Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪

পাশ করতে অন্যের শক্তিই এখন ভরসা বিজেপির সবেধনের

ঘোজাডাঙা সীমান্তের জিরো পয়েন্ট। উত্তরপাড়া গ্রাম। পূবের দিকটায় কলা আর বাঁশের ঝাড় পেরোলেই ওপার বাংলার সাতক্ষীরা। তার প্রায় কোল ঘেঁষেই দাঁড়াল গাড়িটা। সাদা শার্ট আর ধুসর প্যান্ট পরা মানুষটা গাড়ি থেকে নেমেই হাতজোড় করলেন। ভাঁজ করে লুঙ্গি পরা আদুল গায়ের দুটি লোক সামনে দাঁড়িয়ে। প্রতি নমস্কারের বালাই নেই। উল্টে জানতে চাইলেন, ‘‘আফনি কোন পাটি?’’

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়
বসিরহাট শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:৩২
Share: Save:

ঘোজাডাঙা সীমান্তের জিরো পয়েন্ট। উত্তরপাড়া গ্রাম। পূবের দিকটায় কলা আর বাঁশের ঝাড় পেরোলেই ওপার বাংলার সাতক্ষীরা। তার প্রায় কোল ঘেঁষেই দাঁড়াল গাড়িটা। সাদা শার্ট আর ধুসর প্যান্ট পরা মানুষটা গাড়ি থেকে নেমেই হাতজোড় করলেন। ভাঁজ করে লুঙ্গি পরা আদুল গায়ের দুটি লোক সামনে দাঁড়িয়ে। প্রতি নমস্কারের বালাই নেই। উল্টে জানতে চাইলেন, ‘‘আফনি কোন পাটি?’’

সাংবাদিকের সামনে অপ্রস্তুত সাদা বুশ শার্ট। বললেন, আমাকে চিনতে পারলেন না? শমীক ভট্টাচার্য, বিজেপি। কৌতূহলের ভাবটা কাটল এত ক্ষণে। উভয়ের জোড়হাত উঠে এলো কপালে, ‘‘ও, তাইলে ঠিক আসে। সিন্তা নাই, পাশ কইর‌্যা গ্যাসেন।’’

মুখে স্বস্তির হাসি ফুটল শমীকের। হাওয়ার আর্দ্রতায় ঝাপসা হয়ে আসা চশমার কাচ মুছতে মুছতে বললেন, ‘‘জানেন, গত দু’মাসে যত মানুষ আমাকে পাশ করার কথা বলেছেন, তাঁরা ভোটটা দিলেই আমি জিতে গিয়েছি।’’

আসলে বসিরহাট দক্ষিণ আসনে আবার জেতাটাই যেন চ্যালেঞ্জ এ রাজ্যে বিজেপির ‘শিবরাত্রির সলতে’ শমীক ভট্টাচার্যের। কারণটাও সহজ। বসিরহাটে বিজেপির লোক-লস্কর, সংগঠন কিছুই নেই। তৃণমূলের মতো ভৈরব বাহিনী নেই। কংগ্রেসের মতো পকেট ভোট নেই। লোকসভা ভোটের মতো মোদী হাওয়াও নেই। তা হলে কীসের ভরসায় জিতে আসার কথা ভাবছেন বিজেপির এই সবেধন বিধায়ক?

বসিরহাট জামে মসজিদের পাশে তাঁর ছোট বাড়ি। সেখান থেকে বেরনোর সময়ই শমীকের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল এর জবাব। বিধায়কের ব্যাখ্যা, ‘‘আমার যা নেই, তা আমার দুর্বলতা। কিন্তু ওঁদের যা আছে, সেটাই আমার শক্তি। শান্তিপ্রিয় বসিরহাটে দখলের রাজনীতি কায়েম করেছে তৃণমূলের বাহিনী। তাই কংগ্রেসের পকেট ভোটও এখন ঝুঁকছে আমার দিকে।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘মানুষ শুধু জানতে চাইছে, দাদা ভোটটা দিতে পারব তো? তা হলে পুর ভোটে মস্তানির জবাব দিয়ে দেব!’’

বসিরহাটের আধাশহর এলাকা ছেড়ে গাড়ি এগোল সীমান্তের দিকে। ঘোজাডাঙার পথে একটি বাঁক ঘুরতেই ব্রেক কষলেন চালক। তৃণমূলের পতাকা লাগানো এক দল বাইক আসছে ধেয়ে। সম্ভবত তাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মিটিং শুনতে যাচ্ছেন বসিরহাট-উত্তর আসনে। বাইক বাহিনী দেখে শমীক গাড়ির কাচটা নামালেন। বাইকে বসা এক যুবক উপনির্বাচনে জেতা দেড় বছরের বিধায়ককে দেখে দিব্যি বলে বসলেন, ‘‘দাদা, চিন্তা নেই। খাওয়া-দাওয়া অন্য জায়গায়, ভোটটা দেব ঠিক জায়গাতেই!’’ হুউউস করে বেরিয়ে গেল জোড়াফুলের বাইকগুলো।

গাড়ির সামনের আসন থেকে পিছনে বসা সাংবাদিকের দিকে তাকালেন শমীক। মুখে এমনিই হাসি ফুটে গিয়েছে। বলছেন,‘‘এ বার বুঝতে পারছেন, কেন আমি আত্মবিশ্বাসী?’’

শুধু শমীক নয়, বসিরহাট দক্ষিণে এ বার তিন প্রার্থীই জেতার ব্যাপারে সমান আত্মবিশ্বাসী। তৃণমূলের হয়ে দাঁতে দাঁত চেপে লড়ছেন ভারতীয় ফুটবল দলের এক সময়ের অধিনায়ক দীপেন্দু বিশ্বাস, উপনির্বাচনে মাত্র দেড় হাজার ভোটে হেরেছিলেন যিনি। রাস্তাঘাটে সর্বত্র তাঁর ছবি। বসিরহাটে কী কী উন্নয়ন করেছেন, তার খতিয়ান। শহর কিংবা গ্রামে প্রচারে অন্য কেউ তাঁর ধারে কাছে নেই। অনেকে আবার এ নিয়ে কটাক্ষ করতে ছাড়ছেন না। বসিরহাট চৌমাথায় দীপেন্দুর বিরাট কাটআউট। সঙ্গে উন্নয়নের খতিয়ান। যা দেখিয়ে এক দোকানির বক্তব্য, ‘‘আচ্ছা, বলুন তো, উনি সরকারের কেউ? হেরো প্রার্থী এত উন্নয়ন করলেন কোত্থেকে?’’

এর একটা ব্যাখ্যা শাসক দলের রয়েছে। দলের হয়ে দীপেন্দুই এখন বসিরহাটের উন্নয়ন দেখাশোনা করেছেন। তার বহর কেমন? চায়ের আড্ডায় বসে পকেট থেকে একটা চিনা মোবাইল বের করলেন স্থানীয় এক যুবক। বললেন, ‘‘শুনুন তা হলে!’’ দেড় মিনিটের একটি অডিও ক্লিপিং, মোবাইলের স্পিকারে বাজতে শুরু করল চৌমাথার চা দোকানে। গোল করে ঘিরে অন্তত আরও জনা আট। আর্শাদ নামে কোনও এক ঠিকাদারকে হুমকি দিচ্ছেন দীপেন্দু। এক কথায় তোলাবাজি। (যদিও ওই অডিও ক্লিপিংয়ের সত্যতা যাচাই করে দেখা সম্ভব হয়নি।) তবে চেনা গলাটা শুনেই মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক জানালেন, ‘‘কলকাতায় নারদের ভিডিও,আর বসিরহাটে আর্শাদের অডিও তৃণমূলকে শেষ করে দিয়েছে। ফোনে ফোনে এ সব ছড়িয়ে পড়েছে।’’ তার পরেই তাঁর আক্ষেপ,‘‘ছেলেটা ভাল ছিল জানেন। মুখে রা সরত না। পাল্লায় পড়ে এখন গোল্লায় গেছে।’’

দীপেন্দুর ওই হুমকি-টেপ নিয়ে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ দায়ের করেছেন কংগ্রেস প্রার্থী অমিত মজুমদার। তাঁর সবগুলি প্রচার গাড়ি নারদ-অভিযুক্তদের টাকা নেওয়ার ছবি দিয়ে সাজানো। মাইকে তারস্বরে বাজছে, নচিকেতার ‘চোর চোর চোর’ গানটি। অনেকে মনে করছেন পাঁচ বারের জাতীয় ফুটবল অধিনায়ক, ‘স্ট্রাইকার’ দীপেন্দুর গোল করার চেষ্টা তিনিই হয়তো আটকে দেবেন কড়া মার্কিংয়ে।

প্রচারে ব্যস্ত। তাই স্ট্রাইকারকে বসিরহাটের মাঠে পাওয়া গেল না। তাঁর হয়ে রক্ষণে নামলেন উত্তর ২৪ পরগনার জেলা তৃণমূল পর্যবেক্ষক জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। তাঁর সাফ কথা, ‘‘দীপেন্দু বহু ভোটে জিতবে। ও সব টেপ-ফেপ ফালতু। কংগ্রেসের সব ভোট আমরা পাব। সংখ্যালঘু ভোটও আমরাই পাচ্ছি।’’

এই কেন্দ্রের কংগ্রেসের পকেট ভোট সত্যিই আছে। যদিও বসিরহাটে কংগ্রেস আর অসিত মজুমদার সমার্থক। সেই অসিতবাবুকে প্রার্থী না-করে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী কেন তাঁর ভাই অমিতকে টিকিট দিলেন, সেই ধন্ধ বসিরহাটবাসীর এখনও কাটেনি।
আর সেই রহস্যের মোড়কেই ঘুরছে নানা প্রশ্ন।

সবিস্তার পড়তে ক্লিক করুন।

অসিত মজুমদারের পকেট ভোট কি তাঁর ভাই পাবেন? সিপিএমের ভোটাররা কি সত্যিই কংগ্রেসকে ভোট দেবেন? আর তৃণমূলের স্থানীয় নেতারা কি দীপেন্দুর উত্থান মেনে নেবেন?

পাচার অর্থনীতির স্বর্গ হিসেবে পরিচিত বসিরহাটে এই সব নানা ধন্দ। আর তার লাভের গুড় শমীক খেয়ে যেতে পারেন বলে অনেকেরই ধারণা। তা না-হলে কেনই বা শমীক প্রয়াত সিপিএম বিধায়ক নারায়ণ মুখ্যোপাধ্যায়ের মূর্তি বসাবেন, কেনই বা প্রতিটি বক্তৃতায় মুখ্যমন্ত্রীর প্রশংসা করবেন, কেনই বা অসিত দা’কে শ্রদ্ধেয় নেতা বলে কপালে হাত ঠেকাবেন!

বসিরহাট বলছে, করবে নাই বা কেন? এ রাজ্যে বিজেপির বংশের বাতিকে যে ‘পাশ’ করতে হবে।

অন্য বিষয়গুলি:

Assembly Election 2016
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy