Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪

ভোট বাগানে ভূতের নেত্য, মদ-টাকা-হুমকি, সঙ্গে ট্রেনিংও

জঙ্গলমহলে শুধু নয়, দেদার ভূত আছে উত্তরেও। নির্বাচনের কাজে জড়িয়ে থাকা নানা জনের কাছ থেকেই শোনা যাচ্ছে, তরাই থেকে ডুয়ার্স— ভোটের বাজারে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মস্ত ‘ভূত-বাহিনী’।

কিশোর সাহা
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০১৬ ০২:৪২
Share: Save:

জঙ্গলমহলে শুধু নয়, দেদার ভূত আছে উত্তরেও।

নির্বাচনের কাজে জড়িয়ে থাকা নানা জনের কাছ থেকেই শোনা যাচ্ছে, তরাই থেকে ডুয়ার্স— ভোটের বাজারে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মস্ত ‘ভূত-বাহিনী’। বাগানের বাতাসে এমনও অভিযোগ ভাসছে যে, প্রথম পর্বের ভোটের পরে ভূত-বাহিনীকে উত্তরে পাঠানো হয়েছে। তাই হয়তো নকশালবাড়ি থেকে আলিপুরদুয়ার, দলগাঁও থেকে মোহরগাঁও, চা বলয়ের বিস্তীর্ণ এলাকায় বাতাসে ভেসে বেড়ায় কী ভাবে ভোটের বাজারে টাকা উড়ছে, সেই টাকা কী ভাবে ভূতেরা জোগাচ্ছে, তা নিয়ে নানা কাহিনি। ভূতের হাতে যাতে ভোটের ভবিষ্যৎ চলে না যায়, তা রুখতে নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগও জানিয়েছেন কেউ কেউ।

এই তরাই-ডুয়ার্স আর চা বাগান নিয়ে একাধিক ভূতের গপ্পো আছে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের। তার কিছু পড়তে গেলে যেমন হাসি পায়, তেমন কিছু গপ্পে গা ছমছম করে। চা বাগানের ভোটে ছায়াময় ভূতেদের তেমনই গা ছমছম উপস্থিতির কথা ঘুরে বেড়ায় স্থানীয় বাসিন্দাদের মুখে।

প্রায় ৩০০ চা বাগান রয়েছে এলাকায়। অনেকগুলি বাগানের বাসিন্দাকেই কাজের খোঁজে ভিন রাজ্যে যেতে হয়েছে। ভোটের দিনে তাঁদের অধিকাংশই বাড়ি ফিরতে পারবেন কি না, সন্দেহ। কোথাও শোনা যাচ্ছে, সেই শ্রমিকদের ভোট যাতে পড়ে যায়, সে জন্য তৈরি হচ্ছে ভূতেরা। কোথাও মদে-মাংসে কয়েকটা দিন পিকনিকের মেজাজে কাটিয়ে ভোটপর্ব উতরে দেওয়ার ছক কষা হচ্ছে। কোথাও ‘সাহায্য’ হিসেবে অপুষ্ট চা শ্রমিকের হাতে হাতে গুঁজে দেওয়া হচ্ছে কড়কড়ে নোট। আবার কোথাও রেশনে যা প্রাপ্য, তার চেয়েও কয়েক গুণ বেশি চাল বস্তা ভরে পৌঁছে যাচ্ছে বাড়িতে। কাজের খোঁজে বাগান ছেড়ে চলে যাওয়া কয়েক হাজার শ্রমিকের নামের তালিকাও তৈরি হয়ে গিয়েছে। যাঁরা পক্ষে, তাঁদের আনতে যাতায়াতের টাকা, রাহা খরচ দেওয়ার প্রস্তুতি সম্পূর্ণ। কিন্তু, যাঁরা বিপক্ষে ভোট দিতে পারেন, তাঁদের ভিন রাজ্যেই বসে থাকতে হুমকি, শাসানি দেওয়া হচ্ছে। সুনসান চা বাগানে সশস্ত্র ছায়ামূর্তিদের আনাগোনার অভিযোগও কম উঠছে না। এরা কারা, কেউ জানে না। বা বলতে চায় না। তাই এদের ভূত বলেই ডাকে চা বাগান।

যেমন, পিটার নাগাশিয়া, পাত্রাসু মিন্জ, বিরসা ওঁরাওরা কেরলে কাজ করেন। তাঁদের আত্মীয়-স্বজনেরা জানালেন, ২০১১ সালে পিটাররা আসতে পারেননি। কেরল থেকে উত্তরবঙ্গে যাতায়াত খরচ তো আর কম নয়। তাই ওঁরা আসতে পারেননি। কিন্তু, ওঁদের ভোট পড়ে গিয়েছিল বলে আত্মীয়দের অভিযোগ। ওদলাবাড়ির বন্ধ কুমলাই চা বাগান থেকে শুরু করে ভুটান সীমান্তের বান্দাপানি, তরাই-ডুয়ার্সের ১১ লক্ষ চা শ্রমিক পরিবারের ২০ শতাংশই কাজের সূত্রে এখন ভিন রাজ্যে থাকেন বলে শ্রমিক সংগঠনের নেতারা অনেকে মেনে নিচ্ছেন। তাঁদের অর্ধেকই ভোট দিতে আসতে পারেন না। সেই ভোট দিতেই নাকি অনেক বাগানে এখন ‘ভূত-বাহিনী’র রমরমা।

বাগানে-বাগানে এখন একই অভিযোগ। বান্দাপানি, রেড ব্যাঙ্ক, কাঁঠালগুড়ির অনেক শ্রমিক পরিবার তো ভূতের ভয়ে কাঁটা। কারণ, ওই শ্রমিক পরিবারের অনেকেই বাইরে রয়েছেন। কেউ ভুটানে পাথর ভাঙার কাজ করেন। বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের কাছে স্কুল পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের রেখে অনেক দম্পতি বাইরে কাজ করেন। সেখান থেকেই মাসে মাসে টাকা পাঠান। একাধিক বৃদ্ধ দম্পতির অভিযোগ, ভোটের সময়ে তাঁদের ছেলে-বউকে আসতে নিষেধ করা হয়েছে। কারা নিষেধ করল! জবাবে এদিক-ওদিক চেয়ে ফিসফিস করে জানিয়েছেন, ‘‘ওরা ভূতের মতো আসে। ভয় দেখায়। মিলিয়ে যায়।’’

যাঁরা বাগানে রয়েছেন, তাঁদের মুখ বন্ধ করে পক্ষে টানতেও ভূত-বাহিনী সিদ্ধহস্ত। যেমন বৃদ্ধা রুমনা হেমব্রম বললেন, ‘‘ওরা গেল ভোটেও তো আগের দিন বাগানের মাঠে ভোজ দিল। ছেলেবুড়োরা পুরোদমে নেশা করল। হাতেও কিছু গুঁজে দিয়েছিল। এ বারও তেমন হবে।’’ এত খরচ কে করল! দূরে চা বাগানে উড়তে থাকা একটা ঢাউস পতাকার দিকে তাকিয়ে স্বর নামিয়ে বলেন, ওই দলের কয়েক জন নেতার লোকেরাই তো রাত-বিরেতে ভূতের মতো হামলে পড়ে ঘরদোরে। পাশ থেকে হাত টেনে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে এক প্রৌঢ় চা শ্রমিক বললেন, ‘‘গেলবার আগের দিন এত নেশা হয়ে গেল, পরদিন ভোটই দিতে যেতে পারি নাই। বিকেলে যখন বুথে গেলাম, শুনলাম ভোট হয়ে গিয়েছে। ভূতেরা বাপু বড়ই চালাকি করে।’’

বাগানে-বাগানে ভূতের উপদ্রবের কথা কমিশনের কাছে জানানো হয়েছে বলে দাবি করছেন জলপাইগুড়ির সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তথা চা শ্রমিক নেতা জিয়াউল আলম। তাঁর দাবি, ‘‘চা বাগানের শ্রমিক পরিবারের অনেক সদস্য কাজের খোঁজে বাইরে রয়েছেন। সেটা কমিশনকে লিখিত ভাবে জানিয়ে তাঁদের চিহ্নিত করে পদক্ষেপ করার অনুরোধ করেছি। কোনও পদক্ষেপই চোখে পড়েনি। তাই আমরা ভূত ঠেকাতে
জোট বেঁধেছি।’’

কংগ্রেসের চা শ্রমিক সংগঠন এনইউপিডব্লিউ-র কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা মণিকুমার ডার্নালও জানাচ্ছেন, তাঁরাও তৈরি হচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘‘এ বার আমরা ওঝাও রেডি রেখেছি। ভূত আমরা ঠেকাব।’’

শাসক দল তৃণমূলের নেতারা কিন্তু অভিযোগ করছে, চা বাগানে ভূতের রমরমা বেড়েছিল বাম আমলেই। তৃণমূলের টি প্ল্যান্টেশন ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি জোয়াকিম বাক্সলা বলেন, ‘‘চা বাগানে আগে অনেক ভূতুড়ে ব্যাপার হতো। এখন হয় না। সব মিথ্যে অভিযোগ করে ভোটের বাজার গরম করার চেষ্টা করে লাভ হবে না।’’

তা হলে এত মদ-মাংসের আয়োজনের কথা শোনা যাচ্ছে কেন? জোয়াকিমের জবাব, ‘‘চা শ্রমিকদের কাছে ভোটও একটা পরবের মতো। সে জন্য ভোটের আগে খাওয়াদাওয়া চলে। তবে এখন অনেক কমে গিয়েছে। এখন আগের মতো টাকা ওড়ে না।’’ তবে হালে তৃণমূলের ঘনিষ্ঠ আদিবাসী বিকাশ পরিষদের রাজ্য সভাপতি বিরসা তিরকেও মানছেন, বাগানে ভুতুড়ে ভোটের রমরমা ছিল এবং এখনও আছে। তাঁর সংযোজন, ‘‘টাকা বিলি, মদ-মাংস, ভুতুড়ে ভোটের রমরমা এখন
অনেক কম।’’

অর্থাৎ ভূত কিন্তু আছেই। অতএব, সেই ভূত তাড়িয়ে বাগানের ভোটে জল মেশানো রুখতে কমিশনের উপরে চাপও বাড়ছে। জেলা প্রশাসনের প্রায় সব কর্তাই অবশ্য দাবি করছেন, যা কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকবে তাতে ভূতেরা পালিয়ে পথ পাবে না।

অঙ্কণ: সুমন চৌধুরী।

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy