—প্রতীকী ছবি।
প্রথমে মোবাইল, জুতো, পেন, নোটবুক থেকে সব কিছু মন্দিরের লকারে জমা করার পর্ব। তার পরে তিন দফায় শরীরী তল্লাশি। ভিড় সামলাতে প্রবেশপথে সারি সারি স্টিলের রেলিং। রামমন্দির প্রাঙ্গণে ঢুকলে প্রথমেই চোখে পড়বে অতিকায় দু’টি ক্রেন। রামমন্দিরের দোতলা ও তিনতলা তৈরির কাজ চলছে। একতলায় অনেক পাথরের স্তম্ভে এখনও মূর্তি ও অন্যান্য কারুকার্য খোদাইয়ের কাজ বাকি। মন্দির চত্বরেও অনেক জায়গায় পাথর বসেনি। এবড়ো খেবড়ো জমি ত্রিপল দিয়ে ঢেকে কাজ চালানো হচ্ছে। বেশ বোঝা যায়, অনেক কাজ বাকি থাকতেই লোকসভা নির্বাচনের আগে তড়িঘড়ি রামমন্দিরের উদ্বোধন করে দেওয়া হয়েছে।
তাতে কী? রামমন্দিরের সিঁড়ি পেরিয়ে রামলালার কৃষ্ণশিলার মূর্তি তৈরি চোখে পড়তেই মন্দির কাঁপিয়ে ভক্তরা গর্জে ওঠেন, ‘জয় শ্রী রাম!’ কলকাতা থেকে কর্নাটক, গুজরাত থেকে কেরল, মধ্যপ্রদেশ থেকে মহারাষ্ট্রের পুণ্যার্থীরা রামধুনের সুরে গলা মেলান। পুজোর সামগ্রী নিয়ে মন্দিরে ঢোকা বারণ। তাই শুধুই রামলালার দর্শন। আর খবরের শিরোনামে থাকা অযোধ্যার রামমন্দির চাক্ষুষ করা। বেরনোর সময় ছোট্ট প্যাকেটে রামমন্দিরের নকুলদানা প্রসাদ পেয়ে ‘শ্রী রাম, জয় রাম, জয় জয় রাম’ গাইতে গাইতে বাড়ি ফেরে ভক্তের মিছিল।
গত ২২ জানুয়ারি নরেন্দ্র মোদী নিজে ‘যজমান’ হিসেবে রামমন্দিরের উদ্বোধন করে রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন। গত পাঁচ মাসে দেড় কোটি মানুষ এসেছেন অযোধ্যায়। রামমন্দিরের সুবাদে নরেন্দ্র মোদীর ভাগ্যে ‘চারশো পার’ রয়েছে কি না, সে প্রশ্নের উত্তর ৪ জুন মিলবে। রামমন্দির অযোধ্যার ভাগ্য ফিরিয়ে দিয়েছে। বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমি বিবাদে মুষড়ে থাকা অযোধ্যার শরীরে যেন আচমকাই প্রাণ এসেছে।
হনুমানগঢ়ী মন্দিরের সিঁড়িতে সারা দিনই দমবন্ধ করা ভিড়। যে হোটেলের দৈনিক ঘর ভাড়া ছিল বারোশো টাকা, তা এখন বেড়ে চার হাজার। হনুমানগড়ীর সামনে হোক বা লতা মঙ্গেশকর চক, অটো, টোটো, গাড়ির ভিড়ে পা রাখা দায়। সরযূর ঘাটে রামধুনের সুরে গুজরাতি থেকে রাজস্থানিদের পুণ্যস্নান। রেস্তরাঁ থেকে মনোহারি জিনিসপত্রের দোকানে সারাদিন কেনাবেচা। অত্যাধুনিক অযোধ্যাধাম জংশন স্টেশন তীর্থযাত্রীতে জমজমাট। মহর্ষি বাল্মীকি বিমানবন্দরের সঙ্গে অযোধ্যা জুড়ে ৩২ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন যজ্ঞ। রোজগারের বন্ধ দরজা যেন ‘চিচিং ফাঁক’—এর মন্ত্রে খুলে গিয়েছে। এত দিন তো অযোধ্যা এর অপেক্ষাতেই ছিল!
“ভোটে এ সবের কোনও প্রভাব পড়বে না বলতে চান? অযোধ্যার মানুষ মোদীজি ও বিজেপিকে দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করবে না?” প্রশ্ন করছেন হংসরাজ মৌর্য। হনুমানগঢ়ীর সামনে গত বিশ বছর ধরে মনোহারি জিনিসপত্র বেচতেন। এখন তাঁর দোকানে ‘জয় শ্রী রাম’ লেখা অঙ্গবস্ত্র ‘হট কচোরিস’-এর মতো বিক্রি হচ্ছে। হংসরাজ ভবিষ্যৎবাণী করছেন, “উত্তরপ্রদেশ বা গোটা দেশে কী হবে জানি না। অযোধ্যায় বিজেপি রেকর্ড ভোটে জিতবে।”
অযোধ্যা নয়। ফৈজ়াবাদ। যোগী আদিত্যনাথ সরকার ফৈজ়াবাদ জেলার নাম বদলে অযোধ্যা করেছে। রেল স্টেশনের নামও ফৈজ়াবাদ থেকে বদলে অযোধ্যাধাম হয়েছে। লোকসভা কেন্দ্রের নাম এখনও ফৈজ়াবাদ। হয়তো ভবিষ্যতে লোকসভা কেন্দ্রের নামও বদলাবে। নাম বদলের আগে ফৈজ়াবাদে ২০ মে ভোটগ্রহণ। বিজেপির কাজে ফৈজ়াবাদ জয় অবশ্যই জরুরি। শুধু জয় নয়। বিরাট ব্যবধানে জয়। না হলে ‘গোটা বিশ্বে নরেন্দ্র মোদীর সম্মান থাকবে না’, মানছেন বিজেপি নেতৃত্ব।
এখানেই চিত্তির! বিজেপি নেতারা বুঝে গিয়েছেন, চব্বিশের লোকসভা ভোট শুধু রামমন্দিরের আবেগে জেতা মুশকিল। কারণ, ২২ জানুয়ারি প্রাণপ্রতিষ্ঠার পরে অনেক সময় কেটে গিয়েছে। একই ভাবে শুধু রামমন্দিরের ভরসায় ফৈজ়াবাদেও বিরাট ব্যবধানে জয় আসা মুশকিল বলে অযোধ্যায় বিজেপির দফতরের নেতারা মনে করছেন। রামধুনের সঙ্গে জাতপাতের অঙ্কই ভরসা বিজেপির।
বিজেপি এ বারও ফৈজ়াবাদ থেকে গত দশ বছরের সাংসদ লাল্লু সিংহকে প্রার্থী করেছে। ২০১৪-য় লাল্লু ২ লক্ষ ৮০ হাজারের বেশি ভোটে জিতেছিলেন। ২০১৯-এ ব্যবধান কমে এসেছিল ৬৫ হাজারে। সে বার এসপি-বিএসপি-র জোটের প্রার্থী ছিলেন আনন্দসেন যাদব। কংগ্রেসও ৫০ হাজারের বেশি ভোট কেটেছিল। এ বার কংগ্রেসের সমর্থনে সমাজবাদী পার্টি দলিত নেতা অবধেশ প্রসাদকে প্রার্থী করেছে। অবধেশ পাসি সম্প্রদায়ের নেতা। অযোধ্যায় পাসিদের জনসংখ্যা যথেষ্ট। সমাজবাদী পার্টির ন’বারের বিধায়ক, রাজ্যের ছ’বারের মন্ত্রী অবধেশ বলছেন, “আমি অযোধ্যার ভূমিপুত্র। প্রভু রামের আশীর্বাদ আমার সঙ্গে। বিজেপি রামমন্দিরের আবেগ দিয়ে ছিটেফোঁটাও রাজনৈতিক সুবিধা পাবে না।”
ফৈজ়াবাদের প্রায় ১৯ লক্ষ ভোটারের ৮৪ শতাংশ হিন্দু। মুসলিম ১৬ শতাংশ। অবধেশ মনে করছেন, পাসি তথা দলিতদের সঙ্গে মুসলিম ভোটও তাঁর ঝুলিতে আসবে। কিন্তু অবধেশকে প্রার্থী করায় তাঁর দলের আনন্দসেন যাদব ও তাঁর পরিবার খুশি নয়। অখুশি যাদব সম্প্রদায়ও। আনন্দসেনের বাবা মিত্রসেন যাদব অতীতে ফৈজাবাদ থেকে এসপি, বিএসপি এমনকি, সিপিআইয়ের সাংসদ হয়েছেন। আনন্দসেনকে এসপি প্রার্থী না করায় তাঁর ভাই, অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস অরবিন্দসেন যাদব সিপিআইয়ের প্রার্থী হয়েছেন।
বিজেপির লাল্লু সিংহের অঙ্ক, ‘সমাজবাদী পার্টির চিরাচরিত যাদব ভোটব্যাঙ্ক কিছুটা বিজেপি, কিছুটা সিপিআইয়ের ঝুলিতে গিয়ে পড়বে।’ তাতে তাঁর জয়ের ব্যবধান বাড়বে। কিন্তু লাল্লুর চিন্তা বাড়িয়ে মায়াবতীর বিএসপি ব্রাহ্মণ নেতা সচ্চিদানন্দ পাণ্ডেকে প্রার্থী করেছে। তিনি আবার বিজেপির ভোটে ভাগ বসাবেন না তো? নরেন্দ্র মোদী নিজে ৫ মে অযোধ্যায় গিয়ে ‘রোড-শো’ করেছিলেন। সুগ্রিবের কেল্লা থেকে লতা মঙ্গেশকর চক। ২২ জানুয়ারির প্রাণপ্রতিষ্ঠার পরে সে বারই তাঁর প্রথম অযোধ্যায় আসা। রামলালার সামনে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করেছিলেন। উত্তরপ্রদেশের কংগ্রেস মুখপাত্র অংশু অবস্থী বলছেন, “আসলে গোটা দেশে রামমন্দিরের আবেগ উস্কে দিতে মোদীজি সাত-তাড়াতাড়ি অযোধ্যায় রোড-শো করতে চলে গিয়েছিলেন। ফৈজ়াবাদে যে ২০ মে ভোট, তা ভুলে গিয়েছিলেন।”
গোটা দেশে না হোক। বিজেপির আশা, রামমন্দিরের আবেগ সরযূর ঘাটে আছড়ে পড়বেই। ‘চারশো পার’ না হোক, ফৈজ়াবাদে বড় ব্যবধানে জয় আসবেই। না হলে বিশ্বে নরেন্দ্র মোদীর সম্মান থাকবে না যে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy