ভোট কোথায় হচ্ছে, জানতে চাওয়ায় আঙুল তুলে দূরে প্রাইমারি স্কুলবাড়িটা দেখিয়ে দিয়েছিলেন বৃদ্ধা।
সে পথে গাড়ি ঢুকবে না। তাই গাড়ি পুকুরের এক পাশে রেখে হেঁটে ঢুকতে হল। স্কুলের গেট বলতে ইট বিছানো ভাঙাচোরা রাস্তা। তার বাইরের দিকে মাটির রাস্তার উপরে একটি বেঞ্চি পাতা। সেখানে ইনস্যাস কাঁধে দুই জওয়ান বসে। আর তাঁদের দু’জনকে ঘিরে বেঞ্চে-মাটিতে, গাছে হেলান দিয়ে জনা দশেক যুবক।
এমনটা দেখব বলে চোখ প্রস্তুত ছিল না। এই তো আসার আগেই শুনে এসেছিলাম, নির্বাচন কমিশনের কড়া অনুশাসনের কথা। শুনেছিলাম, ভোটকেন্দ্রের আশপাশে নাকি মাছি বসতে দেওয়া হবে না! যে দুই জওয়ান বাইরে পাহারায় রয়েছেন, তাঁদেরই তো ওই জটলা সরিয়ে দেওয়ার কথা! পাশে চিত্র-সাংবাদিক ক্যামেরা তাক করতেই যুবকের দল বেঞ্চ থেকে উঠে সরে গেল! কেন? তা হলে তাঁরাও কি জানেন যে এ ভাবে ভোটকেন্দ্রের সামনে জটলা করা বেআইনি? ক্যামেরার সামনে চিহ্নিত হতে চান না?
প্রশ্নগুলো ভিড় করে আসছিল মনের ভিতরে। কী উদ্দেশ্যে এঁরা এখানে দাঁড়িয়ে? নিছকই গল্প করার জন্য? সোমবার, ভোটের প্রথম দিন দুপুর তখন প্রায় আড়াইটে। ভোটকেন্দ্র কার্যত সুনসান। ভিতরে আরও ছ’জওয়ান ইতস্তত পাহারায়। তাদের মধ্যেই নেতা গোছের একজন ঢোকার মুখে পরিচয় জানতে চাইলেন। বাইরে যুবকদের জটলার কথা জিজ্ঞাসা করায় বললেন, ‘‘ওরা তো বাইরে রয়েছে। ভিতরে তো আসছে না।’’ কিন্তু এ ভাবে ভোটকেন্দ্রের ১০ ফুটের মধ্যে জটলা কতটা আইনসঙ্গত? দলনেতা দাবি করলেন, সেটা দেখার দায়িত্ব তাঁর নয়। রাজ্য পুলিশের।
এই তো প্রথম নয়! ২০০২ সালে মেদিনীপুরে প্রথম পা রাখার পরে গত ১৪ বছরে জঙ্গলমহলে অনেকগুলো নির্বাচন দেখার সুযোগ হয়েছে। রাজ্য পুলিশকে পাহারায় রেখে অবাধে ছাপ্পা দেখেছি। সাংবাদিকদের সামনে দাঁড়িয়ে কোনও যুবক একের পর এক ভোট দিয়ে যাচ্ছেন, তাও দেখেছি। বিরোধীহীন বুথে ১০০ শতাংশ ভোট পড়াও দেখেছি। শাসক দলের নেতা-কর্মীদের এ সব নিয়ে কিছু বলার সাহসই থাকত না প্রিসাইডিং অফিসার, বিরোধী দলের এজেন্ট বা পুলিশের।
কিন্তু এ বার তো অন্য ভোটের জন্য প্রস্তুত হয়েছিল রাজ্যবাসী। এত কেন্দ্রীয় বাহিনী! এত রুট-মার্চ! এত রকম আশ্বাস আর প্রতিশ্রুতি! রাজ্য পুলিশ নাকি কার্যত কেন্দ্রীয় বাহিনীর অধীনে কাজ করবে! কেন্দ্রীয় বাহিনী নাকি বুথের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হাতে রাখবে। ভোট দিতে আসার পথেও নাকি রাজ্য পুলিশের টহলের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় বাহিনীর নজরদারি থাকবে! তা হলে? কেন্দ্রীয় বাহিনী তেমন চাইলে তাদের সামনে কী ভাবে কুঁকড়ে যেতে হয়, তা-ও দেখেছি। বাম জমানায় কেশপুরের গাছের পাতাও যখন বাম অনুশাসন ছাড়া নড়ত না, তখন সেখানকারই এক বুথে একবার বুক ফুলিয়ে ঢুকতে যাচ্ছিলেন সিপিএমের এক কর্মী। গেটের কাছে দাঁড়ানো জওয়ান তাঁর পথ আটকে পরিচয়পত্র দেখতে চান। ওই যুবক ছিলেন বুথের সিপিএম এজেন্টের বদলি-কর্মী। জওয়ানের দাপটে শেষ পর্যন্ত সিপিএম এজেন্টকে বাইরে বের করে এনে তবেই বদলি-কর্মীকে ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হয়। সেটা ২০০৬-এর কথা। সে বার থেকেই এ রাজ্যে ব্যাপক হারে কেন্দ্রীয় বাহিনী আসার শুরু। যে বাহিনী কোনও ভাষা বোঝে না। কেবল বুথের ভিতরে বা বাইরে কোনও অস্বাভাবিক কিছু দেখলেই চোয়াল শক্ত করে ঘাড় ধরে ফেলে।
কিন্তু এ বারে ঝাড়গ্রামের গোটা এলাকায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর সেই দাপট ছিল কোথায়! সেই উঁচিয়ে ধরা বেয়নেট নেই। সেই হাড়-হিম করা চাহনি নেই। উল্টে স্থানীয়দের সঙ্গে তাঁরা গল্পে মশগুল। ভোটকেন্দ্রের বাইরে জমায়েত দেখেও হেলদোল নেই। গৃহবন্দির মতো ভোটকেন্দ্রের চৌহদ্দিতেই যেন তাঁরা সীমাবদ্ধ। বেশ কিছু ভোটকেন্দ্রের সামনে স্থানীয় যুবকদের সঙ্গে খোশগল্প করতেও দেখা গিয়েছে তাঁদের। যাবতীয় দাপট শুধু সাংবাদিক এবং আলোকচিত্রীদের আটকানোর সময়েই দেখলাম!
অথচ বিভিন্ন গ্রামে ঘুরতে ঘুরতে যাঁদের সঙ্গেই কথা হয়েছে, তাঁরাই বলেছেন, কয়েক দিন আগে থেকেই শুরু হয়েছিল শাসকের হুমকি। রবিবার রাতেও কড়া নেড়ে বলে আসা হয়েছে, ‘‘থাকতে হলে আমাদের ভোট দিতে হবে।’’ সেই আগের মতো একই অভিযোগ, দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শাসক দলের যুবকেরা। তাই বিরোধিতা করা মানুষগুলো হয় ভোট দিতেই যান না। বা গেলেও শাসক দলকেই ভোট দেন। এক সিপিএম নেতার স্ত্রী মুখে আঁচল চেপে বলেন, ‘‘স্বামী যাকে খুশি ভোট দিক। আমাকে দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে গ্রামে থাকতে হবে। আমি তৃণমূলকেই ভোট দিয়ে এসেছি।’’
হুমকি আটকানো যায়নি। আটকানো যায়নি বুথের আশপাশের তৃণমূল বাহিনীকে। আর তাই যা হওয়ার হয়েছে। কমিশনের দেওয়া ভোটের শতকরা হিসেব় বুঝিয়ে দিচ্ছে, ভূতেরা আছে বহাল তবিয়তেই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy