্ছেন কেন?’’ লেকটাউন থানার এসআই-কে বললেন সিআরপি-র অফিসার।

কেন্দ্রীয় বাহিনীর গাড়ি আটকে বিক্ষোভ সুজিত বসুর। — নিজস্ব চিত্র

কেন্দ্রীয় বাহিনীর গাড়ি আটকে বিক্ষোভ সুজিত বসুর। — নিজস্ব চিত্র

সুরবেক বিশ্বাস ও সোমনাথ চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৬ ০১:৩৩
Share: Save:

ঠান্ডা গলায় একটাই কথা, ‘‘ষাট সেকেন্ড প্লাস ষাট সেকেন্ড। এই ভিড়টা সাফ করতে ঠিক দু’মিনিট লাগবে। আমাদের অ্যাকশন করতে দিন। আটকাচ্ছেন কেন?’’ লেকটাউন থানার এসআই-কে বললেন সিআরপি-র অফিসার। চোখ থেকে যেন আগুন ঠিকরোচ্ছে।

জওয়ানদের উল্টো দিকে মারমুখী শ’দুয়েক ক্ষিপ্ত নারী-পুরুষের ভিড়। যে কোনও মুহূর্তেই দু’পক্ষ একে অপরের দিকে তেড়ে যাবে, এমন পরিস্থিতি তখন।

দক্ষিণদাঁড়ির ২৭ নম্বর রেলগেট লাগোয়া কাঠপাড়া বস্তি। সোমবার দুপুর আড়াইটে। ততক্ষণে এক প্রস্ত ইট ছোড়া হয়েছে সিআরপি-কে লক্ষ্য করে। লাইন থেকে পাথর কুড়িয়েও এলোপাথাড়ি ছুড়েছে জনতা।

দুপুর ১টার পর থেকেই নেহরু কলোনি ৫ নম্বর ফ্রি প্রাইমারি স্কুলের নির্বাচনী কেন্দ্রকে ঘিরে সাতশো মিটার দূরত্ব পর্যন্ত ইতিউতি জটলা। সিপিএম-কংগ্রেস জোটের পক্ষ থেকে অভিযোগ, সকালে শান্তিপূর্ণ ভাবে সব কিছু চললেও শেষ কয়েক ঘণ্টায় ছাপ্পা ভোট দিতে এবং বৈধ ভোটারদের ভয় দেখাতে ওই সব ছোট-ছোট জমায়েত করা হচ্ছিল। কেন্দ্রীয় বাহিনী বারবার উঠে যেতে বললেও জমায়েত ওঠেনি। স্থানীয় বাসিন্দারাই জানাচ্ছেন, কথায় কাজ না হওয়ায় দুপুর ২টো নাগাদ সিআরপি লাঠিচার্জ শুরু করে জমায়েত হটাতে।

সেই সময়ে বাড়িতে দুপুরের খাবার খেয়ে বুথের উদ্দেশে রওনা হওয়া, ১১৭ নম্বর বুথের তৃণমূল এজেন্ট মহম্মদ রুল আমিনকেও লাঠি মেরে সিআরপি পিঠ ফাটিয়ে দেয় বলে অভিযোগ উঠেছে। ২ নম্বর শরৎ মুখার্জি কলোনির বাসিন্দা, আমিনের বক্তব্য, ‘‘আমি ভাত খেয়ে ফের বুথে যাচ্ছিলাম। সেই সময়ে সিআরপি লাঠিচার্জ শুরু করে। আমাকেও বেধড়ক মারে।’’ তাতেই খেপে যায় লোকজন।

উত্তেজিত জনতা প্রথমে ইট ছুড়তে শুরু করে। ওই তল্লাটের অধিকাংশ মানুষই তৃণমূল সমর্থক। সুজিত বসুর গড় বলা হয় এই দক্ষিণদাঁড়িকে। দক্ষিণদাঁড়ি-সহ উত্তর দমদম পুরসভার ১০টি ওয়ার্ড কত বেশি লিড দেবে, তার উপরেই বিধাননগর বিধানসভার তৃণমূল প্রার্থী সুজিত বসুর জয় অনেকটা নির্ভর করছে বলে দলীয় সূত্রের খবর।

ক্ষিপ্ত জনতা যখন ইটবৃষ্টি শুরু করেছে, সেই সময়ে দুপুর ২টো ১০ নাগাদ ওই লাইন ধরে যাচ্ছিল লালগোলা প্যাসেঞ্জার। লাইনের এক দিকে লাঠি উঁচিয়ে সিআরপি, অন্য ধারে গিয়ে পাথর ছুড়ছে জনতা, আর মাঝখানে তখন ট্রেন। কেউ কেউ চেষ্টা করলেন ট্রেনের উপর দিয়ে পাথর টপকে ছুড়ে দেওয়ার।

খবর পেয়ে সল্টলেক থেকে তড়িঘড়ি ওই জায়গায় পৌঁছলেন তৃণমূল প্রার্থী সুজিত বসু। তৃণমূল সমর্থকদের অনেকেরই প্রশ্ন, ১৪৪ ধারা মানে কি ঘর থেকে টেনে এনেও পেটানো হবে? ওই জায়গায় উত্তেজনার আঁচ তখন হারিয়ে দিচ্ছে দুপুরের অসহ্য গরমকেও। এমন সময়ে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জনা চারেক জওয়ানকে নিয়ে ওই গলিতে ঢুকল পুলিশের একটি গাড়ি। সুজিত বসু নিজে ওই গাড়ি আটকে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করলেন। একটি ইটও এসে পড়ল সেই গাড়িতে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে পুলিশ ও সিআরপি-র বিশাল বাহিনী পৌঁছল বিধাননগরের সহকারী কমিশনার পাপিয়া সুলতানার নেতৃত্বে। পুলিশকে সুজিতের প্রশ্ন, ‘‘শান্তিতেই তো ভোট হচ্ছিল। আমার পোলিং এজেন্টকে মেরে জখম করে দেওয়ার মানে কী?’’ সিআরপি-র জওয়ানেরা তখন চাইছেন, লাঠিপেটা করে ওই ভিড় হটিয়ে দিতে। আবার জনতা তাঁদের দিকে তেড়ে যাওয়ার উপক্রম। কয়েক জন জওয়ানের দিকে আঙুল উঁচিয়ে কাঠপাড়ার বাসিন্দারা বললেন, ওই যে, ওই যে ওরা মেরেছে।

পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যেতে পারে বুঝে সুজিত গলা উঁচিয়ে বললেন, ‘‘পুলিশের গাড়িতে যেন কেউ হাত না দেয়।’’ তার পরে লেকটাউন থানার পুলিশকে বললেন, ‘‘আপনারা কেন্দ্রীয় বাহিনীকে সরিয়ে নিন। আমি ওদের সরিয়ে দিচ্ছি।’’ কিন্তু কেন্দ্রীয় বাহিনী সরতে নারাজ। তখন পাপিয়া লেকটাউন থানার পুলিশকে অবিলম্বে ভিড় সরাতে বলেন। আর নিজে কার্যত বাবা-বাছা করে, পিঠে হাত রেখে সিআরপি-কে ওই জায়গা থেকে
সরিয়ে দেন।

শাসক দল একচেটিয়া ভোট করাতে পারে, এই রিপোর্ট পেয়েই সম্ভবত কেন্দ্রীয় বাহিনী গোটা দক্ষিণদাঁড়িতে অতি সক্রিয় ছিল। বাল উপকারী বিদ্যালয়ের ১১৫ নম্বর বুথে তৃণমূল এজেন্ট দীপালি পাল দুপুরে আরও কয়েক জনকে নিয়ে চেঁচামেচি শুরু করে দাবি করেন, তাঁদের সমর্থক এক বৈধ ভোটারকে সিপিএমের এজেন্ট ভোট দিতে দিচ্ছেন না। সিআরপি জওয়ান হুঁশিয়ারি দিলেন, ‘‘শান্তি বজায় রাখো। না হলে আরও ফোর্স ডাকব। লাঠিপেটা করবে কিন্তু।’’ এক তৃণমূল সমর্থক বুথের গা ঘেঁষে সাইকেল দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন। তাঁকে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের কাছ থেকে শুনতে হল, ‘‘বুথের ১০০ মিটারের মধ্যে সাইকেল রাখলে হাওয়া খুলে দেব।’’

আর কেন্দ্রীয় বাহিনীর এই ক্রামগত চাপ রেখে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিধাননগর পুলিশের একটি পদক্ষেপ সল্টলেকে বহিরাগতদের ‘সাপ্লাই লাইন’ কেটে দিয়েছিল। ভিআইপি রোড থেকে বা কেষ্টপুরের দিক থেকে খাল পেরিয়ে সল্টলেকে ঢোকার সব ফুট ওভারব্রিজে সিআরপি বা আইটিবিপি জওয়ানদের সঙ্গে ছিল পুলিশ।

গোলাঘাটা, লেকটাউন, দমদম পার্ক, বৈশাখী, দিগন্তিকা, ২০৬ ফুট ওভারব্রিজে দাঁড়ানো পুলিশ ও জওয়ানেরা বৈধ পরিচয়পত্র দেখে কিংবা সত্যি প্রয়োজন বুঝে তবেই কোনও বহিরাগতকে সল্টলেকে ঢুকতে দিয়েছেন। বাড়ির পরিচারিকা বা আয়াকে দিয়ে সেই বাড়ির লোককে ফোন করিয়ে কথা বলে কিংবা কোনও ক্ষেত্রে সেখানে ডেকে এনে পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। যাঁদের ব্যাপারে সন্দেহ হয়েছে, পুলিশ তাঁদেরই ফিরিয়ে দিয়েছে।

অনেকেরই মতে, গত অক্টোবরের পুর-নির্বাচনে ভিআইপি রোডে বাস থেকে নেমে বহিরাগতেরা ওই সব ফুটব্রিজ দিয়ে পিলপিল করে সল্টলেকে ঢুকে ভোট করিয়েছিল। সেই জন্য বিধাননগর কমিশনারেটের এক শীর্ষকর্তা ঘনিষ্ঠ মহলে বলেন, ‘‘পুরভোটে যা হয়েছে, বাড়িতেও মুখ দেখানোর উপায় ছিল না। এ বার চাকরি থাকুক না থাকুক, ভোট লুঠ হতে দিইনি।’’

লখিন্দরের সেই লৌহবাসরে তা-ও কালনাগিনী ঢোকার ছিদ্র ছিল। সল্টলেকে এ বার সেই রন্ধ্রপথও রাখতে চায়নি পুলিশ।

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy