‘আমেরিকান বিউটি’ ছবির একটি দৃশ্য। মাঝবয়সি নায়কের ফ্যান্টাসিতে দর্শকের সায়।
মানুষ তার জীবনের মিড-পয়েন্টে, অর্থাৎ চল্লিশ-পঞ্চাশের মাঝামাঝি পৌঁছে পাঁইপাঁই ফ্ল্যাশব্যাক মোডে ঘুরপাক, এবং অবধারিত উপসংহার— এ তো যা ভেবেছিলাম, তার টোটাল উলটো অঞ্চলে খাবি খাচ্ছি রে! যা চেয়েছিলাম, কিস্যু পাইনি, আর যে ঘাটের-মড়া গেরস্থকে ঘেন্না করেছিলাম, প্রিসাইসলি তা-ই হয়েছি। তখন সে মাঝরাত্রে বারান্দায় বেরিয়ে ফকফক সিগারেট টানে ও ভাবে: যাক্কলা, বুড়িয়ে গেলাম, জীবন লইয়া আর কবে জাগলিং করিব? টাক বা চুল খামচে তখন দিনরাত্তিরকে অ-বোর ও গরগরে ছোপ দেওয়ার তাগিদে ধাঁ পরকীয়ায় ঝাঁপিয়ে পড়ে, বা ছিমছাম চাকরি ছুড়ে তেলেভাজার দোকান খোলে, বা সহসা জিম জয়েন করে এমন স্পিডে লোহা তোলে যে পাড়ায় নাম হয় ডাম্বেলকাকু। এরে কয় ‘মিডলাইফ ক্রাইসিস’। লব্জ-টা শুনলেই কুড়ি-তিরিশরা গোঁপের তলে ফিকফিকায়, চল্লিশ-পঞ্চাশরা জাপটে বিড়বিড়োয় ‘উফ, সত্যতম সত্য’, ষাট-পঁয়ষট্টিরা ভাবে, মেনে না-নেওয়ার অশান্তি যে নিজমধ্যে পোষে, যথেষ্ট ম্যাচিয়োর-ই না! এই নিয়ে ডজন ডজন সাহিত্য সিনেমা ফনফন, ‘আমেরিকান বিউটি’তে কেভিন স্পেসি এই বয়সটাতেই ঠিক করেন, উফ বহুত হল, এ বার স্রেফ নিজেকে নিজের সেন্টারে ফিট করব, ব্যায়াম করব ড্রাগ খাব মেয়ের বান্ধবীকে বিছানায় চাইব। কৌতুক ও বেদনাকে নিপুণ লস্যির ন্যায় মেশানো এ সব চিত্রনাট্য মানুষের মনে পরম সত্যের স্টেটাস পায়। তাই আজকালকার প্রায় প্রতিটি লোক চল্লিশ পেরোলেই বিকেলের দিকটা গুমসো ন্যাতার মতো নেতিয়ে পড়ে আর ভাবে, অঃ, এ তো হবেই, আমি মিডলাইফায়িত। থুতনিটা এট্টু বাঁয়ে টিল্ট মেরে মিডলাইফ-শহিদ পোজে বহু ক্ষণ থাকে, যেন অতিকায় কান্নাড্রপ বুঝে এখুনি গলি থেকে সুস্তনী বেরিয়ে হাত ধরে বলবে, সোনাটা!
সম্প্রতি ঝামেলা। ম্যাাসাচুসেট্স বিশ্ববিদ্যালয় পেল্লায় সমীক্ষা চালিয়ে জানাল, মিডলাইফ ক্রাইসিস বলে কিস্যু নেই। এটা স্রেফ ভাঁওতা। সমীক্ষায় গুচ্ছের লোকের ইন্টারভিউ নেওয়া হয়েছে, যাদের বয়স চল্লিশ আর পঞ্চাশের মাঝামাঝি, আর যারা খুবই অসুখী ও গোমড়া। ডিটেলে প্রশ্ন করে জানা গেছে, তারা প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের অধিকাংশ মুহূর্তই জীবন নিয়ে সাংঘাতিক খ্যাচখ্যাচ করেছে। মানে আঠেরো-ফাঠেরো থেকেই। স্টোরির মরাল: যে লোকটার জিভে তেতো, সে ইটার্নাল উচ্ছেবাবু। তার আর্লিতেও বার্লি, মিড-এও হারমোনিয়ামের বাঁ দিকের রিড। আর, ‘এই পানাপুকুর ও তার চারপাশের ছানাকুকুর অসহ্য, সব ভেঙে, স্পেশালি নিজেকে ভেঙে, নতুন শুরু ইয়ায়া’— এ বিদুৎ-সিদ্ধান্ত কাউকে ষাটেও কামড়াতে পারে, আবার ‘রোজ রাত্তিরে তনছট লাগে এমনকী জেলুসিল খেয়েও ঘুম আসে না, বেলা বয়ে যায় কোথা সাকসেস হায়’— সাতাশের যুবাযুবির কপালেও ফোঁড়া হয়ে জাগে। তাই এই মধ্যকাটা মুরগির মেটের ইঞ্জিন-দাপানি চালশের মতো বয়সের ঘড়ি ধরে কলিং বেল টেপে, মিথ।
আসলে, ক্রাইসিসের ফাঁদ বিশ্বাস করতে মানুষের হেভি লাগে। সে নির্ঘাত তীব্র বিপদে পড়েছে, তার একটা জটিল সংকট চলছে, এই ছমছম যাপলে নিজেকে বেশ সুবিধেজনক ভাবে অসহায় মনে হয়। আহা রে, তোকে কেউ বুঝল না, ঠিক হ্যায় আজ বিরিয়ানি পেঁদাবি চল। অবশ্য তার আগে লক্ষ করার: মানুষের অদ্ভুত প্রবণতা: সে তাবৎ ব্যাপারকে ‘একশো’ সংখ্যাটার প্রেক্ষিতে দেখে। হয়তো অঙ্ক পরীক্ষার পরম অভীষ্ট (ও আজীবন অনায়ত্ত) ফুলমার্কসটাই এই মনোভঙ্গি গছিয়েছে। তার মাথায় ঢুকেছে, পঞ্চাশে সে কর্মঠ জীবনের মধ্যবিন্দুতে পৌঁছয়। অথচ গড় মানুষের ক্ষেত্রে, এই মুহূর্ত তো এসেছিল তিরিশ-বত্তিরিশেই (কারণ ষাটের পরও সৃষ্টিশীল ও অবদানমুখর জীবন ক’জন কাটায়?), তখন কিন্তু সে দিব্যি ইতিবাচকতায় চান করে হেসে-খেলে একসা। মোদ্দা ব্যাপার: চালু-বাক্য আমাদের বহুবিধ সর্বনাশ করে। আর সমাজবাজরাও একটা করে নবীন রোয়াঁ হাওয়ায় ভাসিয়ে, সেটাকে ফাঁপিয়ে ফ্যাশন বানাতে বহুত আমোদ পায়। আধুনিক মানুষ জীবন শিখে নেয় সিরিয়াল অ্যাড আর গ্লসি ম্যাগ থেকে। এরা একটা করে হুপুই তোলে আর সেই আঁচ পুইয়ে কেউ ‘অ্যাঁ! মেল মেনোপজ!’ ডুকরে হাঁহাঁ ভিটামিন ক্যাপসুল হাতড়ায়, কেউ দুঃখু গিলে গিলে তলপেট ঢাউস করে বলে, আজ ডিনার থাক, মিডলাইফ এসে গেল! বেদনাটা দাদ পোষার মতো। ব্যথা-ব্যথা আরাম।
আসলি হাহুতাশ-ডিম্ব পাড়ে, অবশ্যই, সেক্স। অ্যাদ্দিন এক লোকের সঙ্গে শুয়ে এলাম, তবে কি বাকি জীবনও এই পানসে ধর্মে কেটে যাবে? ইনস্টিংক্টকে তোল্লাই দিয়ে তুড়ুক-দুষ্টুমি করে নেব না? ভিতু ও প্রচলনীতু বাবুটি তখন ভেবে আয়েস পান, এ লিবিডো-লিখন অনিবার্য, মিডলাইফের অবশ্যম্ভাবী লীলা, আমি কী করব? বিধির বিধান তো খণ্ডাতে পারি না! স্টার্ভড জং-ধরা ঢাকনাটি চাড় মেরে খুলে তখন শুরু হয় বাথরুমে ইতস্তত সেক্সটিং। ফাঁকা দুপুর দেখে বোল্ড রিলেশন! মিডলাইফ ক্রাইসিস এই লাইসেন্সটি হাতে গুঁজে দিয়ে, তার বিড়ির এঁটো কাউন্টার নিয়ে, নিপুণ টুনির মতো চোখ মটকায়।
আর যে এই পাড়া মাড়ায় না, তাকে খাবলে ধরে এই ঝোঁকেরই ভাই-বেরাদর: ফুর্তিইইই। দামড়া লোক ইহার চেয়ে আরব বেদুইন হবেই প্রতিজ্ঞিয়ে, ভুঁড়ির ওপর সুটাইট টি-শার্ট সেঁটে, দিগ্বিজয়ে চলল। শ্বশুরকে অবধি বলল, একটা টিকটিকির ট্যাটু করাব ভাবছি! ভাবে আজকাল সে খুব ঘন ঘন। নাইটক্লাবে যাবে, ছোট গাড়িতে চলছে না এসইউভি দাবড়াবে, বেশ স্পিডে চালাবে, সোজা কথায় শিং ভেঙে একটা ব্লিপ-ব্লিপ লাইট-জ্বলা শিং ফিট করবে। জীবন ইজ পিকনিক, ভোগ ইজ ইন ভোগ, মিডুভায়া জপে। মুশকিল: ডোন্টকেয়ার চুলঝাঁক্কি তো শো-উইন্ডোর প্রোডাক্ট নয়, হাতে নিলাম আর আয়ত্ত হয়ে গেল। ওটা যে পারে সে আপনি পারে, পারে সে ফুল ঝাঁকাতে। আর যার হয় না, সে লটারিতে দু’কোটি মারলেও বেছে বেছে পটল কেনে। এবং বৃহৎ বখেড়া: সিন পালটাতেই দেখা যায়, ‘আমি অসুখী, তাই যথেচ্ছাচার করব’ তত্ত্বকে ব্যাদড়া সমাজ টেনে থাবড়া কষাচ্ছে। আর নিউটন বলছেন, কর্মের ফল কারও শৌখিন বিষাদের ধার ধারে না রে গ্যাঁড়া, বউ মোবাইল পড়ে ফেলেছে। অতঃ লোক-হাসানো সেরে, নতমুখে নিজ মশারিতে প্রত্যাবর্তন ও মশা-মৃগয়া।
ব্যাপারটা বোঝা ইজি। দুঃখের, আফশোসের আবার মিডলাইফ কী? উসখুসুনির, ছোঁকছোঁকের আবার মিডলাইফ কী? এরা সারা জীবন ধরেই এ-গাল ও-গাল ঠোনা মেরে ফাটিয়ে দিচ্ছে। আদ্ধেক লোকেরই কণ্ঠার কাছটায় বেপরোয়া ও সমাজ-বেতোয়াক্কা জীবন বিতাবার ফ্যান্টাসি থরথর। কিংবা টেরিফিক অতৃপ্তি সড়সড়। বার্ট্রান্ড রাসেল পনেরো বছর বয়সেই ঠিক করেছিলেন আত্মহত্যা করবেন, পরে গণিতের প্লেজার ভেবে, নিরস্ত হন। ‘জীবন সুবিধের নয়’ বুঝতে আবার চল্লিশ অবধি গড়াতে হয় না কি? প্রায় সব বুদ্ধিমানই সতত মেজাজ খিঁচড়ে হালকা ডিপ্রেশন আর আত্মমায়া ছলছলিয়ে পলায়ন-সুড়ঙ্গ খোঁজে। এখন, তুই এ জিনিস সামলাতে ক্রাই করবি না শিস দিবি, তোর ব্যাপার। ক্রাইসিস ক্রাইসিস বলে ইংরিজিতে হেলান দিচ্ছিস কেন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy