শুভ জন্মদিন রাহুল গাঁধী… জনমদিন মুবারক… রাহুল গাঁধী, তুম অগে বঢ়ো, হাম তুমহারে সাথ হ্যায়— বড় কোনও অঘটন না ঘটলে, দিল্লির তুঘলক লেনের ১২ নম্বর বাংলোর সামনে আজ এমনই সব স্লোগান উঠবে। ভিড় করা কংগ্রেসের কর্মীদের জমায়েতে ঢোল-নাকাড়া বাজবে। রাহুল গাঁধীর ছবির মুখের সামনে মিঠাই ধরা হবে। লাড্ডু বিতরণ হবে। কর্মীরা নিজেরাই জন্মদিনের কেক কেটে একে অপরকে খাওয়াবেন।
লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের হারের ক্ষত এখনও টাটকা। তাতে কী ভাবে প্রলেপ পড়বে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। কংগ্রেসের নেতারাও অন্ধকারে। জাহাজের ক্যাপ্টেনই দিশা দেখাচ্ছেন না। তার মধ্যেও কংগ্রেস সভাপতির বাড়ির সামনে কর্মী-সমর্থকদের ভিড় দেখলে হয়তো নেতারা আশায় বুক বাঁধতে পারেন। কিন্তু তাঁরা নিজেরাও জানেন, এই জমায়েত কংগ্রেসের দলীয় সংগঠনের প্রতিফলন নয়। কংগ্রেসের সংগঠনে ঘুণ ধরেছে। অনেক দিন ধরেই। এবং তার শিকড় অনেক গভীরে। তারই প্রমাণ হল, এ বারের ভোটে দেশের ১৮টি রাজ্য, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল থেকে খালি হাতে ফিরেছে কংগ্রেস। কেরল ছাড়া আর কোনও রাজ্যে কংগ্রেসের আসন সংখ্যা দু’অঙ্কের ঘরে পৌঁছয়নি।
প্রচারের কৌশলে বিজেপি এবং নরেন্দ্র মোদী নিজে এ বারের লোকসভা ভোটের আগে ‘ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদী’কে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন, যাতে তাঁর সামনে রাহুল গাঁধী বা অন্য বিরোধী নেতাদের লিলিপুট দেখায়। বালাকোটে বায়ুসেনার হামলার পরে বিজেপি নেতারা, এমনকি নরেন্দ্র মোদী নিজেও একের পর এক জনসভায় এমন ভাবে বুক ঠুকেছেন, দেখে মনে হয়েছে, ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতি নিয়ে মোদী নিজেই ‘পাকিস্তানের ঘরে ঢুকে’ মার দিয়ে এসেছেন। ‘গরিবদরদি’ হিসেবেও মোদীকে তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে। বোঝানো হয়েছে, গোটা দেশে প্রধানমন্ত্রী পদের যোগ্য এক জনই। তিনি নরেন্দ্র মোদী।
ভুললে চলবে না, এই বার্তা ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করেছে বিজেপির দলীয় সংগঠন। যার ভিত তৈরি করেছে আরএসএস-সঙ্ঘ পরিবারের শাখার বিস্তৃত জাল। ঠান্ডা মাথায়, শীতল দৃষ্টি নিয়ে এ সবে কড়া নজর রেখেছেন অমিত শাহ। বুথকর্মী থেকে দলের সভাপতির পদে উঠে আসা অমিত শাহ জানেন, তিনি যে রণকৌশলই তৈরি করুন না কেন, তার বাস্তবায়নের জন্য সংগঠন দরকার। ভোটারদের সামনে নরেন্দ্র মোদীকে ‘অতিমানব’ হিসেবে তুলে ধরতে এক বার জনসভা করে এলেই হয় না। তা বিশ্বাস করানোর জন্য আরও নানা কৌশল নিতে হয়। নিজের ভোটারদের ভোটের দিন বুথ পর্যন্ত নিয়েও আসতে হয়। তার জন্য বুথ-পিছু অন্তত দশ জন করে প্রশিক্ষিত কর্মী দরকার হয়।
কংগ্রেস এখানেই পিছিয়ে থেকেছে। রাহুল গাঁধী নরেন্দ্র মোদীর ‘দুর্নীতিমুক্ত’ ভাবমূর্তিতে ঘা দিতে ব্যস্ত থেকেছেন। কিন্তু গরিবদের জন্য তাঁর ‘ন্যায়’ প্রকল্প নিয়ে ঘরে ঘরে প্রচারের কাজ করার সংগঠন তাঁর হাতে ছিল না। ১৩৪ বছরের কংগ্রেসের ইতিহাসে ২০১৪’য় মাত্র ৪৪টি আসনে জেতার পর কংগ্রেসের এ বারের ৫২টি আসনে জেতা তাই খারাপ ফলের দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে।
লোকসভা ভোটের প্রচারপর্বে কংগ্রেস শাসিত তিন রাজ্য—মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তীসগঢ়ে ঘুরে দেখেছি, কোনও রাজ্যেই কংগ্রেস দফতরে নেতাদের দেখা মেলে না। তা রাজ্যের প্রদেশ কংগ্রেস অফিস হোক বা জেলা সদর। বিশেষ কোনও বৈঠক, সাংবাদিক সম্মেলন ডাকা হলে নেতারা আসেন। শেষ হলেই বেরিয়ে যান। তাঁদের দরবার বসে নিজেদের বাড়ির বৈঠকখানায়। দিল্লিতে চব্বিশ নম্বর আকবর রোডে এআইসিসি দফতরেও একই ছবি। কংগ্রেস সভাপতির ঘর তালাবন্ধই থাকে।
কলকাতায় সিআইটি রোডে পশ্চিমবঙ্গের প্রদেশ কংগ্রেসের সদর দফতর বিধান ভবনে শেষ কবে কোনও কংগ্রেস সভাপতি গিয়েছেন? সনিয়া গাঁধী সম্ভবত শেষ বার গিয়েছিলেন বরকত গনি খান চৌধুরীর মৃত্যুর পরে। আর রাহুল গাঁধী শেষ বার গিয়েছিলেন বছর দশেক আগে। যুব কংগ্রেসের দায়িত্বে থাকাকালীন। প্রদেশ কংগ্রেস দফতরে নেতাদের না পেয়ে কর্মীরা ভিড় করেন নেতাদের বাড়িতে। তৈরি হয় নিজস্ব গোষ্ঠী। কালের নিয়মে তা থেকেই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব।
বিজেপিতেও কি এই সমস্যা নেই? রয়েছে। সব দলেই থাকে। গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব মিটিয়ে নেতাদের জোট বেঁধে কাজ করাতে শীর্ষ নেতৃত্বের হাতে কর্তৃত্বের চাবুক দরকার হয়। সেই অদৃশ্য চাবুকটা অমিত শাহের হাতে সব সময়ই থাকে। কংগ্রেসের সংস্কৃতিতে সেটা অনেক দিনই নেই। বরং রাজ্যে রাজ্যে সব সময়ই কংগ্রেস নেতাদের দুই বা ততোধিক বিবদমান গোষ্ঠীকে একসঙ্গে ধরে রাখতে গাঁধী পরিবার ‘ফেভিকল’ হিসেবে কাজ করে। গাঁধী পরিবারের গুরুত্ব তাতে বাড়ে। কিন্তু কোথাও ফাটলের সিমেন্ট খসে গেলেই পিছনের কঙ্কালসার চেহারা বেরিয়ে পড়ে।
রাহুল প্রবীণ-নবীনদের একসঙ্গে নিয়ে চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু সংগঠনের দুর্বলতার কারণেই বৃদ্ধতন্ত্র বনাম নবীনতন্ত্রের মধ্যে পারস্পরিক দোষারোপ বেড়েছে। সংগঠন না থাকলে উপর থেকে ঝকঝকে তরুণ মুখের নেতা প্যারাশুটে করে নামিয়ে দিলেও যে লাভ নেই, তার প্রমাণ হল গুজরাত। গত বিধানসভা ভোটে কংগ্রেস প্রায় ক্ষমতা দখলের কাছাকাছি চলে এসেছিল। বিধানসভায় দারুণ ফলের পরেও লোকসভা ভোটের আগে একের পর এক নেতা কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। ‘টিম রাহুল’-এর তরুণ তুর্কি রাজীব সতভকে এআইসিসি-তে গুজরাতের দায়িত্ব দিয়েছিলেন রাহুল। মোদী-শাহের ঘরের মাঠে বিজেপির বিরুদ্ধে নবীন নেতাকে দায়িত্ব দেওয়ায় প্রবীণ নেতারা অবাক হয়েছিলেন। শুধু তরুণ মুখ আমদানি করলেই লাভ হয় না, গুজরাত তা প্রমাণ করেছে। অসমে কংগ্রেস ছেড়ে হিমন্তবিশ্ব শর্মা বিজেপিতে যোগ দিয়ে শুধু অসম নয়, গোটা উত্তর-পূর্বেই কংগ্রেসের সংগঠনে ভাঙন ধরিয়ে দিয়েছেন। একই ভাবে আর এক তরুণ নেতা গৌরব গগৈকে পশ্চিমবঙ্গের ভার দিয়েও কোনও লাভ হয়নি।
প্রিয়ঙ্কা গাঁধী বঢরাকে এত দিন কংগ্রেসের নেতারা আস্তিনে লুকিয়ে রাখা তুরুপের তাস আখ্যা দিয়ে এসেছেন। সংগঠনে জোর না থাকলে সেই তুরুপের তাসও যে ম্যাজিক দেখাতে পারে না, তার নমুনা উত্তরপ্রদেশে মিলেছে। ভোটের মাত্র তিন মাস আগে প্রিয়ঙ্কা গাঁধী বঢরা ও জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়াকে আচমকাই উত্তরপ্রদেশের দায়িত্ব দিয়ে মাঠে নামিয়ে দেন রাহুল। মাঠেঘাটে কর্মীরা না থাকলে প্রিয়ঙ্কা কী করতে পারেন? তারই ফল হল, কংগ্রেস পাঁচ বছর আগে উত্তরপ্রদেশে মোট ৬০.৬১ লক্ষ ভোট পেয়েছিল। এ বার তা প্রায় ৬ লক্ষ কমেছে। উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসের ভোটের ভাগও ৭.৫৩ শতাংশ থেকে ৬.৩১ শতাংশে নেমে এসেছে। প্রিয়ঙ্কা নিজেই অমেঠী-রায়বরেলীতে প্রচারে গিয়ে গাঁধী পরিবারের অনুরাগীদের মুখে অনুযোগ শুনেছেন, কংগ্রেস কর্মীদের তেমন ভাবে প্রচারে দেখা যাচ্ছে না।
দলীয় সংগঠন ঢেলে সাজতে চেষ্টা রাহুল যে করেননি, তা নয়। কংগ্রেস সভাপতির পদে বসার আগে থেকেই নিচুতলা থেকে নেতা তুলে আনা, দলের সংগঠনের মধ্যে থেকে লোকসভা বা বিধানসভা ভোটের প্রার্থী নির্বাচনের মতো বৈপ্লবিক কাজ শুরু করেছিলেন। তাতে একটা ঝাঁকুনি দেওয়া গিয়েছিল। কিন্তু তার অনেক আগেই কংগ্রেস ক্যাডার-ভিত্তিক পার্টির চরিত্র হারিয়ে ফেলেছে। তাই হাতেগোনা কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে যাঁর যেখানে ক্ষমতা, তাঁর হাতেই ছড়ি থেকেছে।
সংগঠন না থাকলে কোনও বিরোধী দলই যা করে উঠতে পারে না, তা হল, রাস্তায় নেমে আন্দোলন। মহারাষ্ট্রে কংগ্রেস পাঁচ বছর আগেও ক্ষমতায় ছিল। সেই রাজ্যে চাষিদের আন্দোলন ‘কিসান লং মার্চ’ খাড়া করেছে সিপিএমের কৃষক সংগঠন। মধ্যপ্রদেশে মন্দসৌরে চাষিদের আন্দোলনেও কংগ্রেস নেতা-কর্মীদের দেখা মেলেনি। কংগ্রেস বা তার কোনও গণ সংগঠন এ সব আন্দোলন খাড়া করতেও পারেনি। ভোটে এর ফায়দাও তুলতে পারেনি।
ভোটের প্রচারের ফাঁকে রমন মহর্ষির আধ্যাত্মিক শিক্ষা ও উপদেশ সংবলিত ‘বি অ্যাজ় ইউ আর’ বই পড়ছিলেন রাহুল গাঁধী। রমন মহর্ষির শিক্ষার প্রধান মন্ত্রই হল ‘আত্মোপলব্ধি’। শুধু নিজের নয়। রাহুল গাঁধীকে দলের অন্দরের দুর্বলতাও উপলব্ধি করতে হবে। ১৩৪ বছরের পুরনো জাহাজের ক্যাপ্টেন হিসেবে সেটাই তাঁর প্রথম দায়িত্ব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy