Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪
প্রবন্ধ ২

অন্তত এক জন বললেন, ‘পারব’

লোকসভা-বিধানসভা-পঞ্চায়েত মিলিয়ে বহু বার ভোটের ডিউটি করে এই অভিজ্ঞতা হয়নি। পশ্চিমবঙ্গে এ বারের নির্বাচন ছিল সত্যিই অন্য রকম। লিখছেন সহিষ্ণু দাশগুপ্ত।বুথের ভিতর তখন প্রবল চেঁচামেচি। মহিলা কোনও ওজর-আপত্তি শুনতে রাজি নন, আর বিরোধী পক্ষের এজেন্টকে আঙুল তুলে শাসাচ্ছে তার স্বামী। মহিলার বক্তব্য, তাঁর ভোটটা তাঁর স্বামী দিয়ে দেবেন।

শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

বুথের ভিতর তখন প্রবল চেঁচামেচি। মহিলা কোনও ওজর-আপত্তি শুনতে রাজি নন, আর বিরোধী পক্ষের এজেন্টকে আঙুল তুলে শাসাচ্ছে তার স্বামী। মহিলার বক্তব্য, তাঁর ভোটটা তাঁর স্বামী দিয়ে দেবেন। ভোট পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মী হিসেবে তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, নির্বাচন কমিশনের আইন মোতাবেক কেবল অন্ধ-অশক্ত ভোটারের হয়েই তাঁর কোনও সঙ্গী ভোট দিতে পারে। মারমুখো হয়ে উঠল লোকটি, ‘আমার বউয়ের ভোট আমি দেব না তো কে দেবে? ওকে খাওয়াই-পরাই আমি। আমিই ওর জানপ্রাণের মালিক’।

চার দিকে ধু-ধু মাছের ভেড়ির মাঝে মাঝে ছড়ানো ছিটানো গ্রামগুলো। বুথের ভোটার সংখ্যা হাজারের কিছু বেশি। এ রকম প্রত্যন্ত এলাকায় আগেও একাধিক বার ভোট করিয়ে এসেছি। তার মধ্যে পঞ্চায়েত ভোটও ছিল, যেখানে প্রত্যেক ভোটারকে তিনটি করে ভোট দিতে হয়েছে। তবু সেখানেও তো কোনও মহিলার মুখে এ রকম দাবি শুনতে পাইনি।

সন্দেহটা অবশ্য জেগেছিল ভোট শুরুর অল্প কিছু ক্ষণ পর থেকেই। অভিজ্ঞতা থেকে জানা ছিল, প্রত্যেক ভোটকেন্দ্রেই কিছু একেবারেই অক্ষম বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা ভোটার থাকেন যাঁর হয়ে তাঁর কোনও আত্মীয় ভোট দিয়ে দেন। এর জন্য অবশ্য নির্বাচনের তরফে দেওয়া ‘ডিক্লারেশন’-এ সেই সঙ্গীর নাম-ঠিকানাসহ স্বাক্ষর নিয়ে নিতে হয়। কিন্তু এ দিন ভোট শুরুর পর থেকেই দেখা গেল অনেক বৃদ্ধবৃদ্ধাকে নিয়ে তাঁদের সঙ্গীরা হাজির হচ্ছে, আর প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিরোধী পক্ষের এজেন্ট প্রবল আপত্তি তুলছে। আপত্তির কারণ, উক্ত সঙ্গীরা কেউই ভোটারের ছেলে, মেয়ে বা স্বামী নয়, নেহাতই গ্রামের লোক। বার বার বুথের ভিতর এই ঝামেলা মেটাতে কাগজপত্র ফেলে হস্তক্ষেপ করতে হচ্ছিল। আর প্রতি বারই অশক্ত ভোটারের হয়ে ভোট দিতে আসা সঙ্গীর মুখে একটাই হুমকি শোনা যাচ্ছিল, ‘বেশি আইন দেখাবেন না।’ ভোটারের যদি আপত্তি না থাকে, আপনি আপত্তি করার কে?’ বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম যে, আপত্তিটা আমার নয়, বিরোধী পক্ষের এজেন্টের। সপাটে উত্তর আসছিল, ‘বিরোধী পক্ষ তো আপত্তি করবেই। ও নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আপনি আপনার কাজ করুন।’

তখনও বুঝিনি, সবে কলির সন্ধে। কিছুক্ষণ পরেই হাজির হলেন সেই মহিলা, যাঁর কথা এই লেখার একেবারে প্রথমে উল্লেখ করেছি। অনেক কষ্টে তাঁকে বুঝিয়েবাঝিয়ে ভোটকক্ষের দিকে ঠেলে পাঠানো হল, আর তাঁর স্বামী বাইরে দাঁড়িয়ে গজরাতে লাগল। মহিলা কিন্তু ভিতরে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। অনেক ক্ষণ পরেও বোতাম টেপার শব্দ না উদ্বিগ্ন হয়ে গলা তুলে বললাম, ‘কী হল, ভোটটা দিন’। ভিতর থেকে জবাব এল, ‘আমার ভয় করছে। আমি মেশিনে হাত দেব না। ওরা বলেছে, মেশিনে হাত দিলে কারেন্ট মারবে।’ মুহূূর্তে ছবিটা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। কোনও ভাবে এই গুজব চাউর করে দেওয়া হয়েছে যে ইভিএম-এ হাত দিলে ইলেকট্রিক শক লাগতে পারে!

এ দিকে সময় বয়ে যাচ্ছে। বাইরে প্রবল রোদে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভোটারের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে। উড়ে আসছে নানা কটু মন্তব্য। এক সময় বাধ্য হয়েই বিরোধী পক্ষের এজেন্টকে বললাম, ‘দাদা, আর আপত্তি করবেন না। ওঁর স্বামীকে ভোটটা দিয়ে দিতে দিন। এর নামে ইভিএম-এ ব্যালট ইস্যু হয়ে গেছে। ভোট না পড়লে পরে আমি হিসেব মেলাতে পারব না’। এজেন্ট অগত্যা ঘাড় নাড়তেই ভদ্রলোক দৌড়ে গিয়ে বোতামটা টিপে দিলেন। দীর্ঘ বিপ শব্দে একটি মহামূল্যবান ভোট নথিবদ্ধ হল।

এর পর গড়ে প্রতি পাঁচ জন মহিলা ভোটারের এক জন আসতে শুরু করলেন তাঁদের ‘স্বামী’কে সঙ্গে করে। প্রথম জনকে সুযোগ দিয়ে যে দরজাটা খুলে দেওয়া হয়েছিল, আর সেটা বন্ধ করার উপায় রইল না। বিরোধী পক্ষের এজেন্টের গলা স্তিমিত হয়ে এল।

স্বামী-সহযোগে-মহিলা পর্ব মিটতে না মিটতেই শুরু হল ‘নতুন মহিলা ভোটার’-এর সঙ্গী হিসেবে ভোট দেবার দাবি। লোকসভা-বিধানসভা-পঞ্চায়েত মিলিয়ে বহু বার ভোটের ডিউটি করেছি, কিন্তু এমন দাবি কোথাও শুনিনি যে, সদ্য আঠারো পেরোনো নতুন মহিলা ভোটারের ‘ভয় ভাঙানোর জন্য’ সঙ্গে কাউকে ভোটিং কম্পার্টমেন্ট-এ যেতে দিতে হবে। বিরোধী পক্ষের এজেন্টের কাছ থেকে আর কোনও আপত্তি আসছিল না, তবু নিজের বিবেকের তাড়নায় সঙ্গী নিয়ে আসা প্রত্যেক মহিলা ভোটারকেই এক বার করে জিজ্ঞাসা করে নিচ্ছিলাম, ‘আপনি কি নিজের ভোটটা দিতে পারবেন?’ সবাই মাথা নিচু করে থাকছিলেন। তাঁদের ফ্যাকাশে মুখগুলো দেখে কষ্ট হচ্ছিল, আর তাঁদের সঙ্গী হয়ে আসা যুবকদের রক্তচক্ষু দেখে বারবার হিম ঠান্ডা স্রোত নেমে যাচ্ছিল শিরদাঁড়া বেয়ে।

এরই মধ্যে একটা অন্য রকম ঘটনা ঘটল। দুপুর দুটো নাগাদ ভোট দিতে এসেছিলেন সেই মহিলা। পিছনে তাঁর হয়ে ভোট দেবার জন্য দাঁড়িয়ে এক জন পুরুষ। মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি তাঁর ভোটটা কি নিজে দিতে পারবেন? একটু চুপ করে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি, তার পর হঠাত্‌ মাথা তুলে সোজা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে পরিষ্কার এবং জোরালো গলায় বললেন, ‘পারব’। দেখলাম, তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটি মুহূর্তের মধ্যে কেমন কেঁচোর মতো গুটিয়ে গেল। মহিলা নিজের ভোট নিজে দিয়ে এলেন।

অন্য বিষয়গুলি:

post editorial sahishnu dasgupta
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy