এই মুহূর্তে ঠিক কেমন আছে পশ্চিমবঙ্গ? কেমন ছিল গত পাঁচ বছর? ঠিক কোন অবস্থান থেকে এই বিষয়ের পর্যালোচনা শুরু করা উচিত? ভারতের মতো বহুতর বিত্তভোগী নাগরিকের দেশে, বিত্ত ও চেতনার পরিপ্রেক্ষিত অনুযায়ী, ভাল থাকার শর্ত বদলে যেতে থাকে। রাষ্ট্রের কাছে প্রত্যাশা এবং স্বপ্নপূরণ, দুই-ই শ্রেণিনির্ভর। রাজনীতি তার খবর রাখে এবং এই শ্রেণির অপেক্ষক সমাজ জারি রাখতে চায়।
এই শ্রেণি কেবল বিত্তের নিরিখে নয়। পেশা, ভৌগোলিক অবস্থান, ধর্ম, জাত, শিক্ষাস্তর, রাজনৈতিক মতাদর্শ ইত্যাদি নানা বৈশিষ্ট্য শ্রেণিবিভাজনে ব্যবহৃত হয়। রাজনীতিতে যত বাণিজ্যায়ন ঘটছে, তত শ্রেণি, উপশ্রেণি, উপৌপশ্রেণির জন্ম হচ্ছে। ক্ষমতা ভাগাভাগি করে এক-একটি অংশের দণ্ডমুণ্ডকর্তা হয়ে ওঠার সহজতম পন্থাই এই। ব্রিটিশের আমলে কথাটি ছিল ভাগ কর এবং শাসন কর, এখন হয়েছে ভাগ, দখল, ক্ষমতা। এর পর ভয়ে ভয়ে লুঠপাট কথাটি লিখলে মোটেই ভুল হবে না। ভারতের রাজনীতিতে কিছু প্রকাশ্যে, কিছু আড়ালে এই দুষ্টচক্র গোড়া থেকেই ছিল, আজও বেরোতে পারেনি, পশ্চিমবঙ্গেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। অবক্ষয় এমন অধোমুখী ও দ্রুত যে নীতি ও আদর্শ বলে রাজ্য রাজনীতিতে কিছু ঠাঁই পাচ্ছে না। ক্ষমতা ও সুবিধার খুল্লমখুল্লা লেনদেন আমরা দেখতে পাচ্ছি।
এই বছরটি পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক চালচিত্রে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বিধানসভা নির্বাচন আসন্ন। পাঁচ বছর আগে, তৎকালীন বিরোধী নেত্রী ও বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যতম ভূমিকায় ছিলেন। তাঁর প্রতিবাদ আন্দোলন, তাঁকে বিশ্বাস করে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল, তাঁরই ছায়ায় বুদ্ধিজীবীদের বামবিরোধী আন্দোলনে সামিল হওয়া এবং বুদ্ধিজীবী থেকে বিদ্বজ্জনে রূপান্তর। সব মিলিয়ে ২০১১ সালের পশ্চিমবঙ্গ ছিল রংদার, স্বপ্নময় এবং আলোড়িত।
কেমন ছিল সেই স্বপ্ন ও স্বপ্ন দেখানো প্রতিশ্রুতিগুলি, যাতে ৩৪ বছরের বামশাসনের অবসান সূচিত হয়েছিল? সে বার তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিশ্রুতিপত্রটি পড়ে অনেকেরই মনে হয়েছিল, এটি বামপন্থী নীতি সমন্বিত। তাঁদের বক্তব্যই একটু অদল-বদল করা। অর্থাৎ, যে সুসংগঠিত বামপন্থী দল, প্রধানত সিপিআইএম, তাদের শাসনের শেষ দিকে নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস আহ্বান করেছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তারই ধূলিকণা ও ভস্ম মেখে উঠে এসেছিলেন। মানুষ তাঁর সততা ও গঠনমূলক মানসিকতা বিশ্বাস করেছিল। বিশ্বাস করেছিল, গণতান্ত্রিক বাতাবরণ তৈরি হবে। বামশাসনের মধ্যে যে দলতন্ত্র ও সন্ত্রাস সৃষ্টি হয়েছিল তা থেকে মুক্ত হবে পশ্চিমবঙ্গ।
কিন্তু প্রথমেই যা হল, তৃণমূল শাসন কায়েম হতেই বিদ্বজ্জনদের কার্যত খরিদ করা হতে লাগল। তাঁদের মুখ বন্ধ করার জন্য বিলোন হল পদ, পাত পেড়ে দেওয়া হতে লাগল নানাবিধ পুরস্কার ও সম্মান। কতিপয় বুদ্ধিজীবী আত্মমর্যাদা রক্ষার্থে এই বিতরণী থেকে সরে দাঁড়ালেন। তাঁদের কোণঠাসা করার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। নাট্যকার মঞ্চ পান না, অভিনেতা কাজের সুযোগ পান না, চিত্রপরিচালকের ফিল্মটি ছাড়পত্র পায় না। শুরু হল সন্ত্রাস ও দলতন্ত্রের ফিসফিসে শাসন। জনদরদী মুখ্যমন্ত্রীর রাজ্যে গ্রন্থাগারে খবরের কাগজ রাখা নিয়ে অগণতান্ত্রিক বিজ্ঞপ্তি জারি হল। সাংবাদিক প্রহৃত হতে লাগলেন, কার্টুন প্রেরণের দায়ে যাদবপুরের অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র নির্যাতিত ও অসম্মানিত হলেন, পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণকাণ্ডে মুখ্যমন্ত্রী বলে বসলেন সব সাজানো। সব চক্রান্ত। এবং, পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডের আগেই ঘটে গিয়েছে নোনাডাঙা। উচ্ছেদ প্রতিবাদে অবস্থানকারীদের তুলে হাজতে পোরা হয়েছিল সে দিন, নির্যাতন করা হয়েছিল, মিথ্যে মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল আন্দোলনের নেতাদের। এবং এর পরই সারদা কেলেঙ্কারির বীভৎস বিস্ফোরণ। প্রশাসনিক ব্যর্থতা এবং নেতৃবৃন্দের লোভাতুর অসততার এক বিরল কিন্তু বিরাট উদাহরণ।
এর পরই পশ্চিমবঙ্গবাসী দেখেছে প্রতিশ্রুতির বন্যা। শুধু সারদায় প্রতারিতদেরই নয়, বিষমদপানে মৃত্যু, সেখানেও লক্ষাধিক ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি, অনুদানের খাতা তো খোলাই রয়েছে। শুধুমাত্র বিদ্বজ্জনদের দাক্ষিণ্য বিলোনই নয়, সহজ ভাবনা আচ্ছন্ন করে দিতে, দ্রুত মনের দখল নিতে, কত রকম অনুদান যে চালু করেছে এই সরকার তার হিসেব মেলা ভার। ক্লাবগুলোকে টাকা দেওয়া হচ্ছে, কন্যাজন্মকে শ্রীমণ্ডিত করা, সাইকেল বিতরণ, উৎসবের পর উৎসব, দেওয়াল রং করার মতো তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় থেকে শুরু করে ছাত্র রাজনীতিকে অসহিষ্ণু ও দুর্বিনীত করে তোলা পর্যন্ত সর্বত্র এই সরকারের আগ্রাসী হাতের ছাপ। গত পাঁচ বছরে যত শিক্ষকের অপমান ঘটেছে, নিয়োগ-অপসারণের গা-জোয়ারি ক্রিয়াকলাপ দেখা গিয়েছে, শিক্ষাক্ষেত্রে যত খামখেয়ালিপনা তেমনটা নজিরহীন।
সশরীরে হাসপাতালগুলিতে অতর্কিত হাজিরা দিয়ে স্বাস্থ্যসচেতনতার আলোড়ন সৃষ্টিকারী উদাহরণ তৈরি করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেইসঙ্গে, এমনকী, অস্ত্রোপচাররত চিকিৎসককেও নাকাল করেছিলেন ‘জো হুকুম’ বলে তাঁর সামনে উপস্থিত না হওয়ার জন্য। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে তাঁর পরীক্ষানিরীক্ষা নানাবিধ। সরকারি হাসপাতালগুলি নিখরচায় নিয়ে যাওয়া, ন্যায্যমূল্যে ঔষধ বিক্রয় প্রয়াস, জেনেরিক নামে নিদানপত্র লিখতে বাধ্য করা। তার জন্য দামামা যত বেজেছে, ফল তত ফলেনি। সুলভ শৌচালয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গজিয়ে উঠছে প্রাইভেট হাসপাতাল ও নার্সিংহোম। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার মান আরও নামছে, বেসরকারি নির্ভরতায় নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষ।
পার্ক স্ট্রিট, কামদুনি, সন্ন্যাসিনী ধর্ষণের মতো নারকীয় ঘটনার পীঠস্থান হয়ে ওঠা পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসনিক দুর্বলতাও এক উল্লেখ্য নজির বটে। এবং প্রতিটি জঘন্য কাণ্ড নিয়ে রাজনৈতিক নোংরা খেলার চরম হয়েছে। এগুলো কি সত্যি প্রয়োজন ছিল? যে বিপুল জনসমর্থনে এবং বামবিরোধী মানসিকতার প্রভাবে তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় এসেছিল, তাকে সুবিধাবাদের রাজনীতিতে পরিণত না করে গঠনমূলক কার্যক্রম করা যেতে পারত।
সিঙ্গুরে অনিচ্ছুক কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতা ও মর্যাদা আদায় করেছিলেন। বাস্তবে কৃষিক্ষেত্রে তাঁর সরকারের ঔদাসীন্য ও সহমর্মিতার অভাব বার বার লক্ষ করা গিয়েছে। প্রকাশ্য জনসভায় খোলাখুলি প্রশ্ন করেছিলেন বলে মাওবাদী তকমা দিয়ে কৃষক শিলাদিত্যকে জেলে পোরা হয়েছে। তৃণমূল সরকারে শিল্পনীতি যেমন ঘোলাটে, জমিনীতি ও কৃষিপ্রকল্পও তেমনি অস্বচ্ছ। ঋণগ্রস্ত আলুচাষি বা ধানচাষির আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে একের পর এক। প্রান্তিক খেতমজুরের মৃত্যু ঘটেছে অভাবে বা ঋণের দায়ে। ছোট ছোট আমলাশোল পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় ছড়ানো। তার সংখ্যা ক্রমশ বাড়বে যদি কৃষিনীতি সঠিক না হয়, জমিনীতি বা বাণিজ্যনীতি কৃষকের অনুকূল না হয়। পশ্চিমবঙ্গ কৃষিপ্রধান অথচ উৎপাদিত ফসল ভাল হওয়ার পরেও কৃষকদের আত্মহত্যা করতে হয় কেন? এবং সত্য অস্বীকার করে সেই আত্মহত্যাকে অন্য মোড়ক দেবার প্রয়াসই বা কেন!
রাজ্যের শিল্পানুকূল ভাবমূর্তি তৈরির প্রয়াসে, জমি অধিগ্রহণ কার্যক্রমে, যে পরিমাণ জমি যে নীতিতে দখল করা হচ্ছে, তাতে পশ্চিমবঙ্গের কৃষকশ্রেণির ওপর নেমে এসেছে নিদারুণ আঘাত। ভাল আছে কি সেই রাজ্য?
শিল্পতালুক হিসেবে পশ্চিমবঙ্গকে তুলে ধরার জন্য জোরদার প্রয়াস চলছে এখন। কারণ, শুধু সাইকেল বা অনুদান বিলিয়ে পাঁচ বছর কাটিয়ে দেওয়া গিয়েছে, পুনরাবৃত্তি সম্ভব না-ই হতে পারে। মানুষের চাই কাজ ও উপার্জনের সুযোগ, চাই সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, এই ন্যূনতম চাহিদার মুখোমুখি যে কোনও প্রশাসনকেই হতে হয়। গণতন্ত্রের স্বাধীনতা যতরকম ভাবেই উৎখাত করার চেষ্টা হোক, গণ আন্দোলন কখনও বন্ধ করা যায় না।
গত পাঁচ বছরে সাম্প্রদায়িক তোষণ বিষয়টি আত্যন্তিক প্রকট চেহারা নিয়েছে। বিশেষ ধর্ম বা শ্রেণির প্রতি মনোযোগ এবং সুবিধাপ্রদানের লাগাতার প্রস্তাব সেই বিশেষ গোষ্ঠীকে যেমন বিচ্ছিন্ন করে দেয়, তেমনই পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সহাবস্থানের ভারসাম্যও নষ্ট করে। পশ্চিমবঙ্গে বহু গরমিল ছিল, কিন্তু সম্প্রদায়িকতা নিয়ে, বিগত পাঁচ বছর বাদ দিলে, দেশভাগকালীন জাতিদাঙ্গার পর আর ভাবতে হয়নি। কিন্তু তোষণ যে স্বার্থান্বেষ মনে প্রবেশ করিয়ে দেয়, তার ফলে, কত দিন পশ্চিমবঙ্গ জাতিধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারবে সন্দেহ আছে।
উন্নতি, ভাল-থাকা, আশাপূরণ হল অন্ধের হস্তীদর্শন। কেউ ঘরের কাছের উদ্যানটি পরিষ্কার পেয়েই ধন্য, কেউ একটা সাইকেল পেলে, আবার কেউ নিজের হাতে ফলানো ফসলের পাশে ফলিডল খেয়ে ছটফট করতে করতে মরে ভাল থাকে!
স্বার্থান্বেষী এবং অপরিণামদর্শী রাজনীতি কবলিত পশ্চিমবঙ্গ নিজেও ফলিডল খেয়ে ছটফট করছে। তাকে কে বাঁচাবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy