সমাজকে রোজ উদোম দেখে দু’জন— সেক্স ওয়ার্কার আর সাংবাদিক। সাংবাদিক তাই স্বভাব-সিনিক, কাউকে হাসতে দেখলেও ভাবে, ‘এ আজ হাসে কেন? স্টোরিটা কী?’ এ বছর ‘স্পটলাইট’ সেরা ছবি ঘোষণা সেই বিরল মুহূর্তের একটা, যখন গোটা বিশ্বের সাংবাদিক হেসেছেন। এ শুধু চলচ্চিত্রের নয়, সাংবাদিকতার সেলিব্রেশন।
‘বস্টন গ্লোব’ কাগজে তদন্তমূলক রিপোর্টিং বিভাগ ‘স্পটলাইট’। ২০০২ সালে সেখানে প্রকাশিত হয় রিপোর্ট— ম্যাসাচুসেটসের বহু যাজক শিশুদের যৌন নির্যাতন করেছেন, জেনেও ধামাচাপা দিয়েছে ক্যাথলিক চার্চ। নির্যাতন কত ব্যাপক, তার আঘাত কত ভয়ানক, তা সেই প্রথম লোকে জানল। ক্রমে এমন প্রচুর ঘটনা সামনে এল।
কিন্তু ছবির ‘স্টোরি’ সেটা নয়। ‘স্পটলাইট’ আলো ফেলেছে সাংবাদিকতার উপর। হুমকি-চাপ-প্রলোভনের মুখে সাংবাদিকের সাহসের ছবি নতুন নয়। কিন্তু কপালে বন্দুক ঠেকানোর চাইতে কম মারাত্মক নয় তাচ্ছিল্যের হাসি। এ আবার খবর নাকি হে? প্রতিপক্ষ যখন প্রতিবেশী-পরিজন, তখন চাপ আরও বাড়ে। স্কুলের ফুটবল কোচ, পাড়ার যাজক, সহপাঠী-সহকর্মীর নামে কাদা দেবে তুমি? দু’একটা লোকের কীর্তির জন্য আর্চবিশপের নাম জড়াবে? স্পটলাইট টিমের প্রধান, ওয়াল্টার রবিনসনকে (অভিনয়ে মাইকেল কিটন) এক ‘শুভাকাঙ্ক্ষী’ বোঝান, সম্পাদক ইহুদি, তুমি ক্যাথলিক। সে মায়ামি থেকে এসেছে, দু’দিন পরে চলে যাবে। তুমি বস্টনেই বড় হয়েছ, এখানেই থাকবে। ওর কথায় কি তুমি স্কুল, চার্চ, শহরের নাম ডোবাবে?
এমন প্রশ্নের সামনে বহু সাংবাদিক খবর থেকে সরে আসেন। ‘সোর্স’-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এরই অন্য দিক। পুলিশ বিট-এর রিপোর্টার পুলিশের হয়ে তর্ক করেন, রাজনীতির রিপোর্টার নেতার দুর্নাম সইতে পারেন না। খবর চাপা দিতে কেউ নির্যাতিতের দোষ খোঁজেন। ও এত দিন কী করছিল? বলেনি কেন? কেউ যুক্তি দেন, ‘এমন কতই হয়।’
‘স্পটলাইট’ ব্যাপারটা বড় ভাল ধরেছে। বস্টন গ্লোবেই যাজকদের শিশু নির্যাতনের খবর পর পর বেরিয়েছে কয়েক দশক ধরে, কিন্তু সেই সব টুকরো খবর থেকে ‘স্টোরি’ তৈরি করা হয়নি। সাংবাদিকরা যখন আইনজীবী, প্রাক্তন যাজক, নির্যাতিতদের প্রশ্ন শুরু করলেন, তাঁরা সব জেনেও গোপন করেছেন কেন, উত্তরে তাঁরা আঙুল তুললেন কাগজের দিকেই। বহু আগে অনেকে চিঠি, নথি, এমনকী নির্যাতিতের তালিকা পাঠিয়েছিলেন কাগজের অফিসে। তা পড়েই ছিল। ক্রমে রিপোর্টাররা টের পান, ‘গোপন’ ছিল না কোনও নথিপত্রই। শুধু খোঁজ করা হয়নি আদালতে, লাইব্রেরিতে। নির্যাতিত, অভিযুক্ত, সকলেই ছিল এলাকাতে। কেউ কথা বলেনি। প্রশ্ন করতে এক যাজক সরাসরি স্বীকারও করেন যে, তিনি নির্যাতন করেছেন। ক্রমে স্পষ্ট হয়, যে ‘সিস্টেম’ ধামাচাপা দেয় অপরাধকে, বস্টন গ্লোবও তার শরিক ছিল।
এ ছবি যেন চামড়ার তলায় ঢুকে সব সাংবাদিকের উদ্বেগ, ফ্রাসট্রেশন, বিশ্বাসভঙ্গের তিক্ততা তুলে এনেছে। এমন রিপোর্টার নেই, ছোট খবরের পিছনে ছুটতে গিয়ে যার বড় ‘স্টোরি’ মিস হয়নি। আর কেউ খবরটা পেয়ে যাবে, সেই উদ্বেগে যে চেঁচামেচি করেনি অফিসে। ‘তুমিও ব্যবহার করছ আমাকে,’ নির্যাতিতের এই অভিযোগের সামনে যে কুঁকড়ে যায়নি। অতি-পরিচিত মানুষের আসল চেহারা দেখে ভয়ে, লজ্জায় যে মুখে ঘুরিয়ে নেয়নি। স্পটলাইট টিমের সাংবাদিকরা সবাই ক্যাথলিক। এক জন চার্চে ঢোকা ছেড়ে দেয়। আর এক জন ছেলেমেয়েকে সতর্ক করে, তারা যেন পাড়ার যাজকের বাড়ির ধারেকাছে না যায়। ‘আমারও এমন হতে পারত,’ এই বোধ কুরে কুরে খেতে থাকে রিপোর্টারদের।
রিপোর্ট প্রকাশের পর দিন সকাল থেকে কাগজের অফিসে পর পর ফোন। প্রায় সবাই নির্যাতিত। প্রতিক্রিয়ার প্রাবল্যে সাংবাদিকের আপাত-নিস্পৃহতার বর্মে চিড় ধরে, বিস্ময়ের অভিব্যক্তি খেলে যায় মাইকেল কিটনের মুখে। পরক্ষণেই ফোন তুলে অভ্যস্ত গলায় বলেন, ‘স্পটলাইট।’ ছবি শেষ।
গল্প আর একটু আছে। ২০০৩ সালে পুলিৎজার পায় ‘স্পটলাইট’ টিম। আর এই ২০১৬ সালের অস্কার অনুষ্ঠানে প্রেক্ষাগৃহে ক্যামেরা ধরল রবিনসনকেও। এমন একটা মুহূর্তের জন্য বেঁচে থাকে প্রতিটি রিপোর্টার। বেঁচে যায় সাংবাদিকতা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy