ভোট-পর্ব শেষ হয়েছে সবে ২৪ ঘণ্টা আগে। এখনও সরকারি ভাবে কোনও হিসেব হাতে আসেনি। কিন্তু তার মধ্যেই শাসক ও বিরোধী জোটের বুথভিত্তিক ভোট পড়ার আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে, ৮৫ থেকে ৯০ বা তারও বেশি শতাংশ ভোট উত্তরেও খুব কম পড়েনি। এবং বিরোধীদের শক্ত প্রতিরোধ ও কমিশনের নজরদারি সত্ত্বেও এই নিয়ে শাসকদের বিরুদ্ধে আঙুল উঠছে অনেক ক্ষেত্রেই।
আঙুল উঠছে বিরোধীদের কারও কারও দিকেও। ভোট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শাসকই হোন বা বিরোধী, একটা কথা মাথায় রাখতে হবে। কোনও বুথে যদি ৮৫ শতাংশের বেশি ভোট পড়ে, তা হলে বুঝতে হবে সেই দুধে জল আছে।
বিরোধী তথা বামেরা এই ব্যাপারে অনেক বেশি সংযতবাক। তাদের মুখে কুলুপ। কিন্তু শাসক দলের আলোচনা খোলামেলা। তাঁদের অনেকেই ঘরোয়া আড্ডায় মেনে নিচ্ছেন, বিরোধীদের জমাট প্রতিরোধের মধ্যেও যেখানে সুযোগ মিলেছে, সেখানেই তড়িঘড়ি জল মেশানোর চেষ্টা চলেছে। শাসক দলের কয়েক জন তাবড় নেতা চুপিচুপি যে বার্তা দেন তা এরকম— ‘‘উত্তরের ক্ষীরটা যে আমরা বেশি খেতে পারব না, তা নিয়ে তো কারও সন্দেহ নেই। তাই জল-টল মিশিয়ে যতটা মান-সম্মান বাঁচানো যায়।’’
কোথায় কতটা জল মেশানোর সুযোগ মিলেছে? শাসক ও বিরোধী জোটের শিবির বলছে, রবিবার উত্তরবঙ্গের যে ৪৫ আসনে ভোট হয়েছে, তার কোন বুথে কত শতাংশ ভোট পড়েছে, সেই হিসেব সরকারি ভাবে মিলতে সময় লাগবে। কিন্তু, নানা দলের পোলিং এজেন্টরা বুথের হিসেব জমা দিয়েছেন দলের কাছে। তা থেকে একটা ধারণা মিলতে পারে। সেই সুবাদেই দেখা যাচ্ছে মালদহ, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুরে বেশ কিছু বুথে ৯০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে। মানিকচক, কুশমন্ডি, ইটাহারের কয়েকটি বুথেও এমন ঘটেছে বলে প্রাথমিক ভাবে হিসেব পেয়েছেন দলীয় নেতৃত্ব। তপন বিধানসভায় কমপক্ষে ৫টি বুথে ৯০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে বলে খবর পেয়েছেন কংগ্রেসের দক্ষিণ দিনাজপুরের জেলা সভাপতি নীলাঞ্জন রায়। তপনের মতো এলাকায় গড়পরতা ভোট পড়ে ৭০-৭৫ শতাংশ। সেখানে এতটা ভোটবৃদ্ধি জল মেশানোর মোক্ষম দৃষ্টান্ত হতে পারে বলে নীলাঞ্জন মনে করছেন।
ডুয়ার্সের কালচিনি, মাদারিহাটে দেদার জল মেশানোর অভিযোগ উঠেছে। বিজেপি-গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা কালচিনি ও মাদারিহাট নিয়ে উল্লসিত হওয়ায় সন্দেহের তির তাদের দিকে। কিন্তু, বিজেপি-মোর্চা নেতারা দাবি করছেন, মানুষ ঢেলে ভোট দিয়েছে। জলপাইগুড়ির ডাবগ্রাম-ফুলবাড়িতে একাধিক বুথে ৯০ শতাংশের বেশি ভোট হয়েছে। সেখানকার তৃণমূল প্রার্থী গৌতম দেবও ‘মানুষের ভোট দেওয়ার উৎসাহের’ গল্প সামনে তুলে ধরছেন। যা শুনে হাসছেন সেখানকার সিপিএম প্রার্থী দিলীপ সিংহ। তাঁর স্বগতোক্তি, ‘‘কোথাকার জল কোথায় গড়াবে, তা টের পেতে খুব বেশি দেরি নেই। আর তো মোটে এক মাস।’’
শাসক দল অবশ্য জল মেশানো নিয়ে চিন্তাতেই রয়েছে। উত্তর বিরোধীদের এতটাই শক্ত ঘাঁটি যে, এখানে জল মেশানো কাক্কেশ্বর কুচকুচের হিসেবে উধোর তিন ফোঁটা চোখের জল পড়ার থেকে বেশি নয়। অথচ, বারবার নেত্রীর উত্তর-সফর, মিটিং-মিছিলের পরে ৪৫টি আসনের মধ্যে যদি দুই সংখ্যাতেও পৌঁছনো না যায়, তা হলে মুখ থাকে না।
রাজগঞ্জ, ফালাকাটায় শাসক শিবিরের নিচুতলায় অনেকেই এমন নানা প্রশ্ন তুলে বিড়বিড় করছিলেন। জলপাইগুড়ির এক নেতার আক্ষেপ, টেন্ডার নিয়ে নিজেরা মারপিট করে, সিন্ডিকেটের দখল নিয়ে সারা বছর খেয়োখেয়ি করে ভোটের দিন একজোট হয়ে জল মেশানোর মেশিনারি বানানো চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। তাই দার্জিলিঙে ৬-০, জলপাইগুড়িতে ৭-২ এর আশঙ্কা মাথায় নিয়ে চিন্তায় আকুল ওই নেতার অনুগামীরা। কেউ কেউ কানে কানে বলেন, ‘‘জল-টল দিয়ে কতটা লাভ হবে, সত্যিই বুঝতে পারছি না।’’
তবে চোপড়ায় জলের হিসেবটা অনেক সহজ বলে মনে করছেন শাসক দলের একাংশ। সেখানে ললিতগছ এবং বাউরিগছের দু’টি বুথে ৯৪ এবং ৯৩ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রের খবর। এই হার দেখে চোপড়ার নির্দল প্রার্থী অশোক রায়ের মন্তব্য, ‘‘কী পরিমাণ জল যে মেশানো হয়েছে, তা ভেবে আঁতকে উঠছি।’’ ধূপগুড়ি নিয়ে আশাবাদী শাসক শিবিরে উত্তরবঙ্গের কোর কমিটির একাধিক নেতা। সেখানে ঘোষপাড়া প্রাথমিক স্কুলের ১০২০ জন ভোটারের মধ্যে ভোট পড়েছে ৯৭৮টি, প্রায় ৯৬%।
কিন্তু, একটা-দুটো বুথে জল মিশিয়ে কাজ হবে কি, সেই প্রশ্ন উঠছে শাসক দলের অন্দরেই।
মালদহে তৃণমূলকে যিনি ১২-০ গোলে হারাতে চান, সেই জেলা কংগ্রেসের সভানেত্রী মৌসম নূর কিছুটা উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, ‘‘কয়েকটা বুথে ৯০% ভোট পড়াটা চিন্তার। তৃণমূল জল মিশিয়ে থাকতে পারে।’’ কিন্তু, তৃণমূল জেলা সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘‘কংগ্রেস, বামই জল মিশিয়েছে।’’
অশোক ভট্টাচার্য পুরসভার ২০ নম্বর ওয়ার্ডে থাকেন। সেখানে তিনি নেতাজি বয়েজ হাইস্কুলের বুথে ভোট দিয়েছেন। সেখানে দুটি বুথে ৯২% ও ৯৩% ভোট পড়েছে। অশোকবাবুর মন্তব্য, ‘‘আবহাওয়া অনুকূল বলেই প্রচুর মানুষ ভোট দিতে এসেছে।’’ তৃণমূলের প্রার্থী ভাইচুং কারচুপির অভিযোগ করেন। কিন্তু, ওই ওয়ার্ডের বাসিন্দা তৃণমূল জেলা সভাপতি রঞ্জন সরকার মনে করেন, এই ভোট ভাইচুংয়ের পক্ষে গিয়েছে।
মোট কথা, ১৯ মে অবাক জলপান কে করেন, এখন তারই অপেক্ষায় উত্তরবঙ্গ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy