সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি রাধাকৃষ্ণন ও সিকরির ডিভিশন বেঞ্চ সম্প্রতি ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’-এর স্বীকৃতি দিয়েছে। স্বভাবতই এই রায় দেশ জুড়ে অভিনন্দিত হয়েছে। কিন্তু ‘প্রকৃতিবিরোধী’ যৌনাচরণকে অপরাধ বলে গণ্য করার প্রচলিত আইন (ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা) ‘সংবিধানবিরোধী নয়’— এই মর্মে গত ডিসেম্বর মাসে সর্বোচ্চ আদালত যে রায়টি দিয়েছিলেন, তা নিয়ে বিচারপতি রাধাকৃষ্ণন ও সিকরি কোনও প্রশ্ন তোলেননি। বস্তুত, তাঁরা জানিয়েছেন, ‘এই আদালতের একটি ডিভিশন বেঞ্চ সুরেশ কুমার কৌশল বনাম নাজ ফাউন্ডেশন মামলায় ৩৭৭ ধারার সাংবিধানিকতা নিয়ে বলেছে, সে জন্য আমরা সে বিষয়ে কোনও মতামত দিচ্ছি না, কারণ এই ক্ষেত্রে আমরা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বিষয়— রূপান্তরিত জনগোষ্ঠীর সাংবিধানিক ও অন্যান্য আইনি অধিকার এবং তাঁদের লিঙ্গপরিচয় (জেন্ডার আইডেন্টিটি) ও যৌন প্রবণতা (সেকশুয়াল ওরিয়েন্টেশন)— নিয়ে ভাবিত।’
বিচারপতিদের অভিমতের যৌক্তিকতা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করার পরেও একটি প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা যাঁরা ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ’ বা ‘অস্বাভাবিক যৌনাচারে লিপ্ত’, তাঁদের জন্য। এখন, ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠী হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের তালিকায় হিজড়া, আরাবাণী, শিবশক্তি বা অন্যান্য যে সব গোষ্ঠীর মানুষদের কথা বলা হয়েছে, তাঁদের অনেকের পক্ষে একমাত্র ‘পেনিট্রেটিভ সেক্স’ হবে অ্যানাল বা ওরাল সেক্স। তেমন যৌনাচরণ তো ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারার অন্তর্ভুক্ত, তাই ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ’ এবং ‘অস্বাভাবিক’। সে ক্ষেত্রে তো সংশ্লিষ্ট যুগলটি অপরাধী বলেই গণ্য হবেন! সুতরাং, ৩৭৭ ধারা বজায় থাকলে এই গোষ্ঠীর মানুষরা তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে আইনি স্বীকৃতি পেলেও স্বাধীনতা, স্বাতন্ত্র্য, সম্মান, গোপনীয়তা নিয়ে জীবনযাপন করতে পারবেন কি? মহামান্য আদালত আচরণ (কনডাক্ট) ও পরিচয়কে (আইডেনটিটি) আলাদা বিষয় রূপে দেখছেন। কিন্তু সেটা কি সম্ভব? বিধেয়? তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অনেকের লিঙ্গপরিচয়ই তো তাঁদের যৌনাচরণ। শুধু যৌনাঙ্গ, পোশাক বা আচরণ নির্ধারণের স্বাধীনতাই কি তৃতীয় লিঙ্গের প্রাপ্য? যৌনাচরণের স্বাধীনতা তাঁদের প্রাপ্য নয়?
লক্ষণীয়, এই রায় সংবিধানের ১৪, ১৫(২), ১৬, ১৯(১) (এ), ২১ ধারাগুলিকে এক প্রসারিত ব্যাখ্যা দিয়েছে, যেগুলি আইনের চোখে সমতা, বৈষম্যহীনতা, বাক্স্বাধীনতা, সরকারি চাকরিতে সমসুযোগ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, স্বাতন্ত্র্যের অধিকার— এই সবগুলিকে সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু সংবিধানের যে ১৯(১)(এ) ধারা পরিচয়ের স্বাতন্ত্রকে রক্ষা করে, ৩৭৭ ধারার কারণে তা লঙ্ঘিত হয় না কি? আবার যদি ট্রান্সজেন্ডার মানুষের লিঙ্গপরিচয় আর যৌনাচরণকে সমার্থক বলে ধরি, তা হলে তো এই রায় সংবিধানের ১৪ আর ১৫ ধারাকে মানছে না, যেগুলি বলছে আইনের চোখে সমতা আর বৈষম্যহীনতার কথা। এই দ্বন্দ্ব নিরসন হবে কী ভাবে?
বিচারপতি রাধাকৃষ্ণন এই রায়ে ‘জেন্ডার আইডেন্টিটি অ্যান্ড সেকশুয়াল ওরিয়েন্টেশন’ (লিঙ্গপরিচয় ও যৌন প্রবণতা) নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। বলেছেন, কোনও মানুষের ব্যক্তিপরিচয়ের সবচেয়ে গভীরে থাকে তাঁর লিঙ্গপরিচয়। তিনি সেটি নানা ভাবে প্রকাশ করতে পারেন— হাবভাব, কথাবার্তা, শরীরী ভঙ্গি, পোশাক-আসাক ইত্যাদি। তিনি স্বীকার করছেন, আমাদের সমাজে নারী আর পুরুষ, এই দুই বিভাজনের বাইরে ভাবা হয় না— যেটাকে দ্বৈততার সীমাবদ্ধতা বলা যেতে পারে। এই প্রেক্ষিতেই অনেকে নিজেদের লিঙ্গপরিচয় নিয়ে দ্বন্দ্বে থাকেন। শরীরের দিক থেকে যিনি নারী বলে গণ্য, তাঁর ভাবনা বা পছন্দগুলি যেন, সমাজ বা বলে, সেই মাপকাঠিতে ঠিক নারীসুলভ নয়; কিংবা যিনি পুরুষ, তিনিও যেন ঠিক পুরুষালি নন। তিনি ঠিক কী, তা নিয়ে তিনি নিজেই নিশ্চিত নন।
সেই সঙ্গে আছেন তাঁরা, যাঁরা রূপান্তরিত হয়েছেন বা হতে চান, বা এমনকী যাঁরা রূপান্তরের কথা ভাবেন না, শুধু তাঁদের সমাজনির্দিষ্ট নারী বা পুরুষ এই পরিচয়ের খোপে আটকে থাকতে রাজি নন। তাঁরা সবাই জীবনের নানা ক্ষেত্রে প্রচুর সমস্যায় পড়েন, তাঁদের অধিকার নিয়ত লঙ্ঘিত হয়। তাঁদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি। বিচারপতি রাধাকৃষ্ণন রায়ে লিখছেন যে, তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে আইনি স্বীকৃতি এই রকম ধোঁয়াশা কাটানোর জন্যই প্রয়োজন, যাতে তাঁরা পরিচয়পত্র, স্বাস্থ্য পরিষেবার মতো মৌলিক পরিষেবা পাওয়া, ভোটদান, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, উত্তরাধিকার, শিক্ষা, বিয়ে, দত্তক গ্রহণ— এ সব কিছুতে সক্ষম ও সমান নাগরিক হয়ে উঠতে পারেন। ভারতীয় দণ্ডবিধিতে এই দ্বৈততার স্বীকৃতি নেই, বা কল্যাণমূলক প্রকল্পে (যেমন ১০০ দিনের কাজে) তাঁরা সুযোগ পান না। এই সব সুযোগ হয়তো এর পর তাঁদের কাছে কিছুটা সুলভ হবে, অন্তত তার আইনি বাধা কমবে।
কিন্তু এই রায়ের পরেও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা পাবেন না কোনও পেনিট্রেটিভ সেক্সের অধিকার, তা হলেই মাথার ওপর নেমে আসতে পারে ৩৭৭ ধারা! বিয়ের পরে অথবা বিয়ে না করেও যে মানুষ— নারী এবং পুরুষ— আনন্দের জন্যই শরীরী সম্পর্কে আবদ্ধ হতে পারেন, সে কথা স্বীকার করতে আমাদের মধ্যে এক অদ্ভুত ছুঁতমার্গ কাজ করে। এই রায় সেই মনোভাবকেই আবার জোরদার করবে না তো? দু’টি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ, তাঁরা অন্য কাউকে বিরক্ত না করে নিজেদের মতো শরীরী সম্পর্কে আবদ্ধ হতে পারেন, তার স্বীকৃতি দিতে হলে ৩৭৭ ধারাকে অসাংবিধানিক বলে মানতে হয়। তাই কি এই রায় তৃতীয় লিঙ্গের অস্তিত্ব স্বীকার করছে তাঁদের শরীরটুকু বাদ দিয়ে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy