যে স্টিং অপারেশনের ভিডিও সামনে এল, তাতে কার কী ভাল হল জানি না। ভারতীয় গণতন্ত্রের খুব খারাপ হল। স্টিং অপারেশনকে খারাপ বলছি না। কিন্তু স্টিং অপারেশনের মাধ্যমে যে ঘটনা সাধারণ মানুষ দেখলেন, সেই ঘটনার নিন্দার ভাষা পাচ্ছি না। ভারতীয় গণতন্ত্রের উপর এ এক তীব্র আঘাত। জঙ্গি হানার চেয়েও বড় আঘাত। তৃণমূল নেতাদের এই চরম দুর্নীতির ছবি দেশের গণতন্ত্রকে ভিতর থেকে দুর্বল করবে। ভারতের শাসন ব্যবস্থার উপর সাধারণ মানুষের আস্থা কমতে শুরু করবে। একটা স্টিং অপারেশনের ভিডিওতে রাজ্যের মানুষ বা দেশের মানুষ কী দেখছেন? দেখছেন, তাঁর নির্বাচিত প্রতিনিধি কর্পোরেট হাউজের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছেন সরকারকে ওই কর্পোরেট হাউজের হয়ে কাজে লাগাবেন বলে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের এমন ছবি সাধারণ মানুষের সামনে ফুটে ওঠা যে কোনও গণতন্ত্রকে অনেকখানি পিছিয়ে দেয়। আমাদেরও তা-ই হল। অনেক পিছিয়ে গেলাম আমরা।
ইউপিএ-১ আমলে এই রকম একটা ঘটনা ঘটেছিল। সেই কেলেঙ্কারিকে ‘ক্যাশ ফর কোয়্যারি’ নামেই আমরা সকলে চিনি। সংসদে নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে প্রশ্ন তোলার জন্য বিপুল ঘুষ নিয়েছিলেন ১১ জন সাংসদ। সাংসদদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠতেই সর্বদলীয় কমিটি গঠন করেছিলেন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। সেই কমিটি অভিযোগের সত্যতা খতিয়ে দেখে রিপোর্ট জমা দেয়। রিপোর্টের ভিত্তিতে ১১ সাংসদকে বহিষ্কার করে দেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। স্পিকারের সেই বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত সে দিন সংসদের গরিমাকে রক্ষা করেছিল। সারা দেশে একটা বার্তা গিয়েছিল, ভারতের সংসদ দুর্বল নয়। নিজের গরিমা রক্ষা করার ক্ষমতা সংসদের নিজেরই আছে।
এ বার সে রকম কিছু হল না। তৃণমূলের যে সাংসদদের ঘুষ নেওয়ার ভিডিও দেখা গেল, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার সাহসই দেখাতে পারল না বিজেপির সরকার। এথিক্স কমিটির কাছে পাঠানোর নাম করে ঠান্ডা ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হল গোটা বিষয়টিকে। কবে এথিক্স কমিটি স্টিং অপারেশনের সত্যাসত্য বিচার করে উঠতে পারবে, কবে রিপোর্ট দেবে, কবে তার ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, কারও জানা নেই। তা ছাড়া, লোকসভার না হয় এথিক্স কমিটি আছে। রাজ্যসভার তো নেই। তৃণমূলের রাজ্যসভা সদস্য মুকুল রায়ের ছবিও তো দেখা গিয়েছে স্টিং ভিডিওতে। তাঁর বিচার কে করবে? আসলে বিজেপি তথা সরকার পক্ষ চায়ই না এই বিচার করতে। এথিক্স কমিটিতে পাঠানো আসলে দেশবাসীর চোখে ধুলো দেওয়ার চেষ্টা।
কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত ছিল স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ব্যবস্থা নেওয়া। সংসদকে কাজে লাগিয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত সাংসদদের বিরুদ্ধে কঠোরতম পদক্ষেপ করা উচিত ছিল। কানহাইয়া কুমাররা জেএনইউ-এর ভিতরে কী আন্দোলন করছেন, তা নিয়ে কেন্দ্রের মাথ্যাব্যাথার শেষ নেই। অতিসক্রিয় হয়ে কাউকে গ্রেফতার করছে, কাউকে জেলে ভরছে, কাউকে জেরা করছে, কাউকে উকিল-বাহিনী দিয়ে মার খাওয়াচ্ছে। জেএনইউ পর্বে কী না করল বিজেপি তথা কেন্দ্রীয় সরকার! আর দুর্নীতিতে আপাদমস্তক ডুবে যাওয়া তৃণমূল দলের সাংসদরা ভারতীয় গণতন্ত্রের গায়ে এত গাঢ় কালির দাগ লাগিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও কেন্দ্রের তেমন কোনও হেলদোল নেই। ভাবা যায়! এমন ভয়ঙ্কর দুর্নীতি চাপা দিচ্ছে সরকার! মানুষের আস্থা সরকারের উপর কেন থাকবে?
আশ্চর্য হয়ে দেখছি, পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভাও কিছুই করল না। একাধিক বিধায়ক এবং মন্ত্রীর ছবি দেখা গিয়েছে স্টিং অপারেশনের ভিডিওতে। কিন্তু বিধানসভা যেন জানেই না কিছু। চক্ষুলজ্জা বলেও তো একটা ব্যাপার আছে। এঁদের সেটুকুও কি নেই? কেউ নিশ্চয়ই ভুলে যাননি, রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার থাকাকালীন এক বাম বিধায়কের বিরুদ্ধেও ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। সেই অভিযোগও এক স্টিং অপারেশনের মাধ্যমেই সামনে এসেছিল। সেই বাম বিধায়ক মহম্মদ ইলিয়াসকে কিন্তু অবিলম্বে পদত্যাগ করিয়েছিলাম আমরা। কবে স্টিং অপারেশনের সত্যাসত্য বিচার হবে, কবে দোষ প্রমাণিত হবে, তার জন্য আমরা অপেক্ষা করিনি। বিধায়কের বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার স্টিং ভিডিও সামনে আসার পর যে তাঁকে আর বিধানসভায় থাকতে দেওয়া যায় না, সংসদীয় ব্যবস্থার প্রতি সামান্যতম শ্রদ্ধা যাঁর রয়েছে, তিনিই সেটুকু বুঝতে পারবেন। ইলিয়াসের স্টিং ভিডিও যিনি শ্যুট করেছিলেন, সেই সাংবাদিক শঙ্কুদেব পন্ডা পরে তৃণমূলের নেতা হলেন। গোটা রাজ্য ইতিমধ্যেই দেখে নিয়েছে, সেই শঙ্কুদেব কতটা দুর্নীতিগ্রস্ত। প্রথমে সারদা কাণ্ডে নাম জড়িয়েছে। তার পর নারদের স্টিং ভিডিওতেও তাঁকে দেখা গিয়েছে। আরও এক জনের কথা বলি। সৌগত রায়। এখন তিনি সাংসদ। যখন ইলিয়াসের বিরুদ্ধে স্টিং ভিডিও সামনে আসে, তখন সৌগতবাবু বিধায়ক ছিলেন। তিনিই পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় স্বাধিকার ভঙ্গের প্রস্তাব এনে মহম্মদ ইলিয়াসের বিরুদ্ধে প্রথম সরব হয়েছিলেন। ইলিয়াসের তো শাস্তি হয়েছিল। তৎক্ষণাৎ হয়েছিল। কিন্তু এ বার যখন স্টিং ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সেই সৌগত রায়ই লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ নিচ্ছেন, তখন কী হবে? যে সৌগত রায় ইলিয়াসের স্টিং ভিডিও দেখেই রে রে করে উঠেছিলেন সত্যাসত্য প্রমাণের অপেক্ষা না করে, সেই সৌগত রায় এখন নিজে থেকেই সাংসদ পদে ইস্তফা দেবেন না কেন? ইলিয়াসের সময়ে তো স্টিং ভিডিওকে সত্যি বলেই ধরে নিয়েছিলেন। এখনকার ভিডিওটাকে সত্যি বলে মানতে পারছেন না কেন?
এক জন আইপিএস খোলামেলা ঘুষ খাচ্ছেন। অথচ তাঁর বিরুদ্ধে একটা বিভাগীয় তদন্ত পর্যন্ত হচ্ছে না! কেউ কোনও উচ্চবাচ্য করছে না! ভাবতেই পারছি না। সরকার মানে তো শুধু কয়েক জন মন্ত্রী নন। আইএএস-রা রয়েছেন, আইপিএস-রা রয়েছেন। নেতা-মন্ত্রীদের সঙ্গে আইপিএস অফিসারের অশুভ আঁতাত আর ঘুষের লেনদেনের ছবি সামনে আসার পর সেই আমরালাই বা চুপচাপ বসে কেন? স্বরাষ্ট্রসচিব কী করছেন? ডিআইজি কী করছেন? কোনও উত্তর নেই। এঁদের বিরুদ্ধেও বিভাগীয় তদন্ত হওয়া দরকার। আমরা সরকার গঠন করলে, এঁদের সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।
রাজধানীর বুকে বাংলার রাজনীতিকদের সব সময়ই একটা আলাদা সম্মান ছিল। বাঙালি সাংসদ বা মন্ত্রীদের নাম দুর্নীতিতে জড়াত না। ক্যাশ অ্যান্ড কোয়্যারিতে কোনও বাঙালি সাংসদের নাম জড়ায়নি। হাওলা কেলেঙ্কারিতে কোনও বাঙালির নাম জড়ায়নি। একের পর এক বড় বড় কেলেঙ্কারির ঝড় আছড়ে পড়েছে দিল্লির ক্ষমতার অলিন্দে। বাঙালি রাজনীতিকদের গায়ে তার আঁচ লাগেনি। তাই দিল্লিতে আমরা সব সময় মাথা উঁচু করে চলতাম। কিন্তু গত কয়েক বছরে একের পর এক কেলেঙ্কারিতে নাম জড়াচ্ছে বাংলার সাংসদের, নেতাদের, মন্ত্রীদের। সম্মান ধুলোয় মিশে গিয়েছে।
আবার বলছি, গণতন্ত্রের উপর থেকে মানুষের আস্থা উঠে যাবে। মানুষ ভুল পথে চালিত হবে। তার দায় বর্তাবে এই দুই সরকারের উপর— তৃণমূলের সরকার আর বিজেপির সরকারের উপর। এঁদের সঙ্গে উগ্রপন্থীদের কোনও পার্থক্য নেই। উগ্রপন্থীরা দেশের উপর আঘাত হানতে আসে বাইরে থেকে। এঁরা তাদের চেয়েও ভয়ঙ্কর। কারণ এঁরা ভিতর থেকে দেশকে দুর্বল করছে। আমরা তাই সর্বাত্মক আন্দোলনে নেমেছি। সব ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক শক্তিকে একত্রিত করে লড়াইতে নেমেছি। বলছি, মানুষকে সমবেত কর, লুঠেরাদের হঠাও। স্ট্রিট কর্নার থেকে জনসভা, মিছিল থেকে অবস্থান— সর্বত্র আমরা তুলে ধরছি তৃণমূলের এই কলঙ্কিত রূপটা। তৃণমূলের মতো ইট-মারা আন্দোলনে অবশ্য আমরা বিশ্বাসী নই। আমরা সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে চলি। তৃণমূল ইট-মারা গণতন্ত্রের পথে চলে। আমরা যা কিছু করছি, যা কিছু করব, সংসদীয় রীতিনীতি মেনেই করব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy