উত্তরপ্রদেশের বদায়ূঁতে হতভাগ্য দলিত মেয়ে দুটির আর্তনাদ শুনে নিম্নবর্ণের মরিয়া গোষ্ঠীর কাকা দেখেছিলেন, যাদবদের ছেলে পাপ্পু এক জনের চুল ধরে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি পুলিশকে জানালে পুলিশকর্মী বলে, দু’ঘণ্টা পরে না ফিরলে খোঁজ নেবে। মরিয়া গোষ্ঠীর অভিযোগ, যাদব পুলিশ যাদবদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নেয়নি। উত্তরপ্রদেশে এখন যাদব রাজ।
জাতপাত আর পৈশাচিকতার এই কাহিনির একটি অন্য মাত্রাও আছে। বদায়ূঁর দুই কিশোরীকে হয়তো এ ভাবে ধর্ষিত হয়ে, গাছে ঝুলে নিহত হতে হত না, যদি তাদের বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেই একটি শৌচাগার থাকত। হরিয়ানার ভাগানার চারটি মেয়েকেও ধর্ষিত হয়ে ভাতিন্ডা রেল স্টেশনে শব হয়ে পৌঁছতে হত না। সিঙুরের শহিদ অভিধা নিয়ে কৈশোরেই চলে যেতে হত না তাপসী মালিককে। খরজুনার গৃহবধূটিও বেঁচে থাকতেন। বিহারের অনগ্রসর শ্রেণির জন্য নিযুক্ত পুলিশের আই জি অরবিন্দ পাণ্ডে বিবিসি’কে জানিয়েছেন, ২০১২ সালে রাজ্যে ধর্ষিত ৮৮৩ জন অনগ্রসর শ্রেণির মেয়ের মধ্যে ৪০০ জন বেঁচে যেত শৌচাগারের সুযোগ থাকলে।
এ কোনও বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়। ২০১১ সালেও ৫৩ শতাংশ ভারতীয় বাইরে শৌচকার্য সম্পন্ন করতে বাধ্য হন। এগুলি তো গড়, তার মধ্যে গ্রাম-শহরে, নিম্নবিত্ত-উচ্চবিত্তে আর নারী-পুরুষে হয়ে যায় বিরাট ফারাক। গ্রামে বা শহরের নিম্নবিত্ত এলাকায় প্রায় ৭০ শতাংশ বাড়িতে শৌচাগার নেই। কিন্তু দেশে মোবাইলে যোগ রয়েছে এ রকম মানুষ ৮০ শতাংশ। শহুরে পুরুষরা তাও হয়তো শৌচাগার পান, মেয়েদের অবস্থা ভয়াবহ। মেয়েরা আঁধার নামলে বা আলো ফোটার আগে একলা বা দল বেঁধে শৌচ সারেন, ঝোপঝাড়ের আড়ালে, ফসলের খেতে, হাইওয়ের ঢালে। পুরুষমানুষরা তক্কে তক্কে থাকে, উঁকিঝুঁকি, শিস দেওয়া, টর্চ ফেলা, উলঙ্গ হয়ে পুরুষাঙ্গ দেখানো, ‘কী করতে এসেছিস?’ প্রশ্ন করা বা অশালীন মন্তব্য করা তো নিরীহ ব্যাপার, টেনে নিয়ে যাওয়া, গায়ে হাত দেওয়া, এমনকী ধর্ষণ পর্যন্ত ঘটে। গ্রামে কারও বাগানে ঢুকলে লাঞ্ছনা অবধারিত। বর্ষায় জলে-ডোবা খেত আর সাপে কাটার ভয়। এই মেয়েদের পক্ষে শৌচকার্য রীতিমতো পরিকল্পনার বিষয়। জল আনতে গেলেও হয়তো ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন দিতে হয়, কিন্তু তার মধ্যে লজ্জা নেই; ঝগড়াঝাঁটি আছে, কিন্তু পুরুষের অশালীন আক্রমণের আশঙ্কা নেই।
দিল্লির ১২টি পুরসভায় পুরুষদের জন্য ৩৭১২টি আর মেয়েদের জন্য ৩৫০০টি শৌচালয় আছে। এর মধ্যে অনেকগুলি বাণিজ্যিক এলাকায়, ৭ দিন ২৪ ঘণ্টা খোলা নয়। কলকাতার পরিসংখ্যান পাইনি। তবে এটুকু জানি, পুরুষরা যেখানে-সেখানে নিজেদের হালকা করতে দাঁড়িয়ে যায়। শৌচালয়গুলিতে টাকা দিতে হয়। যে মেয়ের রোজকার মজুরি ৩০ টাকা, তাঁকে ৫ টাকা খরচ করতে হলে ভাবতে হবে বইকী। সেই সব জনশৌচালয়েও বিব্রত করে কৌতূহলী পুরুষের অশালীন আচরণ। অনেক সময় এগুলির আলো খারাপ থাকে, জানালা নিচু, ফলে উঁকিঝুঁকির সুবিধে। দিল্লির কেন্দ্র থেকে উচ্ছেদ হয়ে উত্তর-পশ্চিম দিল্লিতে পুনর্বাসিত দুটি বস্তি বালসাওয়া আর বায়ানা কলোনিতে সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে, পুনর্বাসনের সময় সরকার টয়লেট কমপ্লেক্স বানিয়ে দিয়েছিল, এখন শৌচালয় পিছু ৩০০ জন ব্যবহারকারী। লাইনের দৈর্ঘ্য বোঝাই যায়। অনেক সময় সেগুলির ছাদ উড়ে যায়, নেশাখোররা ঘোরাঘুরি করে। আর মাসের মধ্যে এক বার অন্তত একটি মেয়েকে, বিশেষত কিশোরী মেয়েকে তুলে নিয়ে যায় রাজমিস্ত্রিরা, বাড়ির লোকেরা পুলিশকে কী করে বলবে যে শৌচকার্য করতে তাকে বাইরে যেতে হয়? নামহীন নির্যাতিতার নিগ্রহ পরিবারের সম্মানের তলায় চাপা পড়ে থাকে। তাই মেয়েরা তিন-চার জন মিলে যান, হাতে থাকে জলের বোতল, যাতে কেউ হাত বাড়ালে অন্তত দু’ঘা লাগিয়ে দেওয়া যায়। শুধু দিল্লি নয়, অন্যত্র, যেমন ধারাভিতেও যৌনহেনস্থা এড়াতে দল বেঁধেই শৌচালয়ে যেতে হয়। ছবিটা হয়তো সব শহর আধাশহরেই সত্যি।
তবু এরই মধ্যে দু’একটা রুপোলি রেখা আছে। হরিয়ানায় ‘বাড়িতে শৌচালয় নেই তো বউ আসবে না’ প্রচার বেশ সফল। প্রতিবাদী প্রিয়ঙ্কা ভারতীর ‘শৌচালয় নেই তো বিয়ে নয়’ দাবিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আর ইউনিসেফ গ্রহণ করেছে। ‘নির্মল গ্রাম’ মানে কেউ বাইরে শৌচ করে না— জনপ্রিয় অভিনেত্রী বিদ্যা বালন হয়েছেন সেই প্রচারের মুখ। যে উত্তরপ্রদেশে বদায়ূঁর ঘটনা ঘটে, সেখানেই লখনউয়ের কাছে আহমেদপুরে মেয়েদের স্বনির্ভর গোষ্ঠী সরকারি প্রকল্প আর স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সহায়তায় গড়ে তুলেছে একটি টয়লেট কমপ্লেক্স, যার জমিটি দিয়েছেন স্থানীর এক কৃষক। চারটি শৌচাগার আর দুটি স্নানাগার, নারী ও পুরুষদের পৃথক অংশ, পৃথক প্রবেশদ্বার। গ্রামে একটি গণশৌচালয় কমিটি তৈরি হয়েছে, পরিবার পিছু ১৫ টাকা মাসিক চাঁদা, যা দিয়ে বিদ্যুতের বিল মেটানো হবে, শৌচালয় মেরামতিও। সাফাইকর্মী দিচ্ছে পঞ্চায়েত। পরিবারের বাড়িগুলি ছোট, ফলে নিজেদের বাড়িতে পৃথক ভাবে শৌচাগার তৈরি করা মুশকিল হচ্ছিল। মেয়েরা আর ‘মাঠ সারতে’ রাজি নন। আমাদের রাজ্যে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মেয়েরা তো জমি হাসিল করে চাষ করছেন, পুকুর জমা নিয়ে মাছ চাষ করছেন, তাঁরা এ রকম চাঁদা করে গণশৌচালয় তৈরি করতে পারেন না?
শৌচালয় থাকলে অনেকগুলি মেয়ে বেঁচে থাকবে, তার সঙ্গে পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়া, এ সব তো বাড়তি সুবিধা? যেমন স্কুলে শৌচালয় না থাকলে ইসকুল-পড়ুয়া মেয়েদের ২৩ শতাংশ ঋতুমতী হয়ে পড়া ছেড়ে দেয়, বাকিরা ‘ওই’ চার-পাঁচ দিন কামাই করে, বছরে দাঁড়ায় ৫০ দিন। যে মেয়েরা ইসকুল শেষ করতে পারে, বেশি পড়তে পারে, তারা অন্যায় শোষণ আর বঞ্চনার হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারে, অসুখবিসুখে সাবধান হতে পারে, সমাজকে দেওয়ার মতো দক্ষতা অর্জন করতে পারে, আঠারোর আগে বিয়েতে ‘না’ বলতে পারে, শিশুজন্মের সময় মৃত্যু হয় না, মা হলে সন্তানকে সুস্থ আর শিক্ষিত করে তুলতে পারে। নারীশিক্ষার হার ১০ শতাংশ বাড়লে দেশের উন্নয়ন বাড়ে ০.৩ শতাংশ হারে। খোলা জায়গায় মলত্যাগ দেশের শ্রমশক্তিকেও কমিয়ে দিচ্ছে— এ জন্য জলবাহিত রোগে বছরে শ্রমদিবস নষ্ট হয় ৭ কোটি, রোগ সারাতে অর্থব্যয় তো আছেই। দেশের ১৫টি শহরে সমীক্ষা করে ‘স্কোয়াটিং রাইটস’ রিপোর্ট (২০১২) দেখিয়েছে, আর্থিক ভাবে তুলনায় দুর্বল বসতিগুলিতেই শৌচালয় আর নিকাশি ব্যবস্থার বিশেষ অভাব, যেখানে ঘনবসতিতে থাকেন প্রধানত নিম্নবর্গ, সংখ্যালঘু মানুষ। ফল: ‘অসুস্থ শিশু, অশিক্ষিত কিশোরী আর অনুৎপাদনশীল মানুষ, যা এই জনগোষ্ঠীকে আরও দুর্বল করে দিচ্ছে, যার ফলে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের মোট জাতীয় আয়ের ৬.৪ শতাংশ’। নতুন প্রধানমন্ত্রী তো বলেইছিলেন ‘পহ্লে শৌচালয়, ফির দেবালয়’। উন্নয়নের খাতিরেই সেই দিকে নজর দিন না? সরকারি দফতরে, স্কুল-কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে, হাসপাতালে, ব্যাংকে, বাজারে, শপিং মলে, সিনেমা-থিয়েটারে, যাতায়াতের পথে, বাসস্ট্যান্ডে, হোটেলে, রেস্টুরেন্টে পর্যাপ্ত শৌচালয় বানানো দরকার। যেখানে শৌচালয় আছে, সেগুলিকে ব্যবহার্য করাও তো অবিলম্বে প্রয়োজন, বিশেষত ট্রেনে আর স্টেশনে।
গণশৌচালয় আন্দোলন এ সবকে অধিকারের মধ্যে আনতে চায়। শিক্ষার মতো শৌচালয়ও মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার। কারণ, এর সঙ্গে মেয়েদের বাঁচা-মরা জড়িয়ে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy