গণতন্ত্রের জন্য। আফগানিস্তান, মার্চ, ২০১৪। ছবি: লেখক।
ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে আফগানিস্তান। এই প্রথম এখানে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতার হস্তান্তর হতে চলেছে। শনিবার, ৫ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোট হবে, যদিও হয়তো গণনার পরে জানা যাবে না, হামিদ কারজাইয়ের পরে কে নতুন প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন। কারণ আফগান সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনে জিততে হলে কোনও এক প্রার্থীকে যত ভোট পড়েছে তার ৫০ শতাংশের বেশি পেতে হবে। নিয়ম হল, কোনও প্রার্থী ওই সংখ্যক ভোট না পেলে যে দুজন তালিকায় সবার ওপরে থাকবেন শুধু তাঁদের ভিতর দ্বিতীয় দফার প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে, যাকে বলে ‘রান অফ’। যেহেতু এ বারের নির্বাচনে এখনও পর্যন্ত প্রার্থী সংখ্যা দশ, এবং কোনও খুব বড় মাপের নেতা নেই, তাই এটা প্রায় নিশ্চিত যে এই নির্বাচন দ্বিতীয় রাউন্ড-এ যেতে চলেছে, যা হয়তো মে মাসের শেষে হবে।
আর এই নির্বাচন হতে চলেছে এমন একটা সময় যখন এই দেশে উপস্থিত নেটো বাহিনী ২০১৪ সালের শেষে তাদের ১৩ বছরের উপস্থিতি গুটিয়ে চলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই ১৩ বছরে মূলত আমেরিকার নেতৃত্বাধীন এই নেটো বাহিনী দেশের নিরাপত্তার কিছুটা দায়িত্ব নেওয়া ছাড়াও রাষ্ট্রপুঞ্জের সাহায্যে নানান প্রশাসনিক ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গঠনের কাজে সাহায্য করেছে। এর ভিতর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ছিল একটি সুসজ্জিত আফগান নিরাপত্তা বাহিনী— সেনা ও সশস্ত্র পুলিশ— গঠন করা, যাতে আফগানরা নিজেরা নিজেদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে পারে। এই কাজে তারা এখনও পর্যন্ত আংশিক সফল।
এই গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন ওঠে, আফগানিস্তানের গত তেরো বছরের বাস্তব চেহারাটা কী? গত বারো বছর ধরে আফগানিস্তানে নিয়মিত যাতায়াত করছি। গত প্রায় এক মাস ধরে এখানে আছি, নির্বাচনী প্রচার ও প্রক্রিয়া দেখছি। তার ভিত্তিতেই এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার একটা চেষ্টা করব।
২০০৪ সালে প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় দেখেছিলাম এক অপূর্ব উন্মাদনা। সাধারণ মানুষ উৎসবের মেজাজে বিপুল সংখ্যায় ভোট বুথে ভিড় জমিয়েছিলেন। সদ্য পরাজিত তালিবান তখন পাকিস্তানের জনজাতি এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে। তারা অনেক হুমকি দিলেও খুব বেশি হামলা চালাতে পারেনি। ২০০৪ আর ২০১৪ সালের ভিতর প্রধান তফাত হল, তালিবান এখন অনেক বেশি শক্তিশালী, নির্বাচনী প্রচার শুরু হওয়ার পর থেকে প্রায় প্রতি সপ্তাহে কাবুল সহ দেশের নানান জায়গায় আত্মঘাতী আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও আফগান জনগণ যে সংখ্যায় এই সব প্রচারসভায় অংশগ্রহণ করছেন তা কল্পনাতীত। গত কয়েক সপ্তাহে কয়েকটি সভায় গিয়েছি। যাঁরা এই সভায় আসছেন তাঁরা জানেন, যে তালিবানের পক্ষে এমন একটি প্রকাশ্য জমায়েতে বোমা হামলা খুব সহজ। তবু তাঁরা ভীত নন, তাঁদের মধ্যে সেই ২০০৪ সালের উন্মাদনা দেখছি।
এটা যে শুধু দেশের অপেক্ষাকৃত নিরাপদ এলাকাগুলিতে হচ্ছে, তা নয়। দেশের দক্ষিণে, মানে কন্দহর বা হেলমন্দ, যেখানে তালিবানের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য, সেখানেও হাজার হাজার মানুষ বেরিয়ে আসছেন। কারজাই সরকারের প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী ও এই নির্বাচনের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী জালমে রসুলের হেলমন্দ ও কন্দহরের তিনটি সভায় থাকা এক আফগান সাংবাদিকের ভাষ্য অনুযায়ী প্রতিটি সভায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার মানুষ অংশ নিয়েছিলেন। তার টিভি রিপোর্টে সেই বিপুল জমায়েতের ছবি দেখেছি। যখন এই জমায়েত হচ্ছে, হেলমন্দ প্রদেশেরই আর এক অংশে আফগান বাহিনী তালিবানের সঙ্গে লড়াই করছে। একই ভাবে দেশের নানান জায়গায় অপর দুই প্রধান প্রার্থী প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী আশরাফ গনি আর প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী আব্দুল্লাহ আব্দুল্লাহর সভায় বিপুল জনসমাগমের ছবি দেখেছি।
৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে আশরাফ গনির একটি প্রচার সভা ছিল শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য। সেই সভায় অন্তত তিন হাজারের বেশি মহিলার উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করেছি। তাঁদের ভিতর অনেকেই প্রথম বার ভোট দেবেন। আফগানিস্তানের মতো অতি সংরক্ষণশীল সমাজের হাজার বছরের শত বাধানিষেধ সত্ত্বেও এই যে কয়েক হাজার মহিলা— তরুণী, মধ্যবয়সি ও বৃদ্ধা— একটি নির্বাচনী সভায় যোগ দিচ্ছেন তা, যতই ধীর হোক না কেন, কিছু পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করছে।
গত তেরো বছরে আফগানিস্তানের অন্যতম অগ্রগতি হল স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের প্রসার। ফারসি আর পশ্তু ভাষায় রেডিয়ো ও টিভি এখন প্রতিটি ঘরে ঢুকেছে। এই সময়ের ভিতর আমি একটি তরুণ স্বাধীনচেতা, নির্ভীক সাংবাদিক প্রজন্মের উত্থান চাক্ষুষ করেছি। এদের অনেকেই আমার সহকর্মী বা এদের অনেককেই আমার হাতেকলমে প্রশিক্ষণ দেওয়ার সুযোগ হয়েছে। এই প্রজন্ম অকুতোভয়ে তাদের পেশার মাধ্যমে গণতন্ত্রের নির্যাস আফগান ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে। রেডিয়ো, টিভিতে আলোচনা শুনলে বা রাস্তাঘাটে লোকজনের সঙ্গে কথা বললেই বোঝা যায় যে, তালিবানের হুমকি সত্ত্বেও তাঁরা ভোট দেওয়ার জন্য মুখিয়ে আছেন।
কয়েক দিন আগে ভোটার কার্ড করানোর একটি কেন্দ্রে গিয়ে দেখি কয়েকশো মানুষ— পুরুষ ও মহিলা— কয়েক ঘণ্টা ধরে লাইন করে অপেক্ষা করছেন, ভোট দেওয়ার অধিকার অর্জন করার জন্য। ষাটোর্ধ্ব এক মহিলা নাকি চার দিন ধরে আসছেন কার্ড করাতে। কিন্তু তখনও তাঁর কার্ড করানো হয়নি। শেষ পর্যন্ত তিনি এক কর্মকর্তাকে পাকড়াও করে উত্তেজিত ভাবে আমাদের সামনেই বেশ দু’চার কথা শুনিয়ে দিলেন। সেই মহিলাকে দেখে আরও পুরুষ মহিলা এগিয়ে এসে চরম অব্যবস্থার কথা বলতে থাকলেন। উত্তেজনা থাকলেও সবাই ধৈর্য ধরে লাইন দিচ্ছেন ভোটের কার্ড করাতে। এই অভিজ্ঞতা একটাই জিনিস প্রমাণ করে— অস্ত্র ছেড়ে শান্তিপূর্ণ ভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের মূল্যবোধটি তাঁদের গভীরে ঢুকে গেছে।
গত কয়েক দিনের ভিতর কাবুল শহরে তালিবান দুটি বড় হামলা চালিয়েছে; প্রথমটি হল শহরের একমাত্র পাঁচতারা হোটেল সেরিনার ওপর আর দ্বিতীয়টি নির্বাচন কমিশনের একটি দফতরে। সেরিনার হামলাটি হয় এখানকার নববর্ষ বা নওরোজের আগের রাতে। তার পরের দিন সকালে শহরের মাঝে অবস্থিত হজরত আলি মাজারে নওরোজের উৎসবে গেছি। আগের রাতের হামলার খবর তখন গোটা শহরে ছড়িয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও হাজার হাজার মানুষ এসেছেন নতুন বছর বরণ করতে, নতুন পোশাক পরে। রমরমা বিক্রিবাটা শৌখিন জিনিসপত্র আর খাবারদাবারের।
আর একই সঙ্গে আছেন সেখানে কয়েক ডজন আফগান ও জনাকয়েক বিদেশি সাংবাদিক। এমন সময় খবর এল, আগের রাতের সেরিনার হামলায় এক অতি পরিচিত তরুণ সাংবাদিক, তার স্ত্রী ও দুই শিশু নিহত হয়েছে। উৎসবে উপস্থিত আফগান সাংবাদিকদের বন্ধুবিয়োগের কষ্ট আর তালিবানের প্রতি ক্রোধ একসঙ্গে বেরিয়ে এল। কিন্তু তাঁরা পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ শেষ করলেন। আগের রাতের হামলা উৎসবের মেজাজকে বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ণ করতে পারল না। নির্বাচন কমিশনের একটি দফতরে হামলা হল সকালে, সে দিনও সন্ধ্যায় শহরের ভিতর দিয়ে যেতে গিয়ে দেখেছি, রেস্টুরেন্ট ও হোটেলে লোকজন কাবাব-রুটি খাচ্ছে; দোকানপাট খোলা, মানুষ বাজার করছে; অফিস-ফেরতা কর্মীরা রাস্তার মোড়ে ভিড় করেছেন ট্যাক্সির জন্য।
আফগানিস্তানে তালিবানের উপস্থিতি একটা বাস্তব সত্য। তিলে তিলে নতুন করে গড়ে উঠছে, এমন একটি দেশের পক্ষে সেটা বড় দুশ্চিন্তার কারণ। কিন্তু ১৯৯২ সালে কমিউনিস্ট সরকারের পতনের পর মুজাহিদিন গোষ্ঠীগুলির ক্ষমতার লড়াইয়ের ফলে গৃহযুদ্ধ ও চূড়ান্ত অরাজকতার যে পরিস্থিতিতে তালিবানের উত্থান হয়েছিল, তা এখন আর নেই। সেই পরিস্থিতিতে সাধারণ আফগানরা তালিবানকে সমর্থন করেছিল গৃহযুদ্ধ এড়াতে। কিন্তু তালিবানের অতি বর্বর শাসনকাল তাদের অচিরেই তালিবান-বিরোধী করে তোলে। তালিবানের প্রতি সেই গভীর বিতৃষ্ণা এখনও বিদ্যমান। একই সঙ্গে, সাধারণ আফগানরা নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার একটা দিশা পেয়েছেন। সমাজে এখন তার ইঙ্গিত সব স্তরেই। তাই তালিবান তাদের ভিতর সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে চাইলেও সাধারণ মানুষ খুব সন্ত্রস্ত, এমন কোনও আভাস নেই। মানুষ আতঙ্কের গণ্ডি পার হয়েছে, তাই নির্বাচনী সভায় এত ভিড়; সন্ত্রাসী হামলা সত্ত্বেও মানুষ তালিবানকে অগ্রাহ্য করার সাহস দেখাতে পারছে।
এক দিকে, ১৯৯০-এর দশকের যে সব নেতা গৃহযুদ্ধের হোতা ছিলেন, তাঁরাও এখন জনগণের কাছে ভোট চাইতে আসছেন। জনগণ তাঁদের ভোট না দিলে তাঁরা ফের অস্ত্র ধরবেন এমন কোনও ইশারা এখনও পর্যন্ত নেই। অন্য দিকে, হাজারে হাজারে তরুণতরুণী শিক্ষার ভিতর দিয়ে দেশের ভবিষ্যতের ভার নিজেদের কাঁধে তুলে নিতে উদ্যোগী। কাবুল, হেরাত, মাজার-এ-শরিফ— প্রতিটি শহরেই বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দেখেছি ৩০-৪০ হাজার ছাত্রছাত্রীর উপস্থিতিতে ক্যাম্পাস গমগম করছে।
গত তেরো বছরে সামাজিক আর মানসিক স্তরে এই সব গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে আফগান সমাজে। আর এই প্রেক্ষাপটেই আশরাফ গনি বা জালমে রসুল বা আব্দুল্লাহ আব্দুল্লাহর ভিতর কেউ এক জন আগামী দু’মাসের ভিতর নতুন প্রেসিডেন্ট হবেন। যিনিই জয়ী হন, তাঁর সামনে সমাজ ও দেশ গড়ার বিশাল চ্যালেঞ্জ থাকবে। কিন্তু যে প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে তিনি ক্ষমতায় আসবেন, সেটি এই দেশের ভবিষ্যতের সবচেয়ে শক্তিশালী খুঁটি হয়ে উঠবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy