Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

মুহূর্তের অভিঘাত

অমিত শাহের সভায় নামা মানুষের ঢলকে শুধু একটি রাজনৈতিক দলের চূড়ান্ত অপশাসনের বিরুদ্ধে অপর দলের প্রতি সমর্থনজ্ঞাপনের বিজ্ঞপ্তি ভাবিলে মুহূর্তটির খণ্ড বিশ্লেষণ হইবে মাত্র। ইহা এক গড্ডলিকাপ্রবাহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, রাজনীতির ক্রমবেগবান অতলগতির সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অপর, প্রতিস্পর্ধী সংস্কৃতির উত্থানের মুহূর্ত।

শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০১
Share: Save:

অমিত শাহের সভায় নামা মানুষের ঢলকে শুধু একটি রাজনৈতিক দলের চূড়ান্ত অপশাসনের বিরুদ্ধে অপর দলের প্রতি সমর্থনজ্ঞাপনের বিজ্ঞপ্তি ভাবিলে মুহূর্তটির খণ্ড বিশ্লেষণ হইবে মাত্র। ইহা এক গড্ডলিকাপ্রবাহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, রাজনীতির ক্রমবেগবান অতলগতির সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অপর, প্রতিস্পর্ধী সংস্কৃতির উত্থানের মুহূর্ত। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসকদের রাজনীতি এখন লুম্পেনচালিত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁহার রাজনৈতিক দিশাহীনতার মাধ্যমে অতি স্বল্প সময়ে এই বোধহীন রাজনীতির একের পর এক স্তর অতিক্রম করিতেছেন বটে, কিন্তু তাঁহাকেই এই রাজনীতির ভগীরথ বলিলে অতিকথন হইবে। তিনি উত্তরাধিকারীমাত্র। উত্তরাধিকারটি বিপুল। দীর্ঘও বটে। ব্রাহ্ম সমাজের সামাজিক গুরুত্ব হ্রাস হইবার পরই বাংলায় শিক্ষিত, অভিজাতদের চ্যুত করিয়া মেঠো সংস্কৃতির অভ্যুত্থান ঘটে। ধারা অব্যাহত। সুভাষচন্দ্র বসুর হলওয়েল মনুমেন্ট ভাঙিয়া ফেলিবার ডাকই হউক বা বামপন্থীদের রাস্তায় নামিয়া ট্রাম পোড়ানো, বাংলার রাজনীতি ক্রমে এলিট হইতে সাধারণ্যের করায়ত্ত হইয়াছে। পূর্বে তবু একটি বৃহৎ, এবং তর্কসাপেক্ষে মহৎ, উদ্দেশ্যের বালাই ছিল, যাহার জন্য নাকি রাজনৈতিক বোধ এবং বিচক্ষণতাহীন আমজনতার বিপুল যোগদান আবশ্যিক। এখন আর কোনও উদ্দেশ্য নাই। রাজনীতিকে মাঠে নামাইয়া, তাহার যাবতীয় গৌরব কাড়িয়া বারোয়ারি মোচ্ছবে পরিণত করাই এখন যুগধর্ম।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই মোচ্ছবটিকেই ধ্রুব জ্ঞান করিয়াছেন। তাঁহার রাজনীতির মূলেও জনমোহন, শীর্ষেও তাহাই। তাঁহার উন্নয়নে রুচি নাই, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আগ্রহ নাই, এমনকী শালীনতা বজায় রাখিবার তাগিদটুকুও নাই। রাজনীতির পাঠে অদীক্ষিত জনতা তাঁহাকে টানে, তিনি সেই জনতাকে টানেন। রাজনীতিকে রাস্তায় নামাইবার বঙ্গীয় কার্যক্রমটি তাঁহার হাতে পরিণতি লাভ করিয়াছে। কিন্তু, ইহাই রাজনীতির একমাত্র স্রোত নহে। তাঁহার রাজনীতি নৈতিকতাবিবর্জিত হইলে বিপরীতে নৈতিকতার প্রতি দায়বদ্ধতার রাজনীতি আছে। তিনি উন্নয়নের বিপরীতবাহিনী হইলে উন্নয়নকামী রাজনীতিও আছে। তাঁহার রাজনীতি রাস্তার হইলে শিক্ষিত, শালীন, রুচিমান রাজনীতির চাহিদাও বর্তমান। যে ধারণাগুলি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতির বিপ্রতীপ, এই বার তাহা প্রত্যাঘাত করিয়াছে। ধর্মতলার মোড়ে ভারতীয় জনতা পার্টির সভায় যে ভিড় জমিয়াছিল, তাহা সেই প্রত্যাঘাতের ভিড়, চলতি রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করিবার ভিড়। মমতা দেওয়াললিখন পড়িতে অসমর্থ, ইতিহাসের পাঠও তাঁহার করায়ত্ত নহে। অতএব, এই ভিড়ের মূল অভিঘাতটি আত্মস্থ করিতে তাঁহার সময় লাগিবে বলিয়াই আশঙ্কা।

প্রশ্ন উঠিবে, সেই প্রত্যাঘাতের জন্য বিজেপিই কেন যোগ্য বিবেচিত হইবে? ইতিহাসের কাঠামোগত চলন আর মুহূর্তগত ঘটনের দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্কের পাঠ ভিন্ন এই উত্তর সম্ভব হইবে না। বঙ্গীয় রাজনীতির কাঠামো যে পথ রচনা করিতেছিল, তাহার কোনও একটি পর্যায়ে এই প্রত্যাঘাত অবশ্যম্ভাবী ছিল। কিন্তু, সেই মুহূর্ত কোনটি হইবে, তাহার উত্তর সেই কাঠামোয় ছিল না। থাকা সম্ভবও নহে। তাহা মৌহূর্তিক ঘটনের অপেক্ষায় থাকে। পশ্চিমবঙ্গে যে মুহূর্তে তৃণমূল কংগ্রেস রাস্তার রাজনীতির অতলতম বিন্দুটি স্পর্শ করিতেছে, ঠিক সেই সময়েই যে দিল্লিতে নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী একটি প্রতিস্পর্ধী রাজনীতির ভাষ্যকে সম্ভব করিয়া তুলিবেন, উন্নয়নের নূতনতর পথের সন্ধান দিবেন, তাহা পূর্ব অনুমানের অতীত। এই মুহূর্তগুলি আসে, এবং তাহার অভিঘাতেই ইতিহাসের মোড় ঘোরে। নরেন্দ্র মোদীর অভিঘাত পশ্চিমবঙ্গকে শতাব্দীব্যাপী অন্তর্জলিযাত্রা হইতে ফিরাইয়া আনিতে পারে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর একমাত্র ভবিষ্যৎই দিতে পারে। কিন্তু, সম্ভাবনাটি যে দেখা যাইতেছে, তাহা কম কথা নহে।

অন্য বিষয়গুলি:

editoial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy