Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

পুতুলনাচ

শব্দের অশিক্ষিত এবং অসতর্ক ব্যবহারে বাঙালির আগ্রহ চিরন্তন। সোচ্চার, সঠিক, অশ্রুজল বা ফলশ্রুতির ন্যায় শব্দ বাংলায় কম নাই। তালিকায় আরও একটি শব্দ বাড়িল বলিয়াই আশঙ্কা— ‘বিদ্বজ্জন’। কর্মধারয় সমাসবদ্ধ পদটির অর্থ: বিদ্বান ব্যক্তি। শুক্রবার নন্দন হইতে আকাডেমি অব ফাইন আর্টস পর্যন্ত নাতিদীর্ঘ মিছিলে যাঁহারা হাঁটিলেন, তাঁহাদের সিংহভাগ বিদ্যা বা পাণ্ডিত্যের কারণে খ্যাত, এমন দাবি করা কঠিন। ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দটি অনেক কাল যাবৎ বিদ্বজ্জনের সমার্থক রূপে বিবেচিত হইয়াছে।

শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

শব্দের অশিক্ষিত এবং অসতর্ক ব্যবহারে বাঙালির আগ্রহ চিরন্তন। সোচ্চার, সঠিক, অশ্রুজল বা ফলশ্রুতির ন্যায় শব্দ বাংলায় কম নাই। তালিকায় আরও একটি শব্দ বাড়িল বলিয়াই আশঙ্কা— ‘বিদ্বজ্জন’। কর্মধারয় সমাসবদ্ধ পদটির অর্থ: বিদ্বান ব্যক্তি। শুক্রবার নন্দন হইতে আকাডেমি অব ফাইন আর্টস পর্যন্ত নাতিদীর্ঘ মিছিলে যাঁহারা হাঁটিলেন, তাঁহাদের সিংহভাগ বিদ্যা বা পাণ্ডিত্যের কারণে খ্যাত, এমন দাবি করা কঠিন। ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দটি অনেক কাল যাবৎ বিদ্বজ্জনের সমার্থক রূপে বিবেচিত হইয়াছে। মিছিলের অনেক পরিচিত মুখ এই শব্দটিতে নিজেদের অধিকার দাবি করিয়া বলিতে পারেন, বুদ্ধিই তাঁহাদের জীবনের উপায়। হয়তো সত্য। তবে, সেই বুদ্ধিকে সুবুদ্ধি বলা চলে না, তাহা আর এক কঠিন প্রশ্ন। তাঁহারা কেন মিছিলে হাঁটিলেন, নিজেরা জানেন? ‘বুদ্ধিজীবী’/বিদ্বজ্জনকুল জানাইয়াছেন, তাঁহারা ‘বাংলা সংস্কৃতির উপর আঘাত’-এর প্রতিবাদে মিছিলে হাঁটিলেন! হাঁটিলেনই যখন, আর দুই পা আগাইয়া নন্দনেই মিছিল শেষ করিতে পারিতেন। আর কিছু না হউক, মিছিলটির প্রতীকমূল্য বাড়িত, বোঝা যাইত, ‘যেখানে শুরু সেখানেই শেষ’।

মিছিল যাঁহার নির্দেশে, তিনি নিজে পা মিলান নাই বটে, তবে কে হাঁটিলেন এবং কে হাঁটিলেন না, তাহার বিশদ এবং সটীক তালিকা তাঁহার নিকট পৌঁছাইবে বলিয়াই অনুমান। সত্য ইহাই যে ইচ্ছাময়ীর আদেশ অমান্য করিবার মতো দুর্বুদ্ধি তাঁহাদের নাই বলিয়াই শুক্রবার অপরাহ্ণে ‘বুদ্ধিজীবী’দের পথে নামিতে হইয়াছে, কয়েক পা হইলেও হাঁটিতে হইয়াছে। বঙ্গেশ্বরীর আদেশ বিনা প্রশ্নে মান্য করাই তাঁহাদের নিকট পুষ্টিকর বলিয়াই মানিয়াছেন নিশ্চয়। নেত্রী বিচলিত। তাঁহার কয়েক জন ‘অতিথি’ আরও বেশি বিচলিত— সিবিআই জাগ্রত দ্বারে। কিন্তু, মিছিলে যত জন হাঁটিলেন, প্রত্যেকেই ভিতরে ভিতরে কাঁপিতেছেন, অবস্থা কি সত্যই এতখানি করুণ? যদি হয়, তবে নেত্রীর মিছিলের প্ল্যাকার্ডগুলির পুনর্ব্যবহার বিধেয় ছিল। আর যদি না-ই হয়, তবে কাহার পার্শ্বে দাঁড়াইতেছেন এই ‘বিদ্বজ্জন’রা? কাহার বিরোধিতা করিতেছেন? সারদা কাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত হউক, দোষীদের শাস্তি হউক, ইহা কি তাঁহাদের কাম্য নহে? না কি, দলীয় তালগাছে এক বার হাঁড়ি বাঁধিয়া ফেলিলে স্বমতে, স্বপথে চলিবার আর কোনও উপায় থাকে না?

তবে, মিছিলকারীরা পুত্তলিকা মাত্র। সকলই তাঁহারই ইচ্ছা। সিবিআই, এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট ইত্যাদির উপর বঙ্গেশ্বরী বেমক্কা চটিয়াছেন। সংস্থাগুলিকে বহিরাগত জ্ঞান করিতেছেন কি না, এখনও বলেন নাই। তবে, খাগড়াগড়ে র-এর হাত যিনি দেখিতে পাইয়াছেন, তাঁহার পক্ষে কিছুই অসম্ভব নহে। সারদা বা অন্য ভুঁইফোঁড় আর্থিক সংস্থার সব রহস্য ফাঁস হইয়া গেলে তাঁহার কী ক্ষতি, দুর্জনে এত দিন যাহা বলিতেছে, তাহার মধ্যে সত্যের ভাগ কতখানি, এই প্রশ্নগুলি আপাতত উহ্য থাকুক। তিনি এই রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান, পুলিশমন্ত্রীও বটে। তাঁহার পুলিশ, অন্তত খাতায়-কলমে, এখনও তদন্তের কাজে কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিকে সাহায্য করিতেছে। কথাটি শুনিলে সিজিও কমপ্লেক্সে অট্টহাস্যের রোল উঠিবে, কিন্তু খাতায়-কলমে যাহা সত্য, তাহাকে অস্বীকার করা চলে না। এই পুলিশি সহযোগিতা নিশ্চয় পুলিশমন্ত্রীর অনুমতি ভিন্ন হইতেছে না। অর্থাৎ বলিলে বোধহয় ভুল হইবে না যে, প্রশাসনিক প্রধান হিসাবে তিনি যে তদন্তে, অন্তত খাতায়-কলমে, সহযোগিতা করিতেছেন, রাজনীতিক রূপে সেই তদন্তেরই বিরোধিতা করিতেছেন। নিজেই নিজের বিরোধী হওয়া বুঝি শুধু তাঁহার পক্ষেই সম্ভব। সিজিও কমপ্লেক্সের সম্মুখে আইনমন্ত্রীর বেআইনি ধর্নায় যাহার সূচনা, তাহা বুদ্ধিজীবীদের মিছিল অবধি গড়াইয়াছে। কুনাট্য রঙ্গ আর অলীক নহে, কঠোরতম বাস্তব।

অন্য বিষয়গুলি:

editorial anandabazar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy