মঙ্গলবার মঙ্গলকোটের বেলগ্রামের সভায় অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।
এ যেন সেই রঘু ডাকাতদের গল্প! ডাকাতি করার দিনক্ষণ আগাম জানিয়ে গৃহস্থকে বলে রাখা, যদি পারো তো সামলাও!
বীরভূমের কেষ্টদা কলির ভোটে সেই কৌশলই নিচ্ছেন! কী করবেন, কী ভাবে করবেন সব পষ্টাপষ্টি বলে দিয়ে মুচকি হাসছেন, ‘কেউ কিছু ধরতে পারবে না!’
নিজেকে জাদুকর বলে দাবি করছেন অনুব্রত মণ্ডল। বলছেন ‘‘ম্যাজিক দেখেছেন তো? কী ভাবে মুহূর্তে সব ভ্যানিশ হয়ে যায়! সামনে হাজার হাজার লোক বড়-বড় চোখ করে বসে থেকেও কিছু ধরতে পারে না। এটাও তাই। কেউ কিছু ধরতে পারবে না। সিপিএমের আমলেও তেমনই হতো।’’
‘কেউ’ বলতে কি তিনি নির্বাচন কমিশন বা কেন্দ্রীয় বাহিনীকে বোঝাচ্ছেন?
ঠোঁটের ফাঁকে ফের এক চিলতে হাসি ঝুলিয়ে তৃণমূল জেলা সভাপতি (যাঁর মাথায় অক্সিজেন কম যায় বলে দলনেত্রীর দাবি) বলেন, ‘‘সে আপনারা যা বোঝার, বুঝুন। আমি কিছু বলব না। তবে এটা বলতে পারি, কোনও বুথে বিরোধীদের এজেন্ট দেখা যাবে না। দিনের শেষে হা-হুতাশ করে সবাই বলবে অনুব্রত বুথ থেকে এজেন্ট তুলে নিতে বাধ্য করেছে। অথচ আমি যে কী করে বাধ্য করলাম সেটা কেউ বলতে পারবে না।’’
১৭ তারিখ, রাজ্যের তৃতীয় দফা ভোটের আগে অনুব্রতর নতুন দাওয়াই— ‘ভ্যানিশিং স্ট্র্যাটেজি’। পঞ্চায়েত ভোটের আগে পুলিশকে বোম মারার পরামর্শ দেওয়া, লোকসভা ভোটের আগে ‘গুড়’ (বোমা) ‘জল’ (মদ) তত্ত্বের প্রবক্তা অনুব্রতর এই নতুন স্ট্র্যাটেজিটি ঠিক কী?
কেষ্টর অনুগামীরা জানাচ্ছেন, ভোটের দিন যাতে কোনও বুথেই বিরোধী এজেন্টদের দেখা না যায়, সেটা নিশ্চিত করতে চান তাঁরা। তৃণমূলের ‘বিশ্বস্ত’ ভোটার ছা়ড়া রাস্তাঘাটেও আর বিশেষ কারও অস্তিত্ব যাতে টের পাওয়া না যায়, সে চেষ্টাও হচ্ছে। শুধু ১৭ তারিখ নয়, পরের দফাগুলিতে বর্ধমান, মুর্শিদাবাদের কিছু কেন্দ্রেও নাকি একই দাওয়াই প্রয়োগ করা হবে। কী ভাবে? তৃণমূল নেতা-কর্মীরা জানাচ্ছেন, যে সব পরিবার তৃণমূলকে ভোট দেবে কি না সংশয় রয়েছে, তাঁদের বাড়ির মহিলা ভোটারদের ‘বোঝাবেন’ তৃণমূলের মহিলা কর্মীরা। বোঝানো হবে— বুথে গেলে বিপদ আছে। লোকসভা ভোটে শাসক দলের দাপাদাপি দেখার পরেও সাধারণ পরিবারের মহিলারা ঝুঁকি নিতে চাইবেন বলেই মনে করা হচ্ছে। ফলে বুথে ওই মহিলাদের অস্তিত্ব ভ্যানিশ! অ-তৃণমূল বাড়ির পুরুষদের সরিয়ে দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে ভোটের আগের রাতে। কেষ্টর শিষ্যদের একটা বড় অংশ জানিয়েছেন, ১৬ তারিখ তাঁদের রাতভর ‘ডিউটি’ থাকবে। বোঝানো হবে ‘গুড়ের বাতাসার রং’।
গুড়ের বাতাসা? অনুব্রতর ব্যাখ্যা, ‘‘গুড়ের-বাতাসার রং হল একটু কালচে লাল। কালচে লাল কীসের রং জানেন?’’ বললাম, ‘‘শুকিয়ে যাওয়া রক্তের?’’ চোখ কুঁচকে হাসেন কেষ্টদা। বলেন, ‘‘আপনি বুঝে নিলেন। আমি কিন্তু কিছু বলিনি।’’ বিরোধী দলের কর্মী-সমর্থক-ভোটার এমনকী কেন্দ্রীয় বাহিনী— সকলের জন্যই ‘গুড়ের বাতাসা’ মজুত রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘‘আমি অতিথিপরায়ণ। একটু খাতির-যত্ন করতে ভালবাসি। ১৭ তারিখ কারও খাতিরের ত্রুটি হবে না।’’ তৃণমূলের এক নেতা বুঝিয়ে বললেন, ‘‘দাদা অনেককেই দাঁড় করিয়ে বলছেন, ‘কী রে, ফুল-ভ্যানিশ হবি নাকি হাফ-ভ্যানিশ ভেবে দেখ’। কথাটা শুনে আমাদেরই হাড় হিম হয়ে যাচ্ছে। ওই লোকগুলোর কী অবস্থা হচ্ছে, আঁচ করতে পারি। দাদা বলছেন, উনি এখন পি সি সরকারের চেয়েও বড় ম্যাজিশিয়ান। হাত ঘোরালেই সব ভ্যানিশ।’’
পঞ্চায়েত এবং লোকসভা ভোটে দলের জেলা সভাপতি অনুব্রতর ‘অবদান’ দেখেছে বীরভূম। বিরোধীরা তাই বলছেন, ‘‘কারও বাড়িতে হামলা করার আগে রঘু ডাকাত-বিশে ডাকাতেরা চিঠি পাঠিয়ে বলত, ‘অমুক দিন, তমুক সময় আমরা আসব। তৈরি থেকো’। নির্বাচন কমিশন আর জেলা প্রশাসন ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে রয়েছে বলে অনুব্রতও একই রকম হুমকি দেওয়ার সাহস পান।’’ তবে বিজেপির জেলা নেতা (যিনি এক সময় পাড়ুই, ইলামবাজারে অনুব্রতকে সমানে সমানে টক্কর দিতেন) এবং রামপুরহাটের প্রার্থী দুধকুমার মণ্ডলের টিপ্পনী, ‘‘এ সব হুঙ্কারের পুরোটাই ফক্কি। উনি ভাবছেন, হুমকি দেবেন আর লোকে ঘরে ঢুকে যাবে। তা হওয়ার নয়। মানুষ মুখ ফেরাচ্ছে। এ বার তৃণমূল দলটাই আস্তে-আস্তে ভ্যানিশ হবে।’’
কেষ্টর অনুগামীরা কিন্তু নিখাদ আত্মবিশ্বাসী। তাঁদের দাবি, কেষ্টদার উপরে যে ১৬টি বিধানসভা কেন্দ্রের দায়িত্ব রয়েছে (বীরভূমের ১১টি, বর্ধমানে তিনটি, মুর্শিদাবাদে দু’টি) তার সব কটিতেই দিদির মান রাখবেন তিনি। সোমবার রাতে বোলপুরে নিজের বাড়ির একতলায় বসে রীতিমতো শতাংশের হিসেব দিয়ে প্রত্যেকটি কেন্দ্রে জয়ের আগাম ঘোষণা করে দিলেন অনুব্রত নিজেও। এমনকী কোথায়, কত শতাংশ ভোট পড়তে দেবেন, জানালেন সে কথাও।
এ কেমন গণতন্ত্র যেখানে ভোটের আগেই ফল ঘোষণা হয়ে যায়? সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি, হাতের আটটা আঙুলে নানা রকমের গ্রহ-রত্নের আংটি। তেমনই একটি আংটি ঘোরাতে ঘোরাতে কয়েক সেকেন্ড প্রশ্নকর্তার চোখের দিকে স্থির তাকিয়ে থাকেন তিনি। বলেন, ‘‘এটাই আমার সিস্টেম। এখানে এটাই চলে।’’ পরক্ষণেই অবশ্য এর পিছনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়নের তত্ত্ব খাড়া করেন তিনি। বলেন, ‘‘মানুষ তো চোখের সামনে সব দেখছে। এত উন্নতি দেখে তাঁরা যে আমাদের ভোট দেবেন, সেটাই স্বাভাবিক।’’ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বিরোধীদের অস্তিত্ব উড়িয়ে অনুব্রতর মন্তব্য, ‘‘ওঁরা সব ছোটখাটো মুদির দোকানদার। চার-পাঁচ হাজার টাকার মাল নিয়ে থাকেন। ট্রাক বোঝাই মাল ওঁদের কাছে থাকে না। ওঁদের সম্পর্কে আর কী-ই বা বলতে পারি?’’ নারদা-পরর্বর্তী সময়ে ‘মাল’ বলতে কী বোঝাচ্ছেন তিনি? সশব্দ হেসেজবাব এল, ‘‘আনন্দবাজার যে মানে বুঝতে চাইছে বুঝুক।’’
কেষ্টদার কথার অনেক মানেই এখন উড়ে বেড়াচ্ছে বীরভূমের বাতাসে। দলে ঘনিষ্ঠদের কথায়, ‘‘দাদা বলেছেন, ১৬ তারিখ থেকে চড়াম-চড়াম করে ঢাক বাজবে। চড়াম-চড়াম করে ঢাকে কাঠি পড়বে, না পিঠে লাঠি, সেটা দাদা স্পষ্ট করেননি। যার যা বোঝার, বুঝে নিক।’’
রাজ্যবাসী জানেন, অনুব্রতর এক-একটা বিতর্কিত মন্তব্যের পরে বিরোধীরা রে-রে করে রিপোর্ট করেন কমিশনে। এমন সব কাণ্ডে দল চটে না? অনুব্রতর জবাব, ‘‘যা করি, যতটা করি— সবটা দিদিকে জানিয়ে করি। ১৭ তারিখের ভোটেও আমাদের গেমপ্ল্যানটা কী, সেটা সব চেয়ে ভাল জানেন ওই এক জনই।’’
উঠে আসার আগে প্রতিবেদকের ভিজিটিং কার্ডটা চেয়ে নিলেন অনুব্রত। পকেট ঢোকাতে ঢোকাতে বললেন ‘‘১৯ মে দুপুর ১টা নাগাদ আমার ফোনের জন্য অপেক্ষা করবেন। অনুব্রত যা বলে, সেটাই যে ফলে সেটা আপনাকে ফোন করে মনে করাব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy