প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
নাউল বাজারে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন হাসিবুল মোল্লা। সঙ্গে আরও কয়েক জন। সকলেই মাঝবয়সি। ভোটের হালচাল নিয়ে প্রশ্ন করতেই বলেন, “এখানে তৃণমূলই জিতবে।”
আমতার তাজপুর এলাকার মনিহারি দোকানের মালিক এক গৃহবধূর কথায়, “এখানে বিজেপি কোথায়! লড়াই তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেস-সিপিএমের।” একটু থেমে বললেন, “পাল্লা ভারী জোড়াফুলেরই।”
গরুহাটা মোড়ের টোটোচালকের কথায়, “প্রচার করছে সবাই। কিন্তু জোর তো তৃণমূলেরই।”
উলুবেড়িয়া লোকসভা আসনে জোর যে বঙ্গের শাসক দলেরই, তার প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে গোটা কেন্দ্র জুড়েই। দেওয়াল লিখন-পতাকা-ফেস্টুন-পোস্টারে সর্বত্রই সদর্প উপস্থিতি শাসকের। সর্বত্রই তারা টেক্কা দিচ্ছে বিরোধীদের।
এই লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র শ্যামপুর, বাগনান, উলুবেড়িয়া-দক্ষিণ, উলুবেড়িয়া-উত্তর, উলুবেড়িয়া-পূর্ব, আমতা, উদয়নারায়ণপুর। সব ক’টিই তৃণমূলের দখলে। ৯০টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ৮৮টিই জোড়াফুলের। দু’টি দখল করেছিল সিপিএম-কংগ্রেস-আইএসএফ জোট। ন’টি পঞ্চায়েত সমিতিই বিরোধীহীন অবস্থায় তৃণমূলের দখলে। অতএব গোটা উলুবেড়িয়া কেন্দ্রে তৃণমূলের নিরঙ্কুশ আধিপত্য।
এ হেন পরিস্থিতিতে জাতীয় বা রাজ্যের রাজনৈতিক বিষয়গুলিকে সরিয়ে রেখে স্থানীয় উন্নয়নকেই ভোটদাতাদের সামনে তুলে ধরছেন জোড়াফুলের নেতারা। রাস্তা, নিরবচ্ছিন্ন পানীয় জলের ব্যবস্থাকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন তাঁরা। এ ছাড়া ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’-সহ সামাজিক প্রকল্পগুলি তো আছেই। তা সত্ত্বেও ভোটদাতাদের প্রশ্নের মুখে যে পড়তে হচ্ছে, তা পরোক্ষে মানছেন তৃণমূলের বিধায়ক থেকে স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। মূলত, গ্রামে ছোট রাস্তাগুলি পাকা করা, নিকাশি ব্যবস্থাকে আরও মজবুত করা, একশো দিনের কাজ, আবাস যোজনার বাড়ির দাবি তুলছেন গ্রামবাসীর একটা বড় অংশ। যা কিনা সামান্য হলেও অস্বস্তিতে রাখছে বাংলার শাসক শিবিরকে।
এত উন্নয়নের দাবি এবং হাতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা সত্ত্বেও নজর কাড়ছে সাত তৃণমূল বিধায়কের তৎপরতা। তাঁরা এবং স্থানীয় নেতারা উদয়াস্ত পরিশ্রম করছেন। প্রশ্ন উঠছে, যে লোকসভা আসনে কার্যত ফাঁকা মাঠ, সেখানে তৃণমূলের বিধায়কেরা এত পরিশ্রম করছেন কেন? জেলা তৃণমূলের অন্দরে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, কারণ দু’টি। এক, গোষ্ঠীকোন্দল ও দুর্নীতির বিরূপ প্রভাব আটকানো এবং দ্বিতীয়টি হল, ২০২৬-এর জন্য গা-ঘামিয়ে নেওয়া। বিভিন্ন এলাকায় তৃণমূলের চাপা গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ভোটে প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে শাসক শিবিরে। এ ছাড়া স্থানীয় এলাকায় কিছু নেতার দুর্নীতিও গ্রামে ভোটের অঙ্ককে পাল্টে দিতে পারে। এই কৃষি প্রধান কেন্দ্রটিতে সেই সুযোগ কাজে লাগাতে চাইছে বিজেপি এবং সিপিএম-কংগ্রেস।
বিরোধীরা অবশ্য শাসকের উন্নয়নের দাবিকে গুরুত্বই দিচ্ছে না। তাদের অভিযোগ, এলাকার উন্নয়ন নয়, তৃণমূল নেতাদের ‘ব্যক্তি সম্পদের’ উন্নয়ন হয়েছে। বিজেপি প্রার্থী করেছে অরুণ উদয় পালচৌধুরীকে। দলের কর্মীদের নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরছেন তিনি। তৃণমূলের উন্নয়নের দাবি শুনে তাঁর প্রতিক্রিয়া, “কোথায় উন্নয়ন! গরিবের বাড়ি নেই। আবাস যোজনায় দুর্নীতি করেছে। বহু এলাকায় রাস্তা হয়নি। আমতা, উদয়নারায়ণপুরে এখনও বহু এলাকায় মানুষকে পুকুরের জল খেতে হয়।” তাঁর অভিযোগ, সাংসদ তো এলাকাতেই আসেন না। তিনি আর উন্নয়নের ব্যাপারে কী জানবেন! যা শুনে বিদায়ী সাংসদ তথা তৃণমূল প্রার্থী সাজদা আহমেদ বলেছেন, “পুরোটাই অপপ্রচার। নিয়ম করে শনি ও রবিবার উলুবেড়িয়ায় যাই। কেন্দ্রের মানুষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ আছে। তাঁরা আমাকে ভাল ভাবেই গ্রহণ করেছেন। এ বারের ভোটের ফলেও সেটাই প্রমাণ হবে। জয়ের ব্যাপারে ১০০ শতাংশ নিশ্চিত।”
তৃণমূল প্রার্থীর দাবি, ‘দিদি’র উন্নয়ন এবং সুলতান সাহেবের (প্রাক্তন সাংসদ সুলতান আহমেদ) অসমাপ্ত কাজকে সমাপ্ত করাই তাঁর ভোটযুদ্ধের অস্ত্র। সেই অস্ত্রকে ভোঁতা করতে চেষ্টার ত্রুটি রাখছে না সিপিএম এবং কংগ্রেস। সিপিএম প্রচারে বলছে, এলাকার নদী ভাঙন রুখতে সাংসদ তথা রাজ্য সরকারের কোনও হেলদোল নেই। এলাকায় বিরাট সংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিক রয়েছেন, করোনাকালে তাঁদের দুর্গতি চরমে পৌঁছেছিল। কিন্তু সাংসদ তাঁদের পাশে দাঁড়াননি। এলাকায় বন্ধ কলকারখানা খোলার ব্যাপারেও তৃণমূল কখনও উদ্যোগী হয়নি। প্রায় তিন দশক এই কেন্দ্রে সাংসদ ছিলেন হান্নান মোল্লা। জোটের তাগিদে সেই আসন সিপিএম ছেড়েছে কংগ্রেসকে। এই কেন্দ্রের কংগ্রেসের সংগঠন বলে তেমন কিছু নেই। সিপিএম-ই কাঁধে করে নিয়ে ঘুরছে যুব কংগ্রেসের প্রদেশ সভাপতি তথা প্রার্থী আজ়হার মল্লিককে। অনুন্নয়নের সঙ্গেই তিনি জোর দিচ্ছেন তৃণমূলের সন্ত্রাসের অভিযোগে। তাঁর বক্তব্য, তরুণ প্রজন্মের কর্মসংস্থান, আনিস খানের মৃত্যুর বিচার— এই সব দাবিকে সামনে রেখেই তাঁর লড়াই। কংগ্রেস প্রার্থীর দাবি, “ভোটের দিন বাগনান, আমতা, উদয়নারায়ণপুরে তৃণমূল যদি সন্ত্রাস না করে, তা হলে ফল অন্য রকম হবে।”
উলুবেড়িয়া কেন্দ্রে ৩০ শতাংশের মতো সংখ্যালঘু ভোট রয়েছে। বছর তিনেক আগে বিধানসভা নির্বাচনে সংখ্যালঘুরা দু’হাত উপুড় করে ভোট দিয়েছিলেন তৃণমূলকে। এ বার তেমন পরিস্থিতি নেই। গোটা কেন্দ্র জুড়েই হিন্দুত্বের চোরাস্রোত রয়েছে। নীরবে সেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে আরএসএস এবং তাদের মদতপুষ্ট কিছু হিন্দু সংগঠন। তফসিলি জাতি এলাকায় বিজেপির প্রভাব আছে। সিপিএমের তৎপরতাও চিন্তায় রেখেছে তৃণমূলকে। সংখ্যালঘু ভোটে আজ়হার কতটা ভাগ বসাতে পারবেন, তার উপরও অনেকটা নির্ভর করছে ভোটের ফলাফল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy