আপন মনে। শনিবার সিঙ্গুরের সভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: দীপঙ্কর দে।
ফিরে এসেছে বিধানসভা ভোট। সিঙ্গুর নিয়ে তিনিও ফিরলেন পুরনো সুরে।
২০১১ সালে বিধানসভা ভোটের আগে বলেছিলেন, ক্ষমতায় এলে সিঙ্গুরের ‘অনিচ্ছুক’ চাষিদের জমি ফিরিয়ে দেবেন। মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসে জমি ফেরত দিতে যে আইন এনেছিলেন, উল্টে সেটিই গত পাঁচ বছর ধরে মামলার ফাঁসে। সেই প্রসঙ্গে বিধানসভায় বলেছিলেন, ‘‘আদালতের ব্যাপার। পাঁচ কেন, পঞ্চাশ বছর লাগলেও কিছু করার নেই।’’ শনিবার সেই তিনিই বিধানসভা ভোটের প্রচারে সিঙ্গুরে এসে বললেন, ‘‘সরকার আপনাদের জমি ফেরত দেবেই। এটা আমাদের কমিটমেন্ট। কমিটমেন্ট। কমিটমেন্ট। চিন্তার কোনও কারণ নেই।’’
জমির জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষায় ক্লান্ত ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকরা এমনিতেই হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এ দিনের মন্তব্যের পর বিভ্রান্ত অনেকেই।
পাঁচ বছর আগে সরকার গড়েই ‘অনিচ্ছুকদের’ জমি ফেরাতে বিধানসভার অধিবেশনে অর্ডিন্যান্স আনতে চেয়েছিলেন মমতা। পারেননি। কারণ, বিধানসভা খোলা থাকলে অর্ডিন্যান্স আনা যায় না। এর পর তাঁর সরকার বিল এনে সিঙ্গুরে টাটার কারখানার জমি দখল করে। বিলের বিরোধিতা করে আদালতে যায় টাটা গোষ্ঠী। সেই থেকে এখনও বিষয়টি আদালতের বিচারাধীন। কিন্তু আরও একটা বিধানসভা ভোট আসতেই দেখা গেল, সিঙ্গুরের মাটিতে দাঁড়িয়ে কৃষিজমি ফেরতের দাবিকে উপেক্ষা করতে পারছেন না মমতা। তাঁকে এ দিন বলতে হয়েছে, ‘‘আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আপনারা জমি ফেরত পাবেনই। আমি বেঁচে থাকতে আপনাদের কোনও অসুবিধে হবে না। কোনও অন্যায় হতে দেব না।’’
সিঙ্গুরে জমি আন্দোলনের দুই নেতা— রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য এবং বেচারাম মান্না, দু’জনেই মমতা সরকারের মন্ত্রী এবং এ বারের ভোটেও তৃণমূলের প্রার্থী। গত বারের মতোই রবীন্দ্রনাথবাবু সিঙ্গুর এবং বেচারাম হরিপাল থেকে দাঁড়িয়েছেন। মমতার আমলে সিঙ্গুর-সহ হুগলিতে রাস্তা, পানীয় জল সরবরাহ, কলেজ, স্বাস্থ্য পরিষেবার কত উন্নতি
হয়েছে, এ দিনের সভায় তা নিয়েই বিস্তারিত বলেছেন দু’জনে। কিন্তু সিঙ্গুরের মানুষ যে বিষয়টি নিয়ে আগ্রহী, সেই কৃষিজমি ফেরত নিয়ে তাঁরা কোনও কথাই বলেননি। এমনকী, একই জেলার তারকেশ্বরে তৃণমূলের আর এক প্রার্থী রচপাল সিংহও বক্তৃতা শেষ করেছেন শুধু উন্নয়নের জয়গান গেয়ে।
বেচারামের দাবি, ভোটে কৃষিজমি নিয়ে নাকি সিঙ্গুরের মানুষ আদৌ ভাবছেন না! এ দিন তিনি বলেন, ‘‘এখানে ২৭৫টি বুথ আছে। আর আমাদের কৃষিজমি আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন ১৩টি বুথের বাসিন্দা। আমরা ভোটটা বৃহত্তর প্রেক্ষিতে দেখছি।’’ ২০০৮ সালে ন্যানো কারখানার পাঁচিলের গায়েই মঞ্চ বেঁধে ধর্নায় বসেছিলেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, এ দিন তাঁর সভার আয়োজন করা হয়েছিল কারখানা চত্বর থেকে দূরে, অপূর্বপুরের ফুটবল মাঠে। কেন? হুগলি জেলার তৃণমূল সভাপতি তপন দাশগুপ্তের যুক্তি, ‘‘ওখানে সভা করার জায়গা কোথায়? এখানে মাঠটা বড়। আমাদের দলনেত্রীর সভা বড় জায়গা না হলে করা যায় না!’’ এ দিন অবশ্য সভায় মহিলা শ্রোতা বেশি থাকলেও উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়নি।
সভায় তাঁর আগের দুই বক্তার কথা শোনার পরে মমতা নিজেই বলেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথবাবু ও বেচা আমার কাজ অনেকটা হাল্কা করে দিয়েছেন। উন্নয়নের কথা বলেছেন।’’ কিন্তু সিঙ্গুরের মানুষ কী শুনতে চান, সম্ভবত তা খুব ভাল করে জানেন বলেই এ দিন তৃণমূল নেত্রীর ২০ মিনিটের বক্তৃতার সিংহভাগ জুড়ে ছিল কৃষিজমি ফেরত দেওয়ার আশ্বাস। তাঁর ২৬ দিনের অনশন এবং
সিঙ্গুরের রাস্তায় ধর্নার কথা মনে করিয়ে দিয়ে এ দিন মমতা বলেন, ‘‘সিঙ্গুর হল কৃষিজমি আন্দোলনের পীঠস্থান। এটা সম্মানের জায়গা। যে দিন আপনারা মামলা জিতে যাবেন, সব জমি ফেরত পাবেন! সিঙ্গুরের সে দিন জয় হবে। সে দিন আমাকে ডাকতে হবে না। নিজেই চলে আসব। সিঙ্গুরের জয় হবেই। কৃষিজমি আন্দোলনের জয় হবেই। কারণ, এটা একটা ইতিহাস।’’
এ দিন মমতার মঞ্চে ছিলেন সিঙ্গুর আন্দোলনের সময়ে নিহত কিশোরী তাপসী মালিকের বাবা মনোরঞ্জন ও মা মলিনা দেবী। ছিলেন তৃণমূলের ‘শহিদ’ রাজকুমার ভুলের মা। শ্রোতাদের মধ্য থেকে বাজেমেলিয়া গ্রামের বাসিন্দা, বৃদ্ধা সরস্বতী দাসকেও ডেকে নেন মমতা। কারখানার জন্য তাঁর পাঁচ বিঘা জমি ‘জোর করে নেওয়া হয়েছিল’ বলে অভিযোগ করে বৃদ্ধা সামিল হয়েছিলেন কৃষিজমি রক্ষার আন্দোলনে। এ দিন মমতা সভাস্থল ছেড়ে চলে যাওয়ার পরে সরস্বতী বলেন, ‘‘কবে যে জমি ফেরত পাব!’’ সরকার তাঁদের মতো ‘অনিচ্ছুক’ জমি মালিকদের ২ হাজার টাকা ভাতা, ২ টাকা কেজি দরে চাল দিচ্ছে জানিয়েও সরস্বতীর আক্ষেপ, ‘‘খুব খারাপ লাগে। নেত্রী তো আশ্বাস দিলেন। অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় কী!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy