শুধুমাত্র মায়াবতী ও অখিলেশ যাদবই নয়, সদ্যসমাপ্ত সাধারণ নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশে বিজেপির ভাল ফলাফল স্বয়ং মা গঙ্গাকেও সমস্যায় ফেলেছে! কারণ নরেন্দ্র মোদী বা অমিত শাহরা খেয়াল করে দেখেছেন, গঙ্গাদূষণ নিয়ে কিংবা গঙ্গায় অবিরল ধারা আনার ব্যর্থতা নিয়ে নির্বাচনের আগে পরিবেশবিদরা মোদী সরকারের বহু সমালোচনা করলেও ভোটের বাক্সে তা আদৌ প্রতিফলিত হয়নি। সুতরাং পাঁচ বছর আগে গঙ্গা-আরতি করে দিল্লি-দরবারে বসা মোদী গত দফায় যে নদী সংরক্ষণের জন্য কয়েক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করে আলাদা মন্ত্রক বানিয়েছিলেন, এ বারে তিনি সরকারে এসেই গঙ্গাকে স্রেফ গুরুত্বহীন বলে ঘোষণা করেছেন!
আসলে এ বারের সরকারে মা গঙ্গার এই ‘গঙ্গাপ্রাপ্তি’ কোনও ব্যতিক্রম নয়। পরিবেশের ক্ষেত্রে ভারতে এখন এটাই দস্তুর। বিশ্বপরিবেশ দিবসে কয়েকটা বক্তৃতা দাও, ভোটের বাজারে চাপে পড়লে বা পাকেপ্রকারে পরিবেশের কোনও বিষয় মিডিয়ার খাদ্য হয়ে উঠলে তাকে কয়েক দিন গুরুত্ব দাও। নির্বাচনের আগে ছাত্রছাত্রীদের রচনা লেখার স্টাইলে ম্যানিফেস্টোয় কয়েকটা লাইন লেখো। আবার নির্বাচন মিটে গেলে কিংবা অন্য কোনও বিষয় সামনে চলে এলে তাকে স্রেফ ভুলে যাও। এটাই ফর্মুলা। নির্বাচনের পরের কথা ভুলে যান। এমনকি নির্বাচনের সময়েও পরিবেশ কতটা গুরুত্ব পেয়েছে, তা তলিয়ে দেখলে অবস্থা স্পষ্ট বোঝা যাবে। রাজনৈতিক দলের প্রচারসভায় রাফাল থেকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা, দুর্নীতি থেকে দিনের বাজারমূল্য, সব কিছু নিয়ে আলোচনা চলল, কিন্তু পরিবেশ নিয়ে একটা শব্দও বিবদমান দলগুলির মুখে শোনা গেল না। বিজেপি-তৃণমূল বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তরজায় মাতলেন, কিন্তু তৃণমূল নেতারা এক বারও প্রশ্ন তুললেন না যে, কেন দেশ জুড়ে উন্নয়নের নামে বনাঞ্চল ধ্বংস করা হচ্ছে, কেন গঙ্গার অবিরল ধারা চেয়ে অনশনে মানুষকে প্রাণত্যাগ করতে হচ্ছে। কেনই-বা একের পর এক পরিবেশ আইন পাল্টে পরিবেশ-প্রতিষ্ঠানগুলিকে দুর্বল করা হচ্ছে! উল্টো দিকে, বিজেপিও প্রশ্ন তোলেনি, কেন কলকাতার বায়ুদূষণ কমাতে সরকার কোনও ব্যবস্থা করছে না, বরং ট্রাম-এর মতো পরিবেশবান্ধব পরিবহণ তুলে দিতে চাইছে। কেন যাবতীয় আইনি প্রতিরোধ ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও পূর্ব কলকাতা জলাভূমি ক্রমেই চুরি হয়ে যাচ্ছে। কেন নদীগুলিকে বাঁচানোর জন্য সরকার কোনও পরিকল্পনা নিচ্ছে না!
কিছু দিন আগে একটি আন্তর্জাতিক পরিবেশ-বিষয়ক সংস্থা তাদের গবেষণাভিত্তিক রিপোর্টে জানায় যে, ২০১৮ সালের বায়ুদূষণের নিরিখে পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত দশটি শহরের মধ্যে আটটিরই ঠিকানা ভারতে। প্রায় হাজার চারেক শহরের সেই তালিকায় কলকাতা আছে তেইশ নম্বরে। আরও আশঙ্কার কথা, পৃথিবীতে প্রথম পঁচিশের মধ্যে থাকা যে কয়েকটি বড় শহর আছে, তাদের মধ্যে ২০১৭ ও ২০১৮ সালের তুলনামূলক হিসেবে দূষণবৃদ্ধির মাত্রায় কলকাতা চতুর্থ স্থানে। তথ্য বলছে, দেশের বড় শহরগুলির মধ্যে সামগ্রিক বায়ুদূষণের নিরিখে কলকাতা দিল্লির ঠিক পরেই। এমনকি গত শীতে কলকাতার দূষণমাত্রা দিল্লিকেও ছাড়িয়ে চলে গিয়েছিল। তথ্য বলছে, কলকাতার গাড়ির জন্য বায়ুদূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। দূষণের জন্য ফুসফুস-ক্যানসারে কলকাতা এখন দেশের ‘রাজধানী’— এখানকার শিশুদের অধিকাংশই কোনও না কোনও শ্বাসজনিত রোগের শিকার। অথচ এত কিছু সত্ত্বেও আমরা এখনও শুধু ‘গবেষণা’ করে চলেছি, কী ভাবে বায়ুদূষণ কমানো যায়। মাঠে নেমে দূষিত গাড়ি কমানো, বা শহরে সিএনজি আনা, বা গণপরিবহণ ব্যবস্থা উন্নত করা, বা শক্ত হাতে নির্মাণ দূষণ থামানো— প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা মোটেই এই সব কাজ করতে রাজি নন।
কেন? আমাদের উন্নয়নের ভাবনার মধ্যেই মূল গলদ। বাজার, বহুতল আর জাগতিক আনন্দের দ্রব্যসংগ্রহের মধ্যেই আমাদের উন্নয়ন বন্দি; তাই ‘কোয়ালিটি অব লাইফ’ বলতে নির্মল বাতাস ও জলের কথা আমরা ভাবি না। এক দিকে আমাদের দেশ জিডিপি বৃদ্ধিতে প্রভূত সন্তোষ পায়। কিন্তু পৃথিবী জুড়ে ‘হ্যাপিনেস ইনডেক্স’ বা আনন্দের মাপকাঠিতে কেন আমরা পিছিয়ে, তার কারণ সন্ধান করে না। অধিকাংশ রাজনৈতিক দল, মুখে না বললেও মনে মনে বিশ্বাস করে যে পরিবেশ নিয়ে বেশি কথা বললে বোধ হয় তথাকথিত উন্নয়ন ব্যাহত হবে। বোঝে না যে, ‘রাস্তায় দাঁড়িয়ে-থাকা’ উন্নয়নকে মানুষের ঘরে নিয়ে আসতে হলে পরিবেশকে গুরুত্ব দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। বায়ুদূষণের কথা বললে আসলে মেনে নিতে হয় গাড়ি থেকে হওয়া দূষণের কথা। গুরুত্ব দিতে হয় গণপরিবহণকে। মার খায় ব্যক্তিগত যানবাহনের বাজার। বস্তুত পরিবেশের পক্ষে কথা বলার সুবিধাটা সুদূরপ্রসারী— আর না বলার, কিংবা ঘুরিয়ে উল্টো পথে হাঁটার সুবিধাটা তাৎক্ষণিক। সুতরাং গড়পরতা রাজনৈতিক দলগুলির কাছে কোনটা কাম্য, সহজেই অনুমেয়। এর পাশাপাশি পরিবেশ নষ্ট করতে দেওয়ার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অঙ্কে দেনাপাওনার হিসাবকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই বিশ্ব পরিবেশ দিবসে বক্তৃতা হয়, বায়ুদূষণ নিয়ে ইন্টারনেট থেকে দিস্তে দিস্তে তথ্য জোগাড় হয়, একটু বেশি বুদ্ধিমান ও পড়াশোনা করা রাজনীতিক বা আধিকারিকরা চিনের উদাহরণ দেন। কিন্তু ‘চিনের মডেল আমাদের মডেল’ বলে মাঠে নেমে পড়বেন কেউ, এতটা প্রত্যাশা না করাই ভাল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy