গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
একা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ই বোলপুর থেকে সাংসদ হয়েছেন সাত বার। তবে শুরুটা উপনির্বাচন দিয়ে। ১৯৭১ থেকে সিপিএমের জয় শুরু হয়েছিল এই আসনে। সোমনাথের আগে টানা চার বার জিতেছিলেন শরদীশ রায়। সেটা ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পরে ১৯৮৪ সালের প্রবল কংগ্রেস হাওয়ার মধ্যেও। সে বার সোমনাথ হেরেছিলেন যাদবপুরে। সেই নির্বাচন রাজ্য রাজনীতিতে এক উল্লেখযোগ্য মাইলফলক হয়ে রয়েছে। কারণ, সেই ভোটেই সোমনাথকে হারিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কংগ্রেস প্রার্থী মমতার কাছে হেরেই শরদীশের মৃত্যুতে লোকসভার উপনির্বাচনে সোমনাথ জেতেন ১৯৮৪ সালেই। এর পরে তিনি আর পিছন ফিরে তাকাননি। ২০০৮ সালে বামেরা প্রথম ইউপিএ সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করলেও স্পিকার পদে থেকে যান সোমনাথ। যার জেরে সিপিএম সোমনাথকে বহিষ্কার করলে ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটে আর প্রার্থী হননি তিনি। তা ছাড়া আসন পুনর্বিন্যাসের কারণে বোলপুর তফসিলি জাতির জন্য সংরক্ষিত হয়ে গিয়েছিল। সিপিএম তাঁকে বহিষ্কার না করলেও ওই আসনে আর প্রার্থী হওয়ার সুযোগ ছিল না সোমনাথের। ২০০৯ সালে ওই সংরক্ষিত আসন থেকে জয় পান সিপিএম নেতা রামচন্দ্র ডোম।
তবে ক্ষয়ের শুরু সে বারেই। ২০০৪ সালে সোমনাথ তিন লাখের বেশি ভোটে জিতলেও ২০০৯ সালে সিপিএমের জয়ের ব্যবধান লাখের নীচে নেমে আসে। পাঁচ বছর পরে ২০১৪ সালে ওই আসন প্রায় আড়াই লাখ ভোটে জিতে নেয় তৃণমূল। সেই সময়ের মধ্যেই বীরভূম জেলায় উঠে এসেছিলেন অনুব্রত মণ্ডল নামে এক নেতা। জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত রাজনীতিতে নবাগত অধ্যাপক প্রার্থী অনুপম হাজরাকে জিতিয়ে দেন। ২০১৯ সালে অবশ্য অনুপম অতীতে সোমনাথের হেরে যাওয়া যাদবপুর আসনে তৃণমূলের কাছে হারেন বিজেপির টিকিটে। মিমি চক্রবর্তীর কাছে পরাজিত অনুপম আপাতত দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের রোষের মুখে পড়ে বিজেপির সব পদ খুইয়েছেন। সেটা হয়েছিল এই লোকসভা নির্বাচনে বোলপুর থেকে পদ্মের টিকিটে লড়াইয়ের বাসনা মিটবে না বুঝে তাঁর বিজেপির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পর।
সিপিএমের থেকে তৃণমূলের হয়ে-যাওয়া এ হেন বোলপুরে বিজেপির উপস্থিতি প্রথম টের পাওয়া যায় ২০০৯ সালের ভোটে। ভোটপ্রাপ্তির হার মাত্র ৬.৪৯ শতাংশ হলেও তৃতীয় দল হিসাবে উত্থান হয় বিজেপির। ২০১৪ সালেও তৃতীয় স্থানে থাকা বিজেপির ভোটের হার দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়ে হয়ে যায় ১৫.১৩ শতাংশ। আর ২০১৯ সালে বিজেপি বোলপুরে ভোট পায় ৪০ শতাংশের বেশি। বিজেপি দ্বিতীয় স্থান নেওয়ায় সিপিএমের ভোট কমে হয় ৬.২৯ শতাংশ। এ বার তাই একদা ‘গড়’ বোলপুরে বামেদের লড়াই কঠিন। রামে যাওয়া ভোট বামে ফেরানো সিপিএমের পক্ষে খুব সহজ নয়।
সিপিএম বোলপুরে প্রার্থী করেছে নানুরের প্রাক্তন বিধায়ক শ্যামলী প্রধানকে। বর্তমানে সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য এবং মহিলা সংগঠনের জেলা সভানেত্রী শ্যামলী পঞ্চায়েত স্তরেও জনপ্রতিনিধি থেকেছেন। তবে একাধিক পরাজয়েরও অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। যেমন বিজেপি প্রার্থী পিয়া সাহা। আগে দু’বার বিধানসভায় সাঁইথিয়া কেন্দ্র থেকে বিজেপির হয়ে লড়ে দু’বারই তৃণমূলের কাছে পরাজিত হয়েছেন। যদিও ২০১৫ সালে বিজেপি বাংলায় প্রায় শক্তিহীন থাকার সময়ে পিয়া সাঁইথিয়া পুরসভায় বিজেপির টিকিটে জিতেছিলেন।
এই দুই মহিলা রাজনীতিকের বিরুদ্ধে লড়াই অভিজ্ঞ রাজনীতিক অসিতকুমার মালের। গত লোকসভা নির্বাচনে যিনি লক্ষাধিক ভোটে জিতেছেন। বীরভূমের রাজনীতিতে পরিচিত মুখ অসিত। হাসন বিধানসভা আসন থেকে অনেক বার বিধায়ক হয়েছেন। তবে ২০১৬ সালে দলবদল করে তৃণমূলের হয়ে ভোটে দাঁড়িয়ে কংগ্রেস নেতা মিল্টন রশিদের কাছে পরাজিত হন। এর পরে কার্যত বীরভূমের রাজনীতি থেকে হারিয়ে গিয়েছিলেন অসিত। কিন্তু অনুপমের সঙ্গে অনুব্রতের সম্পর্কের অবনতির জেরে বোলপুরের সাংসদকে দল থেকে ছেঁটে ফেলে তৃণমূল। অনুব্রতের পরামর্শেই ২০১৯ সালে বোলপুরে অসিতকে প্রার্থী করে ফের লোকসভায় জেতে তারা। এ বারেও তাদের প্রার্থী অসিত। রাজ্যের অনেক আসনে নতুন মুখ দেখা গেলেও বীরভূম জেলার দুই আসনেই ‘পুরনো চালে’ ভরসা রাখলেন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বোলপুরে অসিতের মতোই বীরভূমে শতাব্দী রায়।
তবে ফারাক একটাই— গত বার লোকসভা নির্বাচনে জেলা সভাপতি অনুব্রত উপস্থিত ও সক্রিয় ছিলেন। এ বার তিনি জেলবন্দি। অনেকের মতে, ‘কেষ্টহীন’ বীরভূমে কোনও পরীক্ষানিরীক্ষার পথে হাঁটেননি মমতা। অতীতে যাঁদের জেতার অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাঁদের উপরেই ভরসা রেখেছেন। নতুন মুখ হলে জেতানোর জন্য নেতা লাগে। পুরনোদের ক্ষেত্রে ততটা দরকার হয় না। বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলকে লোকসভার হিসাব কষার সময়ে কতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু এটা ঠিক যে, সাম্প্রতিক নির্বাচনী ফলাফল থেকে জয়ী দল ‘অক্সিজেন’ নিয়ে নিজেদের চাঙ্গা করার চেষ্টা করে। সেই হিসাবে বোলপুরে নীলবাড়ির লড়াইয়ে এগিয়ে রয়েছে তৃণমূল।
অসিত বরাবরই অনুব্রতের ‘ঘনিষ্ঠ’। তাঁর ‘কেষ্টদা’র সঙ্গে দেখা করতেও গিয়েছিলেন তিনি। অনুপমের জায়গায় অসিতকে নিয়ে এসেছিলেন তিনিই। ২০১৯ সালে অসিতই যে প্রার্থী হচ্ছেন, তা দলের ঘোষণার আগেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন অনুব্রত। সে বার নির্বাচন কমিশন ভোটের দিন ঘোষণার আগেই আমোদপুরে তৃণমূলের কর্মিসভায় অসিতকে দেখিয়ে কেষ্ট বলেছিলেন, ‘‘এই লোকটাকে চিনে রাখুন। খুব ভাল মানুষ। প্রয়োজনে আপনাদের কাজে লাগবে।’’
হাসন বিধানসভার দীর্ঘ দিনের কংগ্রেস বিধায়ক অসিত ১৯৭৭ সালে প্রথম ভোটের ময়দানে নামেন। হাসনে পরাজিত হন। ১৯৮২ সালে প্রথম জয়। কংগ্রেসের প্রতীকে ২০১১ সাল পর্যন্ত সাত বার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পাঁচ বার বিধায়ক। ২০১৪ সালের ২১ জুলাই কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেন তিনি। ২০১৬ সালে হাসন বিধানসভা কেন্দ্রে কংগ্রেসের মিল্টন রশিদের কাছে পরাজিত হন। কিন্তু তিন বছর পরেই দিল্লি যান। মাথায় ছিল ‘কেষ্টদা’র হাত।
বোলপুর লোকসভা আসনেও অসিত যে একেবারে নতুন মুখ ছিলেন, তা নয়। ২০০৯ সালে লোকসভা ভোটে ওই কেন্দ্রেই কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের প্রার্থী হন তিনি। তবে সিপিএম প্রার্থী রামচন্দ্রের কাছে লক্ষাধিক ভোটে পরাজিত হন। ঠিক ১০ বছর পরে লক্ষাধিক ভোটে জয় পান। রামচন্দ্র জামানত খুইয়েছিলেন।
তবে এ বার সিপিএমের রামচন্দ্র না হলেও অন্য এক ‘রামচন্দ্র’ রয়েছেন তাঁর প্রতিপক্ষ। রাজ্যের যে সব এলাকায় বিজেপির জনপ্রতিনিধি না থাকা সত্ত্বেও অযোধ্যায় মন্দির উদ্বোধন পর্বের উৎসব জমকালো ভাবে পালিত হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম বোলপুর। সদ্য রামনবমী পালনও হয়েছে ধুমধাম করে। অনুব্রতের অভাব তো বোঝা যাবেই। সেই সঙ্গে অযোধ্যাবাসী রামচন্দ্র ভোটের ফলে কতটা প্রভাব ফেলবেন, তারও পরীক্ষা হবে দিল্লিবাড়ির লড়াইয়ে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy