Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
প্রবন্ধ২

মাথা নত হল না? চোখে জল এল না?

যে শরীরী ভাষায়, যে মৌখিক অভিব্যক্তি ও বয়ানে রানাঘাটে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের মুখে রাজনৈতিক বিবাদী পক্ষকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছিলেন মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী, তা নিন্দনীয় এবং ভয়াবহ।মাতৃস্থানীয়া, সন্ন্যাসিনী, শিক্ষয়িত্রী এবং বৃদ্ধা। তাঁর প্রতি যে নারকীয় নির্যাতন, তা একজন ব্যক্তিনারীর অসম্মান মাত্র নয়, নারীজাতির অবমাননা শুধু নয়, নয় কেবল মাতৃস্থানীয়ার প্রতি মর্মবিদারক অত্যাচার এবং অমর্যাদা রানাঘাট গাংনাপুর কনভেন্ট স্কুলের বীভত্‌স ঘটনা আমাদের সামাজিক পরিকাঠামোর ধারক যে ন্যায়নীতি, মূল্যবোধ তার মূলে আঘাত করেছে এবং বহু প্রশ্ন ও ক্ষোভের সঞ্চার করছে।

ত্রাসের দেশ। রানাঘাটে প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীদের মিছিল, ১৪ মার্চ। ছবি: এএফপি।

ত্রাসের দেশ। রানাঘাটে প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীদের মিছিল, ১৪ মার্চ। ছবি: এএফপি।

তিলোত্তমা মজুমদার
শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০১৫ ০০:০২
Share: Save:

মাতৃস্থানীয়া, সন্ন্যাসিনী, শিক্ষয়িত্রী এবং বৃদ্ধা। তাঁর প্রতি যে নারকীয় নির্যাতন, তা একজন ব্যক্তিনারীর অসম্মান মাত্র নয়, নারীজাতির অবমাননা শুধু নয়, নয় কেবল মাতৃস্থানীয়ার প্রতি মর্মবিদারক অত্যাচার এবং অমর্যাদা রানাঘাট গাংনাপুর কনভেন্ট স্কুলের বীভত্‌স ঘটনা আমাদের সামাজিক পরিকাঠামোর ধারক যে ন্যায়নীতি, মূল্যবোধ তার মূলে আঘাত করেছে এবং বহু প্রশ্ন ও ক্ষোভের সঞ্চার করছে। মাতৃসমা সন্ন্যাসিনীর সঙ্গে ধর্ষিত হয়েছে নারী-পুুরুষ নির্বিশেষে সমগ্র সমাজ। কারণ, মায়ের অসম্মান, সভ্যতার মানহানিকারক।

আপাতচক্ষে একে বিকৃতকামী মানসিকতা বলে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। যে দেশে প্রায় প্রত্যহ দুই-তিন-চার বছরের শিশু কিংবা নাবালক-নাবালিকা ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, সেখানে বিকৃতকামী ব্যক্তির অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহ থাকে না। এমনকী গোটা বিশ্ব জুড়ে এই বিকৃতকামুকতা মানবজাতির এক গভীর অসুখ। কিন্তু এ ধরনের ক্রিয়ার কিছু লক্ষণ থাকে। গাংনাপুরের ঘটনা আকস্মিক উত্‌কটকামিতা নয়, অর্থাত্‌, ডাকাতি করতে এসে হঠাত্‌ উপস্থিত মনোবিকার নয়। ঘটনা পরম্পরা লক্ষ করলে বোঝা যায়, এটি সুপরিকল্পিত, প্রায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্তর মতো আগাগোড়া ঘটনাটি ঘটিয়েছে অপরাধীরা। যেন কোনও মহড়া দেওয়া নাটকের মঞ্চায়ন। আর ঠিক এইখানেই ধর্ষিত হয়েছে আমাদের সামাজিক নীতিবোধ। আমাদের সভ্যতায় অদ্যাবধি কেবল গর্ভধারিণীই মা নন, সামাজিক-পারিবারিক সম্পর্কে যাঁরা মাতৃস্থানীয়া তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন আমাদের সামাজিক শৃঙ্খলা রচনা করে। সংসারত্যাগী নারী বা পুরুষ, যে বয়সেরই তাঁরা হয়ে থাকুন, গেরুয়া বসন, সাদা বসন কিংবা পীত বা রক্তাম্বরা যে দর্শনই তিনি অবলম্বন করুন, আমরা নিঃসংশয়ে তাঁদের মাতৃ বা পিতৃ সম্বোধন করি। যুগপরম্পরায় তৈরি হওয়া সভ্যতা ও সংস্কৃতির অঙ্গ এই সম্পর্ক। ব্যক্তিগত সুখবিলাসিতা বর্জন করে যাঁরা ঈশ্বর ভজনা করেন, ব্যক্তিগত স্বার্থ ত্যাগ করে যাঁরা সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করেন, তাঁদের শ্রদ্ধার উচ্চাসনে বসাতে আমাদের রীতি-নীতিই কেবল সমর্থন দেয় না, আমাদের হৃদয় তা চায়। ‘ত্যাগ’ ভারতবর্ষের মূল দর্শনগুলির মধ্যে অন্যতম। আমাদের জাতীয় পতাকায় গেরুয়া রং ত্যাগের প্রতীক। তাই গাংনাপুরের সন্ন্যাসিনী যখন ধর্ষিতা হচ্ছিলেন, অপরাধী দলের অবশিষ্ট লোকগুলি যখন এই জঘন্য কর্মে বাধা দেয়নি, তখন একে সুপরিকল্পিত ছাড়া আর কী বলা যায়?

আসলে তখন ধর্ষিতা হচ্ছিলেন আমাদের দেশমাতৃকা। মা, মাটি, মানুষের মা। ধর্ষিত হচ্ছিল আমাদের ত্যাগব্রতের প্রতি শ্রদ্ধা, সমীহ। নৃশংসতার দিক দিয়ে গাংনাপুর দিল্লির নির্ভয়ার ঘটনার সঙ্গে তুলনীয় বটে। এই ঘটনা আমাদের জাতীয় অমর্যাদা!

প্রতিহিংসার চরিতার্থতাও গাংনাপুর ঘটনার এক ব্যাখ্যা। ব্যক্তিগত প্রতিহিংসাবশতও যদি এই পথ অবলম্বন করা হয়, তবে, সত্য প্রকাশ হলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি সারা দেশের মনে জাগরূক থাকবে সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রতিহিংসার উন্মত্ততা খুনে পর্যবসিত হতে পারত। সেটি অনেক বেশি বাস্তবোচিত হত। যা মৃত্যুর চেয়েও নিষ্ঠুর তার নিশ্চিত কার্যকলাপ শুধু প্রতিহিংসা চরিতার্থতাও সমর্থন করে না। বরং অন্য এক জটিল ভাবনা আসে। কেউ বা কারা ভুল ভাবাতে চাইছে মানুষকে। এ হল পাকা মাথার প্ররোচনামূলক চক্রান্ত। একজন বৃদ্ধা সন্ন্যাসিনীর ধর্ষণ কত দূর প্রভাব সমাজে ফেলতে পারে, তদুপরি সেই সন্ন্যাসিনী ধর্মীয় সংখ্যাগুরু হিন্দু নন, খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী, তাঁর চূড়ান্ত অপমান, তাঁর প্রতি ঘৃণ্য অত্যাচার কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে, কী ভাবাবে সাধারণ মানুষকে? ভাবাবে এই যে, আমাদের ধর্মীয় সহিষ্ণুতার দিন ফুরোতে চলেছে। ঘটনার অব্যবহিত পরেই রাজ্যের দুই পদস্থ মন্ত্রী এ হেন মন্তব্য করে বসেছেন। ধর্মীয় বিভেদমূলক মানসিকতা পশ্চিমবঙ্গবাসীর ছিল না, তবু যেন তাঁদের মধ্যে এই ত্রাস বিশ্বাস করিয়ে, গিলিয়ে দেবার প্রয়াস দেখা যাচ্ছে। যখন প্রয়োজন ছিল পরিপূর্ণ আশ্বাস এবং সমবেদনা, তখন শুরু হয়েছে রাজনৈতিক খেলা! এবং এখানেই ঘটনাটির চূড়ান্ত ত্রাসের জায়গা। আপাতচক্ষের অরাজনৈতিক বিকৃতকাম তত্ত্ব বা প্রতিহিংসার ব্যাখ্যার অন্তরাল থেকে মানুষকে এটা ভাবানো যে দেখো, আক্রমণ হল খ্রিষ্টান মিশনারির প্রতি। সংখ্যালঘুর প্রতি। কারা পরধর্ম অসহিষ্ণু ভেবে দেখো। তাদের আটকাও। এ এক নোংরা নিষ্ঠুর ঘৃণ্য রাজনৈতিক ছক!

যে শরীরী ভাষায়, যে মৌখিক অভিব্যক্তি ও বয়ানে রানাঘাটে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের মুখে রাজনৈতিক বিবাদী পক্ষকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছিলেন মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী, তা নিন্দনীয় এবং ভয়াবহ। অথচ মাত্র ক’দিন আগে, কতিপয় মৌলবাদীর শাসানিতে মেয়েদের ফুটবল খেলা বন্ধ করে নারীত্বের যে অপমান হল, যে চোখরাঙানির আদিমতা আমাদের সামাজিক প্রগতি ও আধুনিকতার মর্যাদা ধুলোয় লুটিয়ে দিল, একজন মহিলা মুখ্যমন্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তার প্রতিকার হল না। সত্‌ ও নির্ভীক প্রশাসক হিসেবে এই চ্যালেঞ্জ তিনি করতে পারলেন না, খেলা হবে, মেয়েরা খেলবেন, কোনও গোষ্ঠীর চোখরাঙানিকে তিনি পরোয়া করেন না! সমাজে অশিষ্ট ঘটনা ঘটলে মানুষ তার প্রতিবাদ করবেন, বিচার চাইবেন, আইন-শৃঙ্খলার অধিকার, নিরাপত্তা, শিক্ষা-স্বাস্থ্যর অধিকার দাবি করবেন, সেটাই ন্যায্য কর্ম। রিজওয়ানুর কাণ্ডে তা হয়েছিল, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে হয়েছিল, পার্ক স্ট্রিট, বারাসত, কামদুনিতে হয়েছিল, রানাঘাটেও হচ্ছে। একেবারে কিশোরীরা, তরুণেরা পথে নেমে প্রতিবাদ করছে। বিচার চাইছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাথা নত হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। যাঁর স্লোগানের মূল কথা ‘মা’, এই ঘটনায় তাঁর চোখে জল আসা উচিত ছিল, উচিত ছিল অগণিত ছাত্রছাত্রী, অভিভাবক এবং সাধারণ মানুষের প্রতি সহানুভূতির বার্তা প্রেরণ, উচিত ছিল তাঁর প্রশাসনিক তত্‌পরতার প্রমাণ রক্ষা। তার পরিবর্তে তিনি যা বললেন, যে ভাবে বললেন, তা কেবল লজ্জার, হতাশার, অবমাননার। হায় পশ্চিমবঙ্গ! সারা বিশ্বের কাছে মুখ যে লজ্জা আর গ্লানিতে কালিমালিপ্ত হয়ে গেল!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE