মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও সোনালি গুহ। ২০০২ সাল।
তিনি কোনওদিন ‘বেইমানি’ করেননি। ‘বেইমানি’ পছন্দও করেন না। কিন্তু এমন আঘাত পাবেন, সেটা বিশ্বাসও করতে পারছেন না। বলছিলেন সদ্য তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি-তে যোগ দেওয়া সাতগাছিয়ার বিধায়ক তথা রাজ্য বিধানসভার প্রাক্তন ডেপুটি স্পিকার সোনালি গুহ। তখনও ২৪ ঘণ্টা হয়নি নতুন দলে। কিন্তু তাতেই বিজেপি নেতাদের ব্যবহারে আপ্লুত সোনালি। মনে করছেন এ বার সম্মান পাবেন। এত দিনের দলে নাকি সেটা পাননি কখনও। চার বারের বিধায়ক রাজ্য বিধানসভার প্রথম মহিলা ডেপুটি স্পিকার হয়েছিলেন। কিন্তু দলে তেমন সম্মানই নাকি ছিল না তাঁর। বার বার তাঁকে নিয়ে ‘খেলা’ হয়েছে। দরকারের সময় কাছে টেনে নিয়ে পরক্ষণেই দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সোনালি অনেক অভিযোগ শুনিয়েছেন আনন্দবাজার ডিজিটালকে। সেই সঙ্গে বলেছেন, ‘‘আমি যা যা জানি, তা আর কেউ জানে না। দলের কথাই হোক বা দিদির কথা। এত কাছাকাছি কখনও কেউ ছিল না। আমি মুখ খুললে বিস্ফোরণ হয়ে যাবে!’’
সোনালির রাজনৈতিক জীবনের আলো-আঁধারির কথা অবশ্য রাজ্য রাজনীতির সঙ্গে জড়িত প্রায় সকলেই জানেন। এই আলোয় তো পরক্ষণেই আঁধারে! বারবার যেমন মমতা-সোনালি নৈকট্যের ছবি দেখা গিয়েছে, তেমনই বারবার নানা বিতর্কে দূরত্বের খবরও শিরোনাম হয়েছে। কিন্তু এ বার দূরত্ব অনেক যোজন। সোমবার থেকে সোনালির পরিচয় বিজেপি নেত্রী হিসেবে। কিন্তু এখনও সোনালি ভুলতে পারছেন না তাঁর জীবনের সোনালি দিন। বললেন, ‘‘আমি তখন সবে কলেজ থেকে বেরিয়েছি। দিদি কাছে ডেকে নিয়েছিলেন। শ্রীকৃষ্ণের মতো আমার দুই মা। দিদির বাড়িতে হাঁসের ডিম রান্না হলে আমার নেমন্তন্ন পাকা ছিল। অভিষেককে (বন্দ্যোপাধ্যায়) আমি কোলে নিয়ে ঘুরতাম। দিদি যখন যখন হাসপাতালে ছিলেন, আমিও টানা সঙ্গে ছিলাম।"
চারুচন্দ্র কলেজের প্রাক্তন ছাত্রী সোনালির রাজনৈতিক জীবনের সবটাই মমতা-ময়। একটা সময় তিনি ছিলেন দিদির ‘ছায়াসঙ্গিনী’। সিঙ্গুর থেকে নন্দীগ্রাম, নেতাই থেকে চমকাইতলা— সর্বত্র মমতা মানেই সোনালি। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর কেন্দ্র ছিল সাতগাছিয়া। পাঁচ বার বিধায়ক থাকার পরে ২০০১ সালে তিনি ভোটে দাঁড়াননি। সেই বছরই সোনালি সাতগাছিয়া থেকে বিধায়ক হন। তবে ইদানীং দলের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল ছিল না। নিজের এলাকাতেও ‘স্বাধীন’ ভাবে কাজ করতে পারছিলেন না। তাঁর উপর পর্যবেক্ষক নিয়োগ করা হয়েছিল শওকত মোল্লাকে। মনে নিতে না পারলেও মেনে নিয়েছিলেন সোনালি। যে ভাবেই হোক টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন দলের সঙ্গে সম্পর্ক। মনে মনে একটা স্বপ্ন ছিল। সেটা সত্যি হল না। কী সেই স্বপ্ন? ‘‘এ বারও সাতগাছিয়া থেকে প্রার্থী করলে আমি জিততামই জিততাম! টানা পাঁচ বার জিতে জ্যোতিবাবুর রেকর্ড ছোঁয়ার ইচ্ছা ছিল। সেটা হল না।’’ ফের গলা ভারী হয়ে গেল সোনালির। সামলে নিয়ে বললেন, ‘‘আর ভোটে দাঁড়াব না। কৈলাস’জির (বিজয়বর্গীয়) সামনে মুকুল’দাকে (রায়) বলেছি, প্রার্থী হব না। দল যে কাজে লাগাবে তা-ই করব।’’
‘দিদি’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দীর্ঘ সময়ের সঙ্গী সোনালি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন গত শুক্রবার তৃণমূলের প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পরেই। কেঁদে ফেলেন। প্রার্থী হতে না পেরে অনেকেই ক্ষুব্ধ হন। কিন্তু তা বলে কান্না? সোনালি বললেন, ‘‘মেনে নিতে পারিনি। আমাকে আগে জানালে কষ্ট হত না। অমি দিদিকে কখনও ছেড়ে যাইনি। যাওয়ার কথা ভাবতেও পারিনি। আর দিদি আমাকে বার করে দিল! দিদিকে ভগবান সুবুদ্ধি দিক।’’ চোখের জল এখনো পুরোপুরি শুকোয়নি। এখনও গলা ভারী অভিমানে। কথায় কথায় চশমা খুলে চোখ মুছছেন আঁচলে। তবে একটু একটু করে যেন অভিমান দমিয়ে বেরিয়ে আসছে আক্রোশ। যদিও এখনও আক্রমণাত্মক নয় গলা। তবে মৃদু হুঁশিয়ারির সুর, ‘‘তৃণমূল দলেরই হোক বা দিদির বিষয়। আমি যতটা জানি, যা যা জানি সে সব মারাত্মক। কিন্তু আমি বলব না। ব্যক্তি আক্রমণ করব না। রাজনৈতিক ভাবে সরকারের ব্যর্থতার নিন্দা করব। কাজ করতে না পারার কথা বলব।’’ দিদির বিরুদ্ধে প্রচার করতে নন্দীগ্রামে যাবেন? সোনালি বললেন, ‘‘আমি নিজে থেকে যেতে চাইব না। শুভেন্দুর (অধিকারী) সঙ্গে এখনও কথাও হয়নি। তবে দল বললে যাব। দল যা যা বলবে করব।’’
নতুন পথে পা রাখলেও পুরনো পথ যে সোনালি একটুও ভুলতে পারছেন না, তা তাঁর কথায় স্পষ্ট। সিঙ্গুরে পুলিশের মার খাওয়া, পুলিশ সুপারকে টুল ছুড়ে মারার কথা বারবার টেনে আনলেন। বললেন, ‘‘হ্যাঁ, আমি পুলিশকে গালাগাল করেছি। দিদিকে অপমান করেছিল বলেই করেছি। সকলেই জানত আমি ওইরকম। অন্যায় সহ্য করতে পারি না। দিদির অপমান কোনওদিন সহ্য করিনি। বিধানসভা ভাঙচুরের দিন দিদির অপমান শুনেই আবেগ চেপে রাখতে পারিনি। অথচ জানেন, হাওড়ার একটি আবাসনে গিয়ে আমার গালিগালাজ করার সময় আমার পাশে দাঁড়ায়নি দল। সেই সময় দিদি সিঙ্গুরে একটা মঞ্চ থেকে আমায় নামিয়ে দিয়েছিলেন।’’ সিঙ্গুর আন্দোলনের প্রেক্ষিতে মমতার অনশনে প্রথম কয়েকটা দিন সোনালি পাশে থাকলেও পরে দেখা যায় পুরীতে তিনি একটি দোকানে কেনাকাটা করছেন। তা নিয়ে সেই সময় বড় বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। সোনালি বললেন, ‘‘আর কেউ না জানুক, দিদি সবটা জানতেন। বাবা-মায়ের পারলৌকিক কাজ করতে পুরী গিয়েছিলাম। অনশনে বসার আড়াই মাস আগে টিকিট কাটা হয়েছিল। কার্তিকদা (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাদা) হোটেল ঠিক করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সব জেনেও দল আমার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করেছিলে।’’ তখন রাগ হয়নি? সোনালির জবাব, ‘‘নাহ্। কষ্ট হলেও রাগ হয়নি। আসলে আমি জানি দিদি ওইরকমই। এই রাগ, এই ভালবাসা। আমি তো মজা করে দিদিকে বলতাম, তুমি ক্ষণে রুষ্ট ক্ষণে তুষ্ট।’’
লড়াকু সোনালি কি আগের মতো লড়াইয়ের ময়দান পাবেন পদ্মশিবিরে? সোনালি বললেন, ‘‘সেটা দল ঠিক করবে। তবে বিজেপি অনেক শৃঙ্খলাবদ্ধ পার্টি। মুকুল’দা সোমবারই বলে দিয়েছেন, এখানে কিন্তু উল্টোপাল্টা করা যাবে না। কথাবার্তা বুঝে বলতে হবে। আমি মুকুলদার কথা মতোই চলব। ওঁর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। অসময়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন। আমি রাজনীতি ছাড়া থাকতে পারতাম না। ওটা আমার নিশ্বাস-প্রশ্বাসের মতো।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy