আরএসএস-এর সহিত সম্পর্কিত একটি সংগঠন আয়োজিত এক শিক্ষা-বিষয়ক অনুষ্ঠানে স্মৃতি ইরানি কহিলেন, ‘আজ সরস্বতী পূজা। সরস্বতী প্রতিটি পরিবারকে আশীর্বাদ করেন যে, তাহারা যাহা বলিবে তাহা প্রগতির পক্ষে যাইবে এবং জাতিকে শক্তিশালী করিবে। ভারতমাতার প্রশস্তি করা হউক। জাতি কখনওই ভারত মা’র প্রতি অপমান সহ্য করিবে না।’ ইঙ্গিতটি জেএনইউ-তে ঘটিয়া যাওয়া সাম্প্রতিক ঘটনার দিকে। কিন্তু সরস্বতীর এই কথায় গভীর আপত্তি থাকিতে পারে। সরস্বতী বাগ্দেবী। যে লোকটি বাক্স্বাধীনতা খর্ব করার পক্ষে সওয়াল করে, সে সরস্বতীকে সর্বাধিক অপমান করে। এক মা’কে অপমান করিয়া অন্য মা’কে তৃপ্ত করিবার অভ্যাস সুবিধার নহে। কিছু মানুষ তাহাদের মতামত ব্যক্ত করিয়াছে, এবং সেই মতামত প্রশাসনের কিছু মানুষের অপছন্দ হইয়াছে বলিয়া যদি কাহাকেও জেলে ভরিয়া দেওয়া দস্তুর হইয়া যায়, তবে সেই কার্যের গর্বে যাঁহারা ফুলিতেছেন, তাঁহারা সরস্বতীকে, শিক্ষাকে, ভাবনার বিস্তারকে প্রবল সম্মান করিতেছেন বলিয়া তো মনে হয় না। আসলে, যে কোনও তর্কে ‘মা’ শব্দটি ফট করিয়া উচ্চারণ করিয়া ফেলিবার কিছু সুবিধা রহিয়াছে। প্রসঙ্গটি মুহূর্তে যুক্তি হইতে আবেগের দিকে হেলিয়া পড়ে। প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় শ্রোতা দর্শক পাঠকের মনেও সেই উত্তেজনা সঞ্চারিত হইয়া যায়। কেহই যুক্তি দিয়া এই উচ্ছ্বাসতরঙ্গ রোধিবার বড় একটা সাহস করেন না, কারণ মাতৃবন্দনা প্রায় তর্কাতীত রূপে শ্রেয় বলিয়া প্রতিষ্ঠিত। এবং এক বার হিস্টিরিয়া লাগাইয়া দিতে পারিলে, যুক্তিবাদীর প্রশ্নরাজি ক্রমশই চতুর্দিকের কোলাহলে ঢাকা পড়িয়া যায়।
কিন্তু আরও একটি কথা আছে। সরস্বতীর সহিত ভারতমাতাকে মিলাইয়া দিবার মধ্যে এই প্রকার ইঙ্গিত ঝলক দিয়া যায়: ভারতমাতা মূলত এক হিন্দু দেবী। বা, হিন্দুদের মাতা। তাহা না হইলে, হিন্দু দেবী সরস্বতী কেন জাতিকে শক্তিশালী করা লইয়া আদৌ মাথা ঘামাইবেন? তাঁহার দফতর পড়াশুনা। তিনি যখন দেশপ্রেম শিখাইতে বসিবেন, তখন বুঝা যাইবে, সহোদরার হইয়া সওয়াল করিতেছেন। কোনও মন্ত্রী মনে করিতেই পারেন, দেশপ্রেম নাগরিকের অবশ্যকর্তব্য। কিন্তু তাহা এক নির্দিষ্ট ধর্মের দেবীর পূজার দিন বিশেষ করিয়া মনে করাইয়া দিবার অর্থ হইল, দেশটি মূলত এই ধর্মাবলম্বীদেরই। উনি ভুলিয়া গিয়াছেন, সরস্বতী কে বা কেন, তাহা জানিবার দায় ভারতের বহু মানুষেরই নাই। দেশপ্রেম যদি নাগরিকের হৃদয়ে জাগ্রত হয়, তাহা হইলে এই দেবীর পূজা না করিয়াও জাগ্রত হইতে পারে। কেহ বলিতে পারেন, স্মৃতি তো গিয়াছিলেন এক হিন্দু সংগঠনের সভায়, তাই এই দেবীর প্রসঙ্গ টানিয়াছেন। সেই অভ্যাসটি আরও মারাত্মক। যখন যে ধর্মাবলম্বীদের সভায় যাইতেছি, তখন সেই ধর্মের অনুষঙ্গ ধরিয়া দেশপ্রেম প্রচার করিতেছি, এই প্রবণতা এক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের মন্ত্রীর পক্ষে অতি বিসদৃশ। ইহা আপাতদৃষ্টিতে স্বাভাবিক, এবং সেই কারণেই আরও বিপজ্জনক। এই দেশে বহু ধর্ম রহিয়াছে, কিন্তু কথায় কথায় ধর্মকে টানিয়া জঙ্গি আবেগ গজাইয়া তুলিবার অভ্যাস এই দেশের ধর্মগোঁড়াদের আগ্রাসন-অনুকূল বায়ু সৃষ্টি করিবে। নেতানেত্রীদের বরং দ্বিগুণ সতর্ক থাকিতে হইবে, কোনও বক্তৃতায় যেন অযথা ধর্মীয় অনুষঙ্গ না আসিয়া পড়ে, কোনও দেবদেবীর দোহাই দিয়া যেন বক্তব্যটিকে তীব্র করিবার তাড়না না জাগিয়া উঠে। যে হেতু সাধারণ মানুষের তুলনায় এক মন্ত্রীকে অধিক দায়িত্বশীল হইয়া কথা বলিতে হয়, যেহেতু তিনি হিন্দুদের মন্ত্রী নহেন, সকল সম্প্রদায়ের মানুষের, এমনকী হিন্দুদের মধ্যেও যাঁহারা নাস্তিক রহিয়াছেন, তাঁহাদেরও মন্ত্রী, এবং প্রত্যেকের শুভবিধানের জন্য সমান ভাবে তাঁহাকে কাজ করিয়া যাইতে হইবে, সেই হেতু, এক হিন্দু দেবীর আঁচল ধরিয়া দেশপ্রেমের পাঠ দেওয়া তাঁহার পক্ষে অশিক্ষাময় কর্ম হইয়াছে। সরস্বতীর প্রকৃত পূজার পাঠ ইঁহার বাকি রহিয়া গিয়াছে।
য ৎ কি ঞ্চি ৎ
এক হিন্দু সংগঠন ভ্যালেন্টাইন’স ডে-র দিনে ‘মাতৃ-পিতৃ পূজন দিবস’ পালনের ডাক দিল। মানে, দিন যদি পালন করতেই হয়, বাবা-মা’র সম্মানে করো। তা, সেই প্রণামকার্য ১৫ বা ২৩ তারিখে করলেও তো হয়। ১৪-তে একটা উৎসব, ফের ক’দিন পর আর একটা। তা ছাড়া, বাবা-মা’র প্রণয়মূলক কাণ্ডের ফলেই সন্তান জন্মেছে, এমন একটা অনুমান বহুলপ্রচলিত। ভ্যালেন্টাইন’স ডে-র এই অবমাননায় কি তাঁদের সেই সম্পর্ককেও ঘুরিয়ে কান মলে দেওয়া হল না?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy