৯০টি গণনাকেন্দ্রে কি আজ ঝড় উঠছে? পূর্বাভাস কী বলছে? কোন দিক থেকে উঠবে ঝড়? আছড়েই বা পড়বে কোন শিবিরে?
রাজনৈতিক আবহবিদেরা এ বার ঘোর দুর্বিপাকে। ঝড় বাম দিক থেকে উঠতে চলেছে, নাকি ডান দিক থেকে, এ নিয়ে বিস্তর বিভ্রান্তি তাঁদের। অনেকে আবার বলছেন, বৃহস্পতিবার কোনও ঝড়ই উঠবে না। হাওয়া ভাগ হয়ে গিয়ে কিছুটা ডানে বইবে, কিছুটা বামে। হাওয়া-পাল্টা হাওয়ার লড়াইতে কোনও এক পক্ষ সামান্য একটু এগিয়ে গিয়ে ধুলোয় ভরিয়ে দেবে প্রতিপক্ষের ঘর-বারান্দা।
সম্ভাবনা-১: তৃণমূলই ক্ষমতা ধরে রাখবে। তবে ঝড় তুলে নয়, স্বল্প ব্যবধানে।
প্রায় সবক’টি ভোট পরবর্তী সমীক্ষাই বলছে, তৃণমূল ক্ষমতা ধরে রাখতে চলেছে বাংলায়। কিন্তু অধিকাংশ সমীক্ষাতেই ইঙ্গিত, আসন কমছে তৃণমূলের। ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে লড়ে তৃণমূলের ঝুলিতে ঢুকেছিল ১৮৪ আসন। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে একা লড়েও চতুর্মুখী লড়াইয়ের সুবাদে ২১৪টি বিধানসভা কেন্দ্রে লিড নিয়েছিল শাসক দল। এ বারও তৃণমূল একাই লড়ছে। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর চতুর্মুখী নয়। এমনকী পুরোপুরি ত্রিমুখীও নয়। মূল লড়াই তৃণমূল বনাম বাম-কংগ্রেস জোটের মধ্যে। বিজেপি ময়দানে রয়েছে, তবে লোকসভা নির্বাচনের মতো মোদী ঝড়ে সওয়ার হয়ে নয়। অর্থাৎ বিরোধী ভোটের ছত্রখান ভাগাভাগি এ বার হচ্ছে না। তাই তৃণমূল ২০১৪ সালে যে ২১৪ আসনে এগিয়ে গিয়েছিল, ততগুলিতে তো নয়ই, এমনকী ২০১১ সালে জেতা ১৮৪টি আসনেও তৃণমূল জিততে পারবে না বলে সমীক্ষক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। এবিপি আনন্দ-নিয়েলসনের সমীক্ষাতেও বলা হয়েছে, তৃণমূল সর্বোচ্চ ১৬৩টি আসনে জিততে পারে। অর্থাৎ আগের বারের চেয়ে ২১টি কম এবং ম্যাজিক ফিগারের চেয়ে মাত্র ১৫টি বেশি। তৃণমূল যে আসনগুলিতে জিততে পারে বলে মনে করা হচ্ছে, তার মধ্যে ২৫টি আসনে আবার হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। এর মধ্যে বেশ কিছু আসনে যদি হার হয়, তা হলে গরিষ্ঠতার জোর আরও কমবে। অর্থাৎ কোনওক্রমে ম্যাজিক ফিগার টপকে সরকার গড়ার সংখ্যাটুকু অর্জন করবে তৃণমূল।
পাঁচ বছর ধরে বিপুল উন্নয়ন হয়েছে বলে দাবি করা সত্ত্বেও তৃণমূলকে এত কম গরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গড়তে হতে পারে কেন? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ভোটের মুখে নারদ স্টিং-এর সামনে আসা, উড়ালপুল ভেঙে পড়ার ঘটনা তো রয়েইছে। এলাকায় এলাকায় তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও উঠেছে দেদার। তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বও দলের ক্ষতি করেছে বিভিন্ন কেন্দ্রে।
অন্য দিকে বাম-কংগ্রেসের জোট বিরোধী ভোটের ভাগ হওয়া যেমন রুখেছে, তেমনই বিকল্প শক্তি হিসেবে নিজেদের খানিকটা তুলে ধরতেও পেরেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, সব মিলিয়ে তৃণমূল কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ঠিকই। কিন্তু তাতে তৃণমূলকে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব হবে না বলে বিশ্লেষকদের একাংশের ধারণা। তাঁরা বলছেন, দুর্নীতির অভিযোগ শহুরে এবং উচ্চশিক্ষিত মধ্যবিত্তের মধ্যে প্রভাব ফেললেও, বিপুল সংখ্যক গ্রামীণ ভোটারদের মধ্যে এই সব ইস্যুর তেমন প্রভাব নেই। বরং দু’টাকা কিলো দরে চাল, সবুজসাথী প্রকল্পে ঘরে ঘরে সাইকেল বিলি, কন্যাশ্রী প্রকল্পের টাকা দেওয়া, ক্লাবে ক্লাবে অনুদান— এমন নানা জনমোহিনী পদক্ষেপ ও তার ফলাও প্রচার তৃণমূলকে গ্রামবাংলায় এগিয়ে রাখবে। তাতেই সামান্য ব্যবধানে হলেও জোটকে পিছনে ফেলে দেবে তৃণমূল।
সম্ভাবনা-২: বিশ্লেষকদের একাংশ বলছেন, তৃণমূল ক্ষমতা ধরে রাখতে পারছে না। সামান্য ব্যবধানে হলেও এগিয়ে যাচ্ছে জোট।
যাঁরা এই মতে বিশ্বাসী, তাঁরা বলছেন, নারদ, উড়ালপুল, সিন্ডিকেট, দুর্নীতি, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব— এই সমস্ত ফ্যাক্টর নস্যাৎ করে তৃণমূলের পক্ষে ম্যাজিক ফিগারে পৌঁছনো সম্ভব হবে না। শুধু শহরাঞ্চলে নয়, গ্রামেও এই সব ইস্যুর যথেষ্ট প্রভাব পড়েছে। ২টাকা কিলো দরে চাল দেওয়ার ব্যবস্থা যে আসলে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের আওতায় হচ্ছে, তাও বহু মানুষ জানেন।
এর পাশাপাশি সংখ্যালঘুরাও নাকি মুখ ফিরিয়েছেন তৃণমূলের দিক থেকে। কারণ, সংখ্যালঘুদের উন্নয়নে দেওয়া সব প্রতিশ্রুতি পূরণ করে দেওয়া হয়েছে বলে যে দাবি বার বার মমতা করেছেন, তাতে প্রতারিত বোধ করেছেন সংখ্যালঘুরা। উন্নয়নের যে ফিরিস্তি মুখ্যমন্ত্রী দিয়ে থাকেন, বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যায়নি বলেই নাকি মনে করছেন সংখ্যালঘুরা। তাঁরা বাম-কংগ্রেস জোটকে ধর্মনিরপেক্ষতার নিরিখে মমতার চেয়ে বেশি বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করছেন বলেও এই বিশ্লেষকদের মত।
এর পাশাপাশি ফ্যাক্টর হতে চলেছে বিজেপি-র থেকে কেটে আসা ভোট। এ বিষয়ে প্রায় সব বিশ্লেষকই এক মত যে বিজেপি গত লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় যে ১৭ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, তা এ বার তারা পায়নি। বিজেপি এ বার খুব বেশি হলে ৭ শতাংশ ভোট পেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। তা হলে বিজেপি-র ভাগ থেকে বেরিয়ে আসা ১০ শতাংশ ভোট কোন দিকে যাবে, তার উপর ভোটের ফল অনেকটা নির্ভর করছে। বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, ২০১৪-র লোকসভা ভোটে অনেকে মোদী ঝড়ের কারণে বিজেপি-কে ভোট দিয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু অধিকাংশই বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন তৃণমূলের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ভেবে। এই ভোটাররা মূলত তৃণমূল বিরোধী ভোটার। তাঁরা কিছুতেই তৃণমূলকে ভোট দেবেন না। যেহেতু বাম-কংগ্রেস জোট তৃণমূলকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে, তাই এই ভোটাররা এ বার জোটেই ভোট দেবেন।
এর পাশাপাশি রয়েছে ভোটে সে ভাবে জল মেশাতে না পারার ফ্যাক্টর। লোকসভা নির্বাচনে কমিশনের এত কড়াকড়ি ছিল না। প্রায় সব জেলাতেই তৃণমূল অবাধে ভোটে জল মিশিয়েছিল বলে অভিযোগ। এ বার তার পরিমাণ অনেকটা কম। তাই তৃণমূলের বিপদ আরও বেড়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, গ্রামবাংলায় তৃণমূলের শিকড় যতই মজবুত হোক, বিজেপির ভোট কমে গিয়ে তার সিংহভাগ বিরোধীদের দিকে যাওয়া এবং ভোটে জল মেশাতে না পারার জেরে অনেক কেন্দ্রেই পিছিয়ে পড়তে হবে তৃণমূলকে। বাম-কংগ্রেস ১৫০ ছাড়িয়ে যাবে এবং সরকার গড়ে ফেলবে।
সম্ভাবনা-৩: বিশ্লেষকদের মধ্যে আরও একটি অংশ রয়েছেন, যাঁরা ঝড়ের তত্ত্বেই বিশ্বাস রাখছেন। বলছেন, তৃণমূল বা জোট যে-ই জিতুক, বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়ে প্রতিপক্ষকে ধুলিসাৎ করবে তারা।
এই বিশ্লেষকদের মতে, ইস্যুভিত্তিক লড়াই দু’পক্ষকেই হাড্ডাহাড্ডি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পৌঁছে দিয়েছিল। ভোটাররা দু’পক্ষের কথাই শুনেছেন। তবে বিভ্রান্ত হয়ে নয়, বরং মনস্থির করেই দলে দলে ভোট দিয়েছেন। কোনও এক পক্ষকেই বিপুল সংখ্যায় বেছে নিয়েছেন। তাই যাঁরা জিতবেন, তাঁরা বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়েই জিতবেন। ২০০টির বেশি আসন নিয়ে ক্ষমতায় আসবেন।
আরও পড়ুন:
তৃণমূল না জোট, কে বসবে সিংহাসনে? দেখুন কী বলছেন জ্যোতিষীরা
এই পূর্বাভাসের পক্ষে যুক্তিও দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। তাঁরা বলছেন, প্রথমত, বাংলায় যে দলই ক্ষমতায় আসে, বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়েই আসে। কংগ্রেস হোক বা বামফ্রন্ট, যে দল যখন ক্ষমতায় এসেছে, বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়েই এসেছে। ৩৪ বছর পর বামফ্রন্ট যখন ক্ষমতা থেকে গিয়েছে, তখন তৃণমূলও বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়েই এসেছে।
শুধু সামগ্রিক ফলে নয়, কোনও একটি কেন্দ্রে দুই মহারথীর হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের ক্ষেত্রেও বাংলার রায় বার বারই কোনও এক দিকে বেশি করে ঢলে পড়েছে। বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের বিখ্যাত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গোটা রাজ্যের চোখ টেনেছিল। হাই-প্রোফাইল যুদ্ধ ছিল। হাড্ডহাড্ডি লড়াই ছিল। কিন্তু ভোট গণনায় দেখা যায়, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় বিপুল ভোটে হারিয়েছেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়কে। দিনহাটা বিধানসভায় দুই প্রবাদপ্রতিম বামপন্থী নেতা কমল গুহ আর দীপক সেনগুপ্তর লড়াইতেও ব্যবধান ছিল বিপুল। একেবারে হাল আমলের কথা ধরতে গেলে, ২০১১-সালে দমদম বিধানসভা কেন্দ্রে গৌতম দেব-ব্রাত্য বসুর টানটান লড়াইতেও ব্রাত্যর পক্ষে ব্যবধান ছিল বিপুল। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে উত্তর কলকাতা হয়ে উঠেছিল সবচেয়ে নজরকাড়া কেন্দ্র। দীর্ঘ দিনের সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, দাপুটে এবং জনপ্রিয় বাম নেত্রী রূপা বাগচি, প্রদেশ কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি তথা কংগ্রেসের অন্যতম শীর্ষ নেতা সোমেন মিত্র এবং রাজ্য বিজেপির সভাপতি রাহুল সিংহের মধ্যে লড়াই ছিল উত্তর কলকাতায়। জমজমাট প্রচারযুদ্ধ দেখে অনেকেই বলেছিলেন, ফোটোফিনিশে হারজিতের ফয়সলা হবে। কিন্তু ইভিএম খুলতেই দেখা গিয়েছিল, সুদীপ লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে জয়ী।
বিশ্লেষকরা এই সব উদাহরণ তুলে ধরে বলছেন, যাঁরা জিতবেন, ২০০-র বেশি আসন নিয়েই জিতবেন। কারণ বাংলার প্রবণতাই হল কোনও এক দিকে বেশি করে ঢলে পড়া।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy