প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
দড়ি আর কলসি।
বছরের পর বছর ভরসা গ্রামের মানুষের। দিগন্ত বিস্তৃত খেত বৈশাখের তাপে শুকিয়ে বিবর্ণ। রাস্তার পাশে, মাঠের মাঝে তৈরি গভীর নলকূপে চাপ দিলে ফ্যাঁসফ্যাঁসে আওয়াজ ছাড়া কিছু বেরোয় না। খালের জল, প্রায় মজে যাওয়া পুকুরের জল কোনও ভাবে জোগাড় করে পিপাসা মেটানো কিংবা চাষের কাজ করা গেলেও স্নান কিংবা প্রকৃতির ডাকে প্রকৃতিই ভরসা বেশিরভাগ মানুষের। দিতে হয়, তাই যেন ভোট দেওয়া।
গা পোড়ানো দুপুরের রোদের মধ্যে বাঁকুড়ার শালতোড়া বাঁধ থেকে কালো জল জোরহিরার পাথুরে জমির উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। প্লাস্টিকের কলসির গলায় দড়ি বেঁধে সেই জল তুলছিলেন বাবলু মান্ডি। তার পরে রোজ ওই কলসি সাইকেলে বেঁধে দীর্ঘ পথ উজিয়ে নিয়ে যেতে হয় চাষের জমিতে। লোকসভা ভোটের প্রসঙ্গ তুলতেই বাঁকা হাসি দিয়ে বাবলু বলেন, “সারা বছর এ ভাবেই চলে। কখনও জলে নেমে, কখনও দড়িতে কলসি বেঁধে জল তুলতে হয়। গ্রামে জলের খুব কষ্ট।”
তা হলে এত দিন ধরে হলটা কী?
বিহারীনাথ মন্দিরের পথে, রাস্তার ধারে জড়ো করে রাখা জলের পাইপ। সে দিকেই নজর ঘুরিয়ে জোরহিরার খালে সাবান মেখে স্নান করা পড়ুয়া অভিজিৎ মান্ডি বলে, “জল আসবে। কবে, জানি না।” অবশ্য বিহারীনাথ মন্দিরের অদূরে নির্মীয়মাণ জলাধার দেখিয়ে মন্দিরের পুরোহিতেরা জানান, সেটি তৈরি হয়েছে শাসক দল তৃণমূলের উদ্যোগে।
গন্ধেশ্বরী ও দ্বারকেশ্বর— দুই নদী পাশ দিয়ে বয়ে গেলেও বাঁকুড়ার জলকষ্টের উল্লেখযোগ্য সমাধান করতে পারেনি কোনও দলই। শালতোড়া, ছাতনা, কমলপুরের মতো এলাকা দিয়ে যেতে যেতে, যত দূর চোখ যায় দিগন্ত ছুঁয়ে গিয়েছে শুকনো মাঠ। গাড়ির চালক জানান, বেশি বৃষ্টি হলে তখনই মানুষ নিজেদের খেতে চাষাবাদ করতে পারেন। নয়তো গ্রামের মানুষ বর্ধমান, আরামবাগের মতো জায়গায় দিনমজুরির কাজে চলে যান। শ্যালো পাম্প বসিয়ে জল টানারও উপায় নেই অধিকাংশ জায়গায়। ভোটের সময়ে রাজনৈতিক দলের নেতারা দোষারোপ, পাল্টা দোষারোপ করে কাটিয়ে দেন।
ঠিক যে ভাবে এ বার বাঁকুড়ার তৃণমূলের প্রার্থী অরূপ চক্রবর্তীর অভিযোগ তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপি সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী সুভাষ সরকারের বিরুদ্ধে। গন্ধেশ্বরী নদীর পাড়ে তাঁর মনোনয়ন জমা দেওয়া উপলক্ষে বিরাট সংখ্যায় জড়ো হওয়া কর্মী-সমর্থকেদের জন্য মুড়ি-ঘুঘনি-বোঁদের ভোজের আসর বসিয়েছিলেন অরূপ। মুড়িতে জল ঢালতে ঢালতে বললেন, “সুভাষ সরকার এখানে পিসি সরকার হয়ে গিয়েছেন। বাঁকুড়ার জলকষ্ট লাঘবের জন্য দোনামোনার ঘাটের ফাইল আজও দিল্লিতে পড়ে। উনি ফাইল তুলতেই পারেননি লোকসভায়।” তার পরে তাঁর দাবি, “আমি জিতলে দিল্লি গিয়ে আগে ওই ফাইল বার করব।”
যদিও কেন্দ্রের খবর, রাজ্য সরকারের জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর জানিয়েছে, জলস্তরের স্থানান্তর ঘটায় বিভিন্ন এলাকায় বসানো কল কিংবা নলকূপে জল আসতে সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু ভোটের মাঠে সমস্যার উৎস না খুঁজে একে অন্যের গায়ে দায় চাপাতেই ব্যস্ত নেতারা। বিজেপি প্রার্থী সুভাষ সরকারের কথায়, “রাজ্য সরকারের সদর্থক মনোভাব না থাকার জন্যই দোনামোনার ঘাটের জলপ্রকল্প বাস্তবায়িত করা যায়নি। অরূপবাবু বলেছিলেন, সেচ ও জলপথ দফতরের সঙ্গে আলোচনা করবেন। আমি দিল্লি থেকে ফাইল এনে ওঁর সচিবের সঙ্গে দেখা করি। ওঁরা জানান জমি অধিগ্রহণের সমস্যার কারণে আমাদের এই প্রকল্প বাস্তবায়িত করা যাবে না।”
টক্কর আছে অন্য বিষয়েও। অরূপ যেমন জানান, রেলের জায়গা থাকা সত্ত্বেও ভেলোরের মতো একটা চিকিৎসার জায়গা বাঁকুড়ায় তৈরি করতে পারেনি সুভাষ। বরং প্রাক্তন জেলা পরিষদের সভাধিপতি তথা তালড্যাংরার বিধায়ক অরূপের দাবি, তিনি বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালয়, রাস্তা, বাঁধ, রাজ্য সড়কের কাজ করিয়েছেন। পাল্টা সুভাষের দাবি, বাঁকুড়াবাসীর সাতচল্লিশ বছরের চাহিদা মেটাতে কেশরা-কাটজুড়িডাঙা হল্ট স্টেশন তৈরি করেছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় স্বাস্থ্য-সুরক্ষা যোজনায় দেড়শো কোটি টাকার প্রকল্পের অধীনে বাঁকুড়ায় মেডিক্যাল কলেজ তৈরি হলেও রাজ্য সরকার সেখানে চিকিৎসক-নার্স কিছুই নিয়োগ করেনি বলে পাল্টা অভিযোগ সুভাষের।
সুভাষ-অরূপ কথার লড়াইয়ের মধ্যে তৃণমূলের তরফে বলা হচ্ছে, আসনটি উদ্ধারের জন্যই এ বারে বাঁকুড়ার ভূমিপুত্র অরূপকে সেখানে দাঁড় করিয়েছে তাঁর দল। ২০১৯ সালে কলকাতা থেকে বাঁকুড়ায় এসে হেরে গিয়েছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তার পরে ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে লড়তে গিয়ে বাঁকুড়ায় থেকে হেরে ফেরেন সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তাই এ বার ভূমিপুত্র সুভাষের বিরুদ্ধে জমিদার কুলের অরূপকে প্রার্থী করেছে তৃণমূল। সঙ্গে জোর প্রচার লক্ষ্মীর ভান্ডার নিয়েও। তবে তিন বছর আগেও লোকসভা আসনটির অন্তর্গত রঘুনাথপুর, শালতোড়া, ছাতনা, বাঁকুড়া বিধানসভা কেন্দ্রে জিতেছিল বিজেপি। তৃণমূল শুধু রানিবাঁধ, রায়পুর ও তালড্যাংরায়। ফলে চাপটা রয়েই গিয়েছে ঘাসফুলের।
অন্য দিকে, সুভাষের চিন্তা বাড়িয়েছেন বাঁকুড়ার পুরনো বিজেপি নেতা জীবন চক্রবর্তী। ছাতনার বাসিন্দা জীবন ইট চিহ্ন নিয়ে নির্দল হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এবং সর্বত্র বলছেন, সুভাষকে যেন ভোট দেওয়া না হয়। জীবন বলেন, “সুভাষবাবু তো বিজেপির লোকজনকে বসিয়েই দিয়েছেন। ওঁর প্রস্তাবক ওরই নার্সিংহোমের কর্মী। বাঁকুড়ায় বিজেপি যাতে সুভাষবাবুর হাতে শেষ না হয়ে যায়, তাই বিজেপির লোকজনই আমাকে ভোটে দাঁড় করিয়েছেন।”
আর সুভাষ? তিনি প্রচারে কখনও জুতোয় পালিশ লাগাচ্ছেন, কখনও ছেলেছোকরাদের সঙ্গে পুকুরে সাঁতার কাটছেন। অরূপ আবার দলের প্রয়াত নেতার বাড়ির রামমন্দিরে পুজো দিয়েছেন। তাঁর কথায়, “জঙ্গলমহলের মানুষ আমাকে ঠাকুর বলে ডাকেন।” পাল্টা সুভাষ বলেন, “গত পাঁচ বছরে অবসরের সময়টুকুও উন্নয়নের কাজে লাগিয়েছি।”
এমন পরিস্থিতিতে জলের সমস্যাকেই অন্যতম হাতিয়ার করছেন সিপিএম প্রার্থী নীলাঞ্জন দাশগুপ্ত। তাঁর কথায়, “বাঁকুড়া শহর ছাড়া সর্বত্র জলের কষ্ট। একটি গ্রামে প্রচারে গিয়ে দেখি কুয়ো শুকিয়ে গিয়েছে। চাষাবাদ ছেড়ে পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন গ্রামের মানুষ। লক্ষ্মীর ভান্ডার দেখিয়ে ঘুরপথে মানুষের টাকা শাসক দলের নেতারা নিয়ে চলে যাচ্ছেন। মানুষকে তাই জাগানোর চেষ্টা করছি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy